[ পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই বৃত্তের ভেতরে বাস করেন। খুব কম সংখ্যক মানুষই আবার বৃত্তের বাইরে নিজের অজান্তেই আরেকটি বৃত্তে আবিষ্ট হচ্ছেন। আপনি আপনার পরিধির ব্যাপ্তি ঘটাচ্ছেন এবং সেই বর্ধিত গোলকে সকলের সাথে ভাগাভাগি করছেন আপনার সুস্থতা, সৌখিনতা, আদর্শ এবং ভিন্নতা। আপনি এভাবেই বৃত্তের বাইরে আরেকটি বৃহৎ বৃত্তেরই মানুষ।]
অজয় দাশগুপ্ত। কলামিস্ট, ছড়াকার এবং প্রাবন্ধিক। দীর্ঘদিন বাস করছেন অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যিক শহর সিডনিতে। দেশে বিদেশের নামকরা সব পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। তাঁর সব লেখালেখি যদি গ্রন্থিত হতো তাহলে পুরো একটি লাইব্রেরিতে শুধু তাঁর বইই থাকতো। তবু আমরা পেয়েছি তাঁর রচিত ‘কৃঞ্চ সংস্কৃতির উত্থান পর্বে’; ‘ছড়ায় গড়ায় ইতিহাস’; ‘শুধু ছড়া পঞ্চাশ’; ‘কলামগুচ্ছ’; ‘কালো অক্ষরে রক্তাভ তুমি’; ‘তৃতীয় বাংলার চোখে’ সহ মূল্যবান কয়েকটি গ্রন্থ।
লেখালেখির মতই প্রাঞ্জল তাঁর কথা বলা। কখনও কখনও কন্ঠে গানও তোলেন তিনি। লিখছেন প্রশান্তিকায়ও। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া প্রশান্ত পাড়ের বাঙলা কাগজ ‘প্রশান্তিকা’ নামটিও দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়- প্রশান্তিকার নানাবিধ কর্মকাণ্ড, প্রকাশনা এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পরামর্শ দিয়ে তিনি আমাদের পাশে থেকেছেন। আজ ১০ জানুয়ারি আমাদের পরম শুভার্থী অজয় দাশগুপ্তের জন্মদিন। প্রশান্তিকার ‘বৃত্তের বাইরে’র এবারের অতিথি আজকের শুভদিনে জন্ম নেয়া আলোকিত মানুষ অজয় দাশগুপ্ত। প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন এক ডজন প্রশ্ন নিয়ে। তিনি অকপটে জবাব দিয়েছেন সব প্রশ্নের।
প্রশ্ন ১। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্মদিন বা প্রয়াণ দিনে খুব সুন্দর করে লিখেন আপনি? আপনার জন্মদিনে অসংখ্য মেসেজ ও শুভকামনায়ও আপনার টাইমলাইন ভরে যায়। আপনি যেমন অপরের জন্য লিখেন- আপনার জন্য অপরের লেখা কেমন লাগে?
অজয় দাশগুপ্ত: আমার যখন থেকে মনে হয়েছে ফেইসবুক বা সামাজিক মিডিয়া কেবল নিজেদের ছবি, খাবারের ছবি দেয়া আর বেড়ানোর কথা লেখার জায়গা না তখন থেকে আমি এই বিষয়টা চালু করেছি। যে সব কৃতি বাঙালি আমাদের মন মনন রুচি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন বা করেন কিংবা এমন কিছু মানুষ যাদের আমি কোনভাবেই এড়াতে পারি না তাঁদের আমি স্মরণ করি। মানুষকে তাঁদের কথা মনে করিয়ে দেই। সাধারণ ভাবে একটি অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বাঙালিকে এদের কথা মনে করানোর ছোট কাজটি মানুষ পছন্দ করে এটাই আমার আনন্দ। যেহেতু সিংহভাগ মানুষই প্রয়াত তাই এর থেকে পাওয়া না পাওয়ার কোন ব্যাপার থাকে না। এ কেবলই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।
নিজের জন্মদিনে যাঁরা ভালোবেসে শুভেচ্ছা জানান, ভালোবাসেন বা স্নেহ মায়ায় আবদ্ধ করেন তাদের সমথর্ন, তাদের সমালোচনা বা বিরোধিতা সবই আমার পাথেয়।
প্রশ্ন ২। আপনার দীর্ঘদিনের লেখালেখি জীবনকে যদি এক ঝলকে বলতে বলি, কি বলবেন?
অজয় দাশগুপ্ত: আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯৭১ সালে তখনকার দৈনিক পয়গাম পত্রিকার শিশু পাতায়। পরের সপ্তাহেই ছাপা হয় “প্রথম লেখার আনন্দ” নামে ছোট একটি গদ্য। এখনো যে কোন লেখাই আমাকে সে আনন্দ দেয় বলেই লিখি। দীর্ঘ সময়ের লেখালেখি এক ঝলকে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের পর্বত আরোহনের মত বিপদসংকুল নানা ঘাত প্রতিঘাত ও বিরোধিতায় আনন্দময়।
প্রশ্ন ৩। আপনি জীবনে যা হতে চেয়েছিলেন তা কি হতে পেরেছেন?
