অন্তহীন মেঠো পথে(পর্ব ২) -অনীলা পারভীন

  
    

আগের পর্বের পর:
২০০০ সালের মে মাস।  তীব্র গরমের এক দুপুরে , আমরা গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ার দিকে রওনা দিলাম। গাবতলী থেকে বাসে উঠলাম। সাথে সিনিয়র কলিগ নাসরিন আপা, সহকর্মী নিরো আর সাজ্জাদ। লোকাল বাসে চড়ে ঢাকার বাইরে যাবার সেটাই প্রথম অভিজ্ঞতা।
গরমে দর্ দর্ করে ঘামছি। গেট লক্, গেট লক্ বলে গলা ফাটিয়ে, যে বাসে আমাদের তোলা হলো, সেটা যে প্রতি পনের/বিশ মিনিট পর পর গেট ওপেন আর লক্ হয়, তা তো জানা ছিলোনা। মুরগী, বস্তা, তেলের টিন, যাবতীয় জিনিস নিয়ে লোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠছে, নামছে। কোনো সিট না থাকায়, কিছু মানুষ মাঝের আইলে বসে পড়লো। মানুষের চাঁপে নাভিশ্বাস অবস্থা। হেলতে দুলতে বাস ফেরীতে উঠলো। জীবনে প্রথম পদ্মা নদী দেখলাম। কত গল্পে পড়েছি, গান শুনেছি! সেদিন নিজ চোখে দেখলাম। এত গরম, চাঁপাচাপি, তবুও পদ্মার সৌন্দর্যে সব কষ্ট মলিন হয়ে গেল।

নদী পার হয়েই, বাস একটি বাজারের মধ্যে থামিয়ে, ড্রাইভার কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। কী মসিবত! গরমে এমনিতেই সবাই অতিষ্ঠ, তার উপর আবার এটা কোন যন্ত্রনা? আমার আর নাসরিন আপার সিট বরাবর বসেছিল এক বাপ-ছেলে। তাদের সামনে সিটে নিরোরা বসেছে। বাপ-বেটা দুইজনে বাস ছাড়ার পর হতে খেয়েই চলেছে। আমড়া, কামরাঙ্গা, আচাঁর, ঝাল মুড়ি। মনে হচ্ছে আজই তাদের সব খেয়ে ফেলতে হবে। বাস যখন থামলো, তখন দেখি সেই লোক তাড়াহুড়া করে নেমে গেলেন। ভাবলাম বাথরুমে যাবেন, যে খাওয়া খেয়েছে। না, দেখি ছেলের জন্য আইসক্রীম নিয়ে এসেছেন। ছেলের নাকি কেমন কেমন লাগছে। তা তো লাগবেই, এত উল্টাপাল্টা খেলে খারাপ লাগারই কথা। আইসক্রীম মুখে দিতে না দিতেই, ছেলেটি ফিনকি দিয়ে বমি শুরু করলো। সেই বমি নিরোর মাথা ছুঁয়ে সাজ্জাদের গালে, ছপাৎ।!
ওরে আল্লাহ্, রক্ষা করো। সাজ্জাদ রাগবে, না কাঁদবে, বুঝে উঠতে পারলো না। সেই বাবা তার ছেলে নিয়েই ব্যস্ত। ছেলের বমি কোথায় গেল, না থাকলো তা দেখার সময় কি আর আছে? আহা! সাজ্জাদের চেহারাটা দেখে খুব মায়া লাগছিল।

কোটালিপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্তিতে কোন রকমে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু ঘুম তো আর আসেনা। লাইট বন্ধ করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে ঝিঝি পোকার তীক্ষ্ণ শব্দ। যদিও নাসরিন আপা পাশে আছেন, তবুও কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। নাসরিন আপা আমার মতই নিশাচড় প্রাণী হওয়াতে, দুজনে গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমরা প্রতিটা উপজেলার দুইটা করে গ্রাম বাছাই করেছিলাম। একটা সদরের কাছাকাছি গ্রাম, আরেকটি দূরের গ্রাম। আমরা প্রথমদিন দূরের গ্রামটাতে যাবো বলে ঠিক করলাম।
গ্রামের নাম বাহিরশিমুল। কী সুন্দর নাম! মনে হয় কোনো কাব্যরসিক লোক এই নাম রেখেছিলেন। কিন্তু কিভাবে যাওয়া হবে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল প্রথমে বাসে যেতে হবে। এরপর ভ্যানে। আমরা চারজন আল্লাহর নামে রওনা দিলাম। সাথে নিলাম বড় বোতল ভর্তি ডাবের পানি, কিছু শুকনা খাবার আর ছাতা। বাসে আধা ঘন্টা পথ গেলাম। এরপর একটা ভ্যানে করে রওনা দিলাম। ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষন লাগবে পৌছাতে? বললো, আধা ঘন্টা। ওহ্, আধা ঘন্টা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু এরপর যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পথ আর ফুরায় না। ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি, আর কত দূর।
‘এই তো আপা চলে এসেছি। ’
এভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক পর, ভ্যানওয়ালা আমাদেরকে একটা নদীর কাছে নামিয়ে দিলেন। এখন এই নদী পার হয়ে যেতে হবে। নদীর ঘাটে কোন নৌকা নাই। আমরা তো চিন্তায় পরে গেলাম। ফিরেই না যেতে হয়। দৈবক্রমে একটা নৌকার দেখা পাওয়া গেল। নৌকায় উঠার পর আমরা খেয়াল করলাম মাঝির একটা পা নেই। আমরা তার সাথে কথা বলে তার জীবনের গল্পটা শুনে নিলাম। জন্মগতভাবেই সে পঙ্গু। অন্য কোনো কাজ করতে পারেনা বলে নৌকা চালানোটা শিখে নিয়েছে। নাম মাত্র আয়। কখনও দিনে ৩০টাকা, কখনও তারও কম। ৫০টাকা আয় হলে সেদিন নাকি নিজেকে বড়লোক বড়লোক মনে হয়। এই নদীর সে-ই একমাত্র মাঝি। সেজন্য তাকে বেশ গর্বিতও মনে হলো। বাহিরশিমুলে আমাদের নামিয়ে দিয়ে মাঝি জানালো বিকেল ৫টার পর সে নৌকা চালায় না। সুতরাং তার আগেই আমাদেরকে ফিরতে হবে।

