মূল্যায়ন এমনই একটি গুণ যা কোন কিছুর সাথে যুক্ত হলে, সেটির চাহিদা বাড়তে থাকে। যা কিছুই মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার জন্যই আমাদের পদক্ষেপ। অর্থকে মূল্যায়ন করা হয়েছে সবচেয়ে বেশী; তার কারণ এ ধারনা থেকে যে, অর্থ দিয়ে প্রায় সবকিছুই অর্জন করা যায়। মূল্যায়নের পরবর্তী ধাপে যে সমস্ত উপাদান, কর্ম, গুণ ও ফসল অর্থ অর্জনে ভূমিকা রাখে, সেগুলিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এভাবে অর্থই ধীরে ধীরে প্রধানতম কাংখিত উপাদান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থ দিয়ে যা যা অর্জন সম্ভব, সে সমস্ত অর্জনে অর্থের প্রয়োজন না হলে, অর্থ অপ্রয়োজনীয় হবে, এটিই স্বাভাবিক। আপাত:দৃষ্টে অর্থহীন অনেক কিছুই তখন মূল্যায়নের বৃত্তে অন্তর্ভূক্ত হয়ে, আবারও পূণর্জীবন পাবে। আবার, অর্থ দিয়েও যা অর্জন সম্ভব নয় কিন্তু যার দ্বারা অস্তিত্বের স্বাদ ও আত্মিক প্রশান্তি প্রাপ্তি সম্ভব, সেটি অমূল্য। অমূল্যটি তাই সহজলভ্য নয়। দুষ্প্রাপ্য এই অমূল্য বস্তু বা বিষয়গুলি যেহেতু অর্থক্ষমতা সীমানার বাইরে অবস্থান করে, সেহেতু অর্থ সংশ্লিষ্ট নয় এরূপ আচরন, বাসনা, চর্চা, সাধনা, প্রতিক্রীয়া ও দিকদর্শনই পারে অমূল্যটিকে সহজলভ্য করতে।
দেহ, মন ও আত্মা এই তিনেই যেহেতু অস্তিত্ব, সেহেতু এই তিনের যত্ন ও পরিচর্যার আয়োজনেই সমগ্র জীবন ব্যস্ত। দেহটি বাহক ও ধারক, মনটি পরিবেশ প্রতিক্রীয়ার রূপ আর আত্মাটি অদৃশ্য বা অতীন্দ্রিয় কিন্তু অপার্থিব চেতনায় উপলব্ধ। আত্মার সন্তুষ্টির তাড়না মনের গহীনে আর দেহের আরাম বা সুস্থতা সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক নিয়ামক। আত্মাটি সর্বদাই নিষ্কলংক বাসনায় স্থায়ীরূপে তৃপ্ত; কলুষিত অবগাহনে তৃপ্তিটি হলো ভ্রম। ভ্রমটি অস্থায়ী, ফলে ভ্রমটি কেটে গলে, ভ্রমের তৃপ্তিটি যাতনাময় ও অসার। আবার, মনের সচেতনতাটি লাভ ও ক্ষতির অনুশাসনে পরিচালিত; ফলে, লাভ-ক্ষতির বিচারে অপ্রয়োজনীয় বলে চিহ্নিত কার্যকলাপ সমূহ সচেতন মনে অগ্রহণযোগ্য। মনের এ সিদ্ধান্তে আত্মাটি প্রশান্ত হয়েছে বলে মনে হলেও, আসলে একটি হাহাকার সর্বদাই আত্মাটিতে বিরাজ করে। সব কিছু থাকা সত্বেও সুখ না থাকার পেছনের কারন বোধ করি, এই হাহাকার সৃষ্টির কারন সনাক্তকরনে ব্যর্থ হওয়া। হাহাকার, শূণ্যতা, তৃষ্ণা দূর করে তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ রূপে আত্মাটিকে জয় করার নামই জীবন। অতএব, প্রয়োজনীয় বা অমূল্য বিবেচনায় কর্মসমূহ মূল্যায়ন করা, সে সমস্তে অবগাহন করা এবং সে সমস্ত দ্বারা আত্মাটিকে লালন করাই হলো সুখের তৃষ্ণায় ছুটে চলা অস্তিত্বের লক্ষ্য।