অজয় দাশগুপ্ত: না। আমি যা হতে চেয়েছি তার কিছুই হতে পারিনি। আমি বড় হয়েছি বাড়ীতে বসে পত্রিকা পত্রিকা খেলে। সবাই যখন দুপুরে ঘুমাতো আমি কাগজ কেটে পত্রিকা তৈরী করতাম যার স্বঘোষিত সম্পাদক ছিলাম আমি নিজে। চারপৃষ্ঠার সেই ছোট পত্রিকার নাম ছিলো দৈনিক ইতিবৃত্ত। সম্ভবত তখনকার জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের আমার মগজজাত সংস্করণ। এই পত্রিকার হেডিং করতাম তখনকার দরিদ্র স্বদেশের কল্পিত গৌরব কামনা। শেষ পাতায় খেলার খবরে থাকতো ঢাকা মহামেডানের বিশাল জয়ের খবর। কিন্তু আমি তো কোন পত্রিকার সম্পাদক হতে পারিনি।
আমি যৌবনে স্বপ্ন দেখতাম আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পের নায়ক আজিম দারোগা হবো। এখন যদিও পুলিশ দেখলে মানুষ ভয় পায় বা তাদের তেমন আপন মনে করে না কিন্তু আমার তো ইচ্ছে ছিলো পুলিশের দারোগা হবার। ইচ্ছে ছিলো আমি টিভিতে ধারাভাষ্য দেব । তাও হয় নি। হয়েছি দেশান্তরী এক সাধারণ মানুষ।
প্রশ্ন ৪। দেশে বিদেশের অসংখ্য কাগজে কলামের পাশাপাশি লিখেছেন বই। সেই বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
অজয় দাশগুপ্ত: আমার খুব বেশী বই নাই। যখন তখন হাতে পায়ে ধরে বই বের করা আমার দ্বারা সম্ভব ছিলো না। আমার তিনটি ছড়ার বই, দুটি প্রবন্ধের আর গুটিকয়েক কলাম ও নিবন্ধের বই আছে। গত একুশে মেলায় আমার কবিতার বইও বেরিয়েছে। সম্পাদিত বিভিন্ন সংকলনে আমার লেখার সংখ্যা অনেক বেশী।

প্রশ্ন ৫। করোনার মত ভয়াবহ মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদের উত্থান দেখেছি। এই অবস্থায় দেশের ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?
অজয় দাশগুপ্ত: আপনাদের সাথে আমি সহমত পোষণ করি। দেশে এখন মৌলবাদের ভয়াবহ বিস্তার দেখছি। সাথে আছে গোপনে বেড়ে ওঠা পারিবারিক ও সামাজিক কুসংস্কার আর মৌলবাদী আচরণ। যে রাজনৈতিক দল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে আজ স্বাধীন দেশের সিংহাসনে তাদের ভেতরেও চলছে একই প্রবণতা। ভবিষ্যত নিয়ে আমি সবসময় আশাবাদী হলেও বলবো সামনে সময় বড় কঠিন। আপোসকামিতা আর ছাড় দিতে দিতে যে রাজনীতি দেয়ালে ঠেস দিয়ে চলে তার কাছে পরিত্রাণ চাওয়া হাস্যকর। তাছাড়া দেশেতো রাজনীতি বা দল বলতে কিছু নাই কাজেই কে আশা করবে কার কাছে?
প্রশ্ন ৬। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি পারবেন এদের দমন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনতে? নাকি ওদের ধ্বজাধারী হয়ে কোনমতে টিকে থাকবেন বলে আপনার মনে হয়?
অজয় দাশগুপ্ত: শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা । তিনি না পারার কারণ ছিলো না। এখন পারবেন কি না তার জবাব দেবে সময়। তবে দমন করতে হলে বহু কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। তাঁর প্রতি আস্থা রাখি কিন্তু বলা কঠিন কিভাবে কি করা সম্ভব।
প্রশ্ন ৭। প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চা কি আপনাকে আকর্ষণ করে?
অজয় দাশগুপ্ত: প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনীতি আকর্ষন করে কি না তার জবাব এককথায় দেয়া অসম্ভব। তবে যতোদিন আমরা দেশের ইতিহাস, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও মৌলিক বিষয়ে সবাই সহমত বা এক পথে থাকতো পারবো না ততোদিন চাইলেও বর্হিবিশ্বে এর প্রয়োজন ফুরাবেনা। ভারত বা পাকিস্তানের মানুষজন গান্ধী জিন্নাহ পতাকা সঙ্গীত নিয়ে নিতর্ক করে না বলেই তাদের দেশের রাজনীতি বিদেশে অচল। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি আমাদের অতীত যেহেতু রাজনীতি নির্ভর আমাদের জন্য এর প্রয়োজন শুধুই ইতিহাস ভিত্তিক। এর বাইরে কিছু না।
প্রশ্ন ৮। নাকি বাঙালিদের মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে আসাকেই আপনার বেশী ভালো লাগছে?