গ্রামটা দেখার মত কিছু না। মানুষগুলি বেশ গরীব বোঝা যায়। বাড়ী বাড়ী ঘুরে আমরা লোকজনের সাথে কথা বলি। তাদের জীবনের কাহিনী সংগ্রহ করি। মূল পেশা চাষাবাদ। শুকনার মৌসুমে পুরুষরা শহরে যায় কাজ করতে। মূলত: ছাতা সেলাইয়ের কাজ করে তারা। বছরের প্রায় ছয় মাস পুরুষবিহীন থাকে গ্রামটা। তাই গ্রামের মহিলাদেরকে বিভিন্ন রকম বিপদ থেকে রক্ষা করে, তাদের বেঁচে থাকতে হয়। একটা পর্যায়ে আমাদের সবার কাছে খাবার পানি ফুরিয়ে গেল। আমার খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। একটা বাড়ীতে এক মহিলার কাছে পানি চাইলাম। মহিলা পানি দিতে আপত্তি জানালেন। আমি তো অবাক,
‘পানি দেবেন না কেন?’
‘আপা, আমাদের পানিতে আর্সেনিক ভরা। আপনারে এটা দিতে পারবো না। ’
‘গ্রামের কোনো বাড়ী নেই যেখানে ডিপ টিউবওয়েল আছে?’
‘না, নাই। ’
শুনে হতাশ হলাম, কষ্টও পেলাম। মানুষগুলি জেনে শুনে এই পানি খাচ্ছে। মনটা মমতায় ভরে গেল এটা ভেবে যে, এরপরও মহিলাটা আমাকে সেই পানি খেতে দিতে চাচ্ছে না। কতখানি মানবতাবোধ তার মধ্যে! আমি বললাম-
‘আপনারা এপানি খেয়ে যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে আমিও বেঁচে থাকবো। ’
বড় এক গ্লাস ভর্তি পানি আমি খেয়ে ফেললাম। বাহিরশিমুল নামটা যত সুন্দর, সেই গ্রামের মানুষগুলি তেমনই সুন্দর। কিন্তু তাদের জীবন তত সুন্দর নয়, বরং অনেক বেশী দারিদ্রতায় ভরা।
পরেরদিন গেলাম কাছের গ্রামটিতে, নাম উনোশিয়া। ছায়া সুনিবিড় মেঠো পথে, খৃষ্টান প্রধান গ্রাম। কিন্তু দারিদ্রে ঠাসা, কষ্ট তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রথম যে বাড়িটিতে গেলাম তা একটি ভাঙ্গাচোরা ঘর। কোন রকমে পাটখড়ি দিয়ে বানানো। বাড়ির সদস্য একজন মহিলা, তার তিনজন ছেলেমেয়ে আর স্বামী। স্বামী বদলা খাটার কাজে বেরিয়েছে। মহিলা আমাদের সাথে কথা বলায় বেশী আগ্রহী না। তার বাচ্চাটা মাটিতে বসে অঝোরে কাঁদছে। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চাটা কেন কাঁদছে কেন? বললো,
‘মাইর দিসি?’
‘কেনো?’
জানলাম মেরেছে কারন, বাচ্চাটা খেতে চাচ্ছে কিন্তু ঘরে খাবার নেই। কি খেতে দিবে? শুনে আমরা চুপ হয়ে গেলাম। আমাদের কাছে বিস্কুট, চিপস্ যা ছিলো বাচ্চাটাকে দিয়ে দিলাম। মহিলাকে আর বিরক্ত না করে আমরা অন্য বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