স্থির চিত্তে চোখ বন্ধ করে পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধক সমূহ থেকে নিজেকে আলাদা করলেই যা যা ভেসে উঠে, সেগুলি অর্থহীন নয়। কি কি ভেসে উঠে সেখানে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুভূতি সংক্রান্ত বিষয়াদি, নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ড, অযথা নিস্ফল পদচারনা, কৌতুহল প্রশমনে বাঁধভাঙ্গা পদক্ষেপ, মাটি-পানি-আলো-আঁধার-সবুজ-শব্দ-গন্ধ-বর্ণে অকারন অবগাহন, ছোট ছোট খুনসুটি, রসনার বাসনায় নিমজ্জন, অকারন আড্ডা এবং সময়ের ছোট ছোট হাতছানিতে সারা দেয়ার মত অপ্রয়োজনীয় বিষয় গুলিই জেগে উঠে সেখানে। মূল্যায়নের মাপকাঠিতে প্রয়োজনীয় বলে স্বীকৃত উপাদান গুলির ভিড়ে উক্ত অপ্রয়োজনীয় বিষয় গুলি প্রায়ই কিংবা কখনোই প্রাধান্য পায় না। আত্মার প্রবনতা ও গতিকে উপেক্ষা করে দেহ ও মনের এ বিরূদ্ধাচরন কিংবা প্রায়ই বা সবসময় আত্মার উপস্থিতিকে উপলব্ধি করতে না পারা, হাহাকার সৃষ্টির জন্য দায়ী। আত্মাটিকে উপলব্ধি না করলেও হাহাকারটি প্রচ্ছন্ন রূপে থেকেই যায় এবং এ প্রচ্ছন্ন হাহাকারটি প্রকট হয়, মোহ বা ভ্রমটি দূর হলে। মূল্যায়ন বিচার কর্মে দুটি প্রেক্ষাপট আলোচনা যোগ্য। একটি প্রেক্ষাপট সচেতন বোধ যা সম্পর্কে ইতিমধ্যে কিছুটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, অন্যটি অস্তিত্ব চেতনা যা বিস্তারিত আলোচনা ও যুক্তির দাবি রাখে। মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট কর্ম বা বস্তুকে মূল্যায়ন সাধারণত তিন প্রকারে করা হয়; অত:পর, তা গৃহিত বা বর্জিত হয়।
বিশেষায়িত মান গুলি হলো- অমূল্য, মূল্যবান বা প্রয়োজনীয়, মূল্যহীন বা অর্থহীন। অমূল্যটি অস্তিত্ব চেতনায় সর্বদাই কাংখিত ও অর্জিত; সচেতন বোধেও এটি কাংখিত, তবে মূল্যবান বা প্রয়োজনের ভিড়ে তা অর্জিত নয়। মূল্যবান বা প্রয়োজনীয় সবকিছু অস্তিত্ব চেতনায় শুধুমাত্র দেহ-মনকে আত্মা উপলব্ধিতে সহায়ক রাখার নিমিত্তেই বিবেচিত হয়; সচেতন বোধে প্রয়োজনীয় সবকিছু সর্বদাই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়। অস্তিত্ব চেতনায় অমূল্য ও কতিপয় প্রয়োজনীয় উপাদান ব্যতীত বাকি সব মূল্যহীন বা অর্থহীন; সচেতন বোধে প্রয়োজনীয় সবকিছুর বাইরে যা কিছু আছে এবং অমূল্যটিও যা অর্জনে অপারগ বলে সচেষ্ট নয়, তা সবই মূল্যহীন বা অর্থহীন। আশঙ্কার বিষয় হলো, সচেতন মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে অমূল্যগুলি অর্থহীন বিবেচ্য হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে অমূল্য সম্পদ তুল্য এবং অতি মূল্যবান বিষয়সমূহ অর্থসারশূণ্য হয়ে, ধীরে ধীরে একটি সামগ্রিক নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ তথা নিরংশু মানব জমিনের সূচনা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় মায়া-ভালবাসা, সম্পর্কের রং, সময়ের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের প্রশ্রয়, সময় সংবিত্তি ও প্রাকৃতিক সংস্পৃষ্টতা সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃক অর্থহীন বিবেচ্য। গন্তব্য যেখানে পূর্বনির্ধারিত এবং সেখানে পৌঁছানোই একমাত্র লক্ষ্য, সে লক্ষ্যার্জন যাত্রায় উপরোল্লিখিত অর্থহীন বিষয়াদি শুধুই কতগুলি প্রতিবন্ধক ব্যতীত অন্য কিছু নয়; অথচ, এ সকল অর্থহীন বিষয়গুলিই অস্তিত্ব চেতনায় মহামূল্যবান বা অমূল্য যার জন্যই আমাদের গন্তব্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ সচেতনরা গন্তব্যের শিখরে যার স্থান দিয়েছে, তা হলো-অর্থ অথবা ক্ষমতা, যা দিয়ে, তাদের ধারনা, যদি প্রয়োজন হয়, উপরোক্ত পন্যগুলি কিনে নিতে পারে। অর্থ বা ক্ষমতা দিয়ে কেনা বলে, প্রাপ্ত অমূল্যরূপী পন্যগুলি যে শুধুই অর্থ বা ক্ষমতার গোলাম, তা অর্থ বা ক্ষমতাটি কমলেই প্রমানিত হয়; তদ্রূপ, রূপের জন্য, প্রয়োজনের জন্য, সময়ের জন্য, মহত্ব প্রদর্শনের জন্য যে মায়া-ভালবাসা, সম্পর্ক, উন্মাদনা, প্রশ্রয়, উপলব্ধি ও সংস্পৃষ্টতা, সে সকল, রূপ, প্রয়োজন ও সময়ের ঘাটতিতে কর্পূরের মত বিলীন হয়; শুধুমাত্র আত্মার বা প্রাণের নিষ্কলঙ্ক অনুরণন জনিত আকুতিতেই অর্থহীন বলে খ্যাত অমূল্য সমূহ সত্যিকার রূপে ধরা দেয় ও স্থায়ীভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে। সময় সংবিত্তি বা সময় উপলব্ধি এবং সময়ের উন্মাদনা অনর্থ বিবেচ্য হলে, তার চেয়ে বড় পরিতাপ আর কিছু নেই। অগ্রসরমান সময়ের একটি ধাপের সাথে দেহ-মন-আত্মার সংম্পৃক্ততার রূপ অন্য ধাপের সংম্পৃক্ততার রূপ থেকে ভিন্ন এবং রংগুলিও ভিন্ন; ফলে, যথাসময়ে আত্মার পট বা ক্যানভাসে উপযুক্ত রংয়ের ছোঁয়ায় ছবিটি সম্পন্ন না করলে, ছবিটি আজীবন অসমাপ্তই রয়ে যাবে। এভাবে প্রতিটি বা অনেকগুলি পট অসমাপ্ত থাকলে, দেহঘরের মনিকোঠাটি বর্ণহীন বা অসংজ্ঞায়িত থেকে যায়।
শৈশবের রং ও বাসনা, কৈশোরে বা যৌবনে বা বার্ধক্যে ভিন্ন বা অনুপস্থিত। সময়ের এই চাহিদা আত্মতুষ্টি ও স্বাধীনতাবোধে পরিপূর্ণ হলে কতটুকু বা কোথায় ক্ষতি, তা সচেতন মানুষটি লাভ-ক্ষতির পাল্লায় বিচারপূর্বক অর্থহীন বিশেষন দিলেও, তা যে কতটা অনর্থ বহন করে, সেটি আত্মার সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষটি সহজেই বুঝতে পারে। একই ভাবে, বন্ধুত্বের প্রশ্রয় দানে অযথা সময় যাপন এবং প্রাকৃতিক সংস্পৃষ্টতা লাভে উদার ও স্বত:স্ফূর্ত সাড়া যেন স্বয়ম্ভূ আত্মাটিকেই জাগ্রত রাখে। সচেতন বৈষয়িক চেতনায় অমূল্যকে অর্থহীন বলে কলঙ্কিত করলে, অমূল্য অভাবে যে কলঙ্কের দাগ পড়ে, সেগুলিকে বিষয়ভিত্তিক সাবান দিয়ে সহস্র বার ঘষাঘষি করলেও দূর করা সম্ভব না।
চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপ স্বতন্ত্র এবং উপজাতগুলি পরবর্তী ধাপের সঞ্চালক বা উপাদান। ‘করতে থাকুন বহমান হয়েই’- ইংরেজীতে এ ধারাটিকে বলে, ‘ ডু এজ ইউ গো’ এবং এটিই স্বত:সিদ্ধ ধারা; একবারে সবটুকু হাসিল করা অসম্ভব; যেমনি, ঘুমন্ত থেকে নৌকাভ্রমণে গন্তব্যে পৌঁছে, ফেলে আসা নদী ও নদীকূলের সৌন্দর্যভোগ পুনরুদ্ধার অসম্ভব।
দীন মোহাম্মদ মনির
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।