দ্বিতীয় পর্বের পর:
প্রশিকাতে গবেষক পদে আছি আমরা বেশ কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে। গবেষণার কাজে আমাদেরকে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়। এবারের গন্তব্য রামপাল, সুন্দরবনের কাছাকাছি একটি উপজেলা।
রামপাল যাবার কথা শুনে, আমাদের পিলে চমকে উঠল। কারণ, এর আগে যে দলটি রামপাল থেকে ঘুরে এসেছিল, তারা প্রায় প্রত্যেকে অসুস্থ হয়ে ফিরেছিল। যার মূল কারণ ছিল পানি। ওখানকার পানি খেয়ে অনেকেরই পেটে