অজয় দাশগুপ্ত: মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ আমাকে আনন্দিত করে। কারণ এর ভেতর যতোটা রাজনীতি ততোটাই গণতন্ত্র। এখান থেকে আগ্রহীরা আইন মান্য করা দেশকে সেবা করার উপকরণ নিতে পারবে। শুদ্ধ রাজনীতি, অবাধ নির্বাচন এবং ফলাফল মেনে নেয়ার বিষয়টাও শিখবো আমরা। যতো এদিকে ঝুঁকবে ততো আমি আমার মতো মানুষেরা মনে করবো আগামীদিনে আমাদের সন্তানরা রাখবে দেশের জন্য কার্যকর ভূমিকা।

প্রশ্ন ৯। আপনার একমাত্র সন্তান বলিউড, হলিউড এবং অস্ট্রেলিয়ার মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কাজ করছেন। আমরা ওকে নিয়ে খুব গর্ব করি। বাবা হিসেবে আপনার গর্বের অনুভূতি জানতে চাই।
অজয় দাশগুপ্ত: আমার আর দীপার একমাত্র সন্তান অর্ক। ও অষ্ট্রেলিয়ার মূলধারায় অভিনয় করে। মঞে সার্থক অভিনয়ের পরে ও অভিনয় করছে টিভি সিরিয়াল ও সিনেমায়। এদেশের বড় বড় ব্যাংক সহ নানা প্রতিষ্ঠান সহ রপ্তানী বানিজ্যের স্তম্ভ ভেড়ার মাংসের বিজ্ঞাপনে ও ছিলো মূল ভূমিকায়। এখন সে ছবি নির্দেশনা , চিত্রনাট্য লেখা ও ছবির গল্প লেখে। সম্প্রতি তার ছবি ‘খানা খাজনা’ সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতার পুরষ্কার পেয়েছে। ডিজনি মুভি ‘মুলান’ এ অভিনয় করে বাংলাদেশী অষ্ট্রেলিয়ানদের মুখ উজ্জ্বল করা ওকে আপনারা দোয়া / আর্শীবাদ করবেন । এখনো তার আসল যাত্রাই শুরু হয়নি বলে মনে করি আমি।
প্রশ্ন ১০। যুগ বদলাচ্ছে। প্রিন্ট এডিশনের খবরের কাগজ ধীরে ধীরে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। একদিন যদি কাগজে বই আর না বের হয়, শুধু মোবাইলে বা কম্পিউটারে বই পড়তে কেমন লাগবে?
অজয় দাশগুপ্ত: প্রিন্ট মিডিয়ার দুর্দিন চলছে এটা মানি। মুদ্রিত সংবাদ পত্রের কাটতি কমে গেছে ভয়াবহ ভাবে। কিন্তু এটাই শেষ কথা না। সেই প্রিন্ট মিডিয়াই অন্য ভার্সানে ইলেকট্রনিক বাহনে ফিরে আসছে। মনে রাখা দরকার দুনিয়ার সবকিছু যেমন আবার ফিরে ফিরে আগের জায়গায় আসতে চায় বা চাচ্ছে খবরের কাগজ ও আবার ফিরে আসবে একদিন। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই গল্পটি মনে রাখি। যেখানে তিনি বলেছিলেন তিনি স্বপ্ন দেখেন তাঁর মুদ্রিত বই গুলো মরে গিয়ে ভুত হবে আর সেই ভূতেরা ইলকেট্রনিক দানবের গলা টিপে টিপে তাদের নির্মুল করবে একদিন।
প্রশ্ন ১১। আমরা সকলেই জানি অজয় দাশগুপ্ত ভালো বলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপনার বক্তব্য শুনি। বক্তা হিসেবে আপনি কি যা ইচ্ছে বলতে পারছেন, কি দেশে বা প্রবাসে?
অজয় দাশগুপ্ত: আমি কথা বলার মানুষ। বলতে পারা ও বলতে চাওয়া আমার আকৈশোর লালিত স্বপ্ন। আমার দু:খ এটাই আমি দেশে নাই বলে মিডিয়ায় নিয়মিত কথা বলতে পারি না। মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি না। সে কষ্ট করোনা কালে কিছুটা লাঘব হলেও সময়মতো জায়গামতো বলতে নাপারার বেদনা আমার নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি।
প্রশ্ন ১২। আপনার প্রিয় লেখকের তালিকা জানতে চাই।
অজয় দাশগুপ্ত: প্রিয় লেখক যেমন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলী তেমনি কাল যে মানুষ নতুন কিছু লিখে চমকে দিয়েছেন তিনিও প্রিয় লেখক। তারচেয়ে বরং এটাই বলবো উপনিষদ, রবীন্দ্রনাথের গান আর জীবনানন্দের কবিতা সাথে ওমর খৈয়াম । জীবনে জীবন সায়াহ্নে বা শেষকালেও এই চাই।
প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
অজয় দাশগুপ্ত: আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। প্রশান্তিকার সকল সাংবাদিক, কলাকুশলীকে আমার শুভেচ্ছা। প্রশান্তিকার নিরন্তর সাফল্য কামনা করি।