এবার আমরা একেকজন একেকটি বাড়ি ঠিক করে বিভক্ত হয়ে গেলাম। আমার ভাগে যে বাসাটা পড়লো, সেখানে ঢুকলাম। দেখলাম বাড়ির মহিলা বেশ আন্তরিক। তার সাথে অনেক কথা হলো। মহিলার কথা শুনে জানা গেল অবস্থাপন্ন ঘরে বড় হয়েছেন।  তার চার বাচ্চা, অভাবের তাড়নায় দুইটা বাচ্চাকেই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখানে মামাদের কাছে থাকে, কাজ করে। তাতে খেতে পায়। ফেরার সময় মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আবার কবে আসবো। এবার আমাকে সে কিছুই দিতে পারলেন না। পরেরবার এলে নাকি কিছু না কিছু দিবেন। শুনে আমি অবাকও হ্লাম, আবেগ আপ্লুতও হয়ে গেলাম। মহিলাকে জড়িয়ে ধরলাম। যদিও আমি জানতাম না, আমার আদৌ আর যাওয়া হবে কিনা, তবুও বললাম,
‘আবার আসবো। ’
আমরা জেনেছিলাম এই গ্রামে বিখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি। ফেরার পথে বাড়িটা দেখার জন্য গেলাম। ওটাকে বাড়ি না বলে জড়াজীর্ণ কুঠির বলা ভালো। দেখলাম ওখানে একটি পরিবার বাস করছে। আমরা বাসাটা দেখতে চাই বলাতেই, তারা প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো আমরা সরকারী লোক কিনা। যখন শুনলো সরকারী লোক না, তখন আর কিছুতেই আমাদের ভেতরে যেতে দিলো না। পরে জেনেছিলাম তারা অবৈধ্যভাবে ওখানে থাকছে। তাই সারাক্ষন ভয়ে থাকে কখন তাদের উচ্ছেদ করা হয়। আহারে সুকান্ত! হায়রে আমাদের বিপ্লবী কবি!
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী সত্যিই গদ্যময়…’
প্রায় ছয় মাস পর যখন আমাদের Field workএর প্রাথমিক পর্ব শেষ হলো, তখন ঠিক হলো দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে, ইকবাল ভাই আমাদের সবাইকে নিয়ে একটা জায়গা visit করবেন। সবগুলির মধ্যে বাছাই করা হলো উনোশিয়া গ্রামকে। আমি মনে মনে খুবই খুশী হয়ে উঠলাম, সেই মহিলার সাথে দেখা হবে এই ভেবে। যথারীতি আমরা উনোশিয়া গ্রামে গেলাম। ইকবাল ভাই আমাকেই বললেন, কোন বাড়িটাতে আমি গিয়েছিলাম সেখানে নিয়ে যেতে। সম্ভবত উনি আমার কাজের ধরণ বুঝতে চাচ্ছিলেন। আমরা যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি দুইটা বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দৌড়ে আমার কাছে এসে বলে, তাদের মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি চিনতে পারলাম, তারা সেই মহিলার সন্তানরা। ইকবাল ভাই বেশ অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, তাতে আমি মুগ্ধতাই দেখতে পেলাম।


আমরা আরও কিছুদূর যাবার পর দেখি, মহিলা অনেকখানি এগিয়ে এসে পথের ধারে দাড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, উনি শুনতে পেয়েছেন ঢাকা থেকে একটা দল এসেছে। সেটা শুনেই নাকি বুঝেছেন আমি এসেছি। আমরা তার বাসায় গেলাম। তার সাথে ইকবাল ভাই কথা বললেন। কথা শেষে মহিলাটি আমাকে আস্তে করে বললেন, আমি যেন তার সাথে একটু ঘরের ভেতরে যাই। ইকবাল ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে গেলাম। সে আমাকে তার চকিতে বসালো। পানি আর মুড়ি খাওয়াল। এরপর একটা হাড়ির ভেতর থেকে দুইটা আতা ফল বের করে দিল তার গাছের ফল, গতকালই পেরেছে। সে বললো,
‘মনে হয় আপনার জন্যই রেখে দিছিলাম। ’
আমার চোখ দু’টা ছল্ ছল্ করে উঠলো। আমি তাকে ১০০টাকা সাধলাম। সে কিছুতেই নেবেনা। বলে, টাকার জন্য আমাকে দেয়নি। শেষে বললাম,
-আমার ভাগ্নে, ভাগ্নিকে কি আমি কিছু দিতে পারি না?
এটা বলাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
আমরা ফিরে এলাম। আর কোনদিন ওখানে যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই মহিলা আমার মনের মধ্যে রয়ে গেলেন সারাজীবনের জন্য। ইচ্ছে করে আবার গিয়ে দেখে আসি, কেমন আছে সে?
এরপরের গন্তব্য নির্ধারিত হলো খুলনার রামপাল।
শুনে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  রামপাল !

(চলবে)

অনীলা পারভীন: কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments