114 views
এখন আপনি বাঙালি নামের মানুষজন খুঁজে পাবেন কম। একসময় বাংলা নাম রাখার হিড়িক পড়লেও অন্ধ বিশ্বাস তা খারিজ করে দিয়েছে। হিন্দুরা যেমন তাদের ধর্ম বা পৌরানিক কাহিনীর নাম গ্রহণ করছে মুসলমান বাঙালিও ঝুঁকেছে সে দিকে। ফলে বাংলাদেশে এখন বাংলা নামের আকাল । জীবনের নানা অনুষঙ্গে বাংলাকে বর্জন করা অসম্ভব। তবে বিকৃত করা ঠেকায় কার সাধ্য? ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত বাংলা। সে দেশ হোক মানুষ হোক আর ভাষা হোক তার মতো বিপদে নাই কেউ। অথচ ৫০ বছর আগে আমরা দেশ স্বাধিনের সময় দেখেছি বাঙালি হবার জন্য কি আকুতি। কি ভাবে বাংলাকে আঁকড়ে ধরেছিল তখনকার মানুষজন। আজ সে বন্ধন আলগা হয়ে গেছে। দিবস পালন আর উদযাপনের নামে কিছু নিয়মের বাইরে একুশে মিডিয়া ছাড়া আর কোথায় বলুন তো? এই যে এবার তিনদিনের ছুটি সবাই চলে গেছে বেড়াতে তাদের কেউ কি বাংলা ভাষা আর তার দান মনে রাখবে? মুখে মুখে হাই হ্যালো আর ওয়াও বিউটিফুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে আমাদের সমস্ত চেতনা।
অথচ আমাদের দেশটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ভৌগোলিক সংলগ্নতা আর ঐতিহ্য এক হলে ভারত ভাঙ্গতে হতোনা। আর ধর্ম মূখ্য হলে পাকিস্তানই থাকতো এক। বাংলাদেশের জন্মের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। সেই ভাষা আমাদের রক্তের অধিকার। মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত আর কোন ইতিহাস নেই যা একুশের মত মহান। সে প্রথম রক্তপাত যা ইতিহাসকে শুদ্ধ করে দিয়েছিল। সে শুদ্ধতার একুশে আজ কি শুধুই প্রথা, শুধুই বইমেলা আর কিছু আবেগ? এখন এসব প্রশ্নের জবাব চাওয়া জরুরী। বাস্তবে বাংলাদেশ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে তার অতীত তাকে গৌরবমন্ডিত করে রাখলেও বর্তমান ঝুকছে বাংলাবিরোধী অপশক্তির সাথে।
আজকের তারুণ্য, শিশু কিশোর বা নারীরা কি আসলেই একুশের চেতনার ধারে কাছে আছে? সমাজে এখন ধর্মের নামে যে অন্ধত্ব তার আঁচে তার উত্তাপে সমাজের আদল বিকৃত হবার পথে। অন্যদিকে আছে হিন্দীর আধিপত্য। আমাদের ছেলে মেয়েরা জেনে বড় হচ্ছে আগে সম্প্রদায়গত পরিচয় তারপর জাতিসত্তা। এটা না ছিল একুশের চেতনা না মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। একসময় আমাদের যেসব অগ্রজেরা বাংলা বর্ণমালার একেকটি কণাকে মা বলে সম্বোধন করতেন বাংলা বাঙ্গালির প্রাণ মনে করতেন আজ সে সম্মানের বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট নাই। বরং সুকৌশলে শব্দ ও ভাষার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে শব্দগত বিদ্বেষ। ভাষা সাম্প্রদায়িকতা এক ভয়াবহ রোগ। সে যখন আক্রমন করে বা বিস্তার লাভ করে তখন সমাজের আসল পরিচয় ঘুচে সে হয়ে ওঠে ক্লীব।
তারুণ্যকে- কেমন আছো? এমন প্রশ্ন করলে জবাব আসে, বিন্দাস আছি। কি এই বিন্দাস? সে মহারাষ্ট্রের হোক আর কাবুলের হোক আসলে তার এই ঢুকে পড়ার ভেতর আছে সর্বনাশের ঈঙ্গিত। এমন এক পরিবেশ ঈশ্বরের নামও পরিবর্তন করে দিয়েছি আমরা। বলতে বলতে অভ্যস্ত খোদা হাফেজ এখন আর চলেনা। কেন না? তার উত্তর আমাদের অজানা নয়। এসব পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়া ফেব্রুয়ারী কি আসলেই প্রেরণার উৎস এখন? তাই যদি হবে বইমেলার প্রাঙ্গণে বা বইমেলাকে ঘিরে রক্তের দাগ আসে কোন সাহসে? ঢাকার এই বইমেলা বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় মেলা। কলকাতার তূলনায় নানাদিক থেকে এগিয়ে থাকা মেলাটি কে ঘিরে কারা এই মাতম করে? কি তাদের আসল উদ্দেশ্য? রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝা বড় কঠিন। তারা দলভিত্তিক ঝগড়া করে বটে চড়াও হয় মেধার ওপর। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে মেধা ও প্রজ্ঞাই এদেশের বড় বড় কাজগুলো করার সাহস যুগিয়েছিল। কী আশ্চর্য সময়কাল। পদ্মাপাড়ের ভীতু ও দূর্বল নামে পরিচিত ছোটখাটো মানুষগুলোই রক্ত দিয়ে একের পর এক মৌলবাদী আগ্রাসন ঠেকিয়েছিল। আজ সেই সাহস সেই শৌর্য অস্তমিত। শুধু তাই নয়, কিভাবে যেন ভয় প্রলোভন আর চাতুর্যে সুশীল থেকে প্রতিবাদী সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে নষ্ট সময়। এই শীতল সময়কে আমি শান্ত বলতে নারাজ। এটি আসলে কোন এক কঠিন ঝড়ের পূর্বাভাষ অথবা বিনষ্টের আগে ঘুমিয়ে থাকা মাটির জেগে ওঠার সহ্যকাল।
একুশের একটা আন্তর্জাতিক দিকও আছে। সেটি ভুলে গেছে দানবেরা। যেসব বাংলাদেশী দেশের বাইরে দুনিয়ার নানাদেশে বসবাস করেন তাদের সংখ্যা এখন হেলেফেলার নয়। বরং এরা নিরাপদ সমাজে বড় হয়ে ওঠা এক শক্তিবলয়। তারা বাংলাভাষা ও দেশ থেকে দূরে থাকেন বলে তাদের এই দুয়ের প্রতি টান অকৃত্রিম। এই বিপুল জনগোষ্ঠী যে ভাষা যে সমাজেই থাকুকনা কেন তাদের কাছে বাংলার মর্যাদা মায়ের মর্যাদার মতো। তারা কোন ভাবেই মাকে অপমানিত হতে দেবেননা। দেবেননা বলেই বিলেতের শহীদ মিনারের বয়স এখন প্রৌঢ়। আমাদের সিডনিতেও নয় নয় করে অনেকবছর হয় মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ মাথা তুলেছে প্রশান্তপাড়ে। তার বই মেলা তার একুশে যত ছোটই হোক এর প্রানশক্তি অনেকবেশী। আমি একথা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিনষ্ট রাজনীতি বা পরিবর্তনের নামে অপশক্তির জোয়ারে এরা সবকিছু ভেসে যেতে দেবেনা। এ প্রতীতী আমার নির্ভুল।
এই একুশে আমাদের দেশের মানুষ একদিনের জন্য বাঙ্গালি হলেও তাদের জীবনে আজ অনেক প্রশ্ন আর সমস্যা। সেগুলো রাজনীতি সমাধান করবে কি করবেনা সেজন্যে বসে থাকলে চলবেনা। দেশ ও মানুষ এক অখন্ড অভয় শক্তির নাম। তাদের সাথে আছে বিদেশের বাংলাদেশীরা। এই শক্তিকে জাগানোর জন্য সংস্কৃতি ও মেধার উদ্বোধন চাই। কিছু উঠতি যুবক যুবতী বা বয়সী মানুষের পুস্তক প্রকাশনা নিতান্ত আনন্দের, উৎসাহের ও বটে। কিন্তু চিকিৎসা আইন বিজ্ঞান মহাকাশের কোন ভালো বই আজো বাংলায় নেই। আজো আমাদের লেখাপড়ার জগতে বিদেশী ভাষার চাপ। এসব থেকে মুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক ভাষার সাথে নিবিড় আত্মীয়তা ও ঐক্যেই গড়তে হবে নতুন বাংলাদেশ।
মনে রাখতে হবে এখনো আদিবাসী পাহাড়ী ছোট ছোট নৃ গোষ্ঠীর জীবন ও ভাষা অনিরাপদ। অনিরাপদ নারী ও শিশু। একুশের চেতনা বা ভাষার লড়াই সেদিন শেষ হবে যেদিন সবাই মিলে ভাবতে শিখবে এদেশ আমাদের। তারপরও এই আমাদের গর্বের আনন্দের প্রেরণার উৎসভূমি। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকতার ঐক্যও এখানেই।
আমার একুশে, আমার মা আমরা হারতে পারিনা।
অজয় দাশগুপ্ত
ছড়াকার ও কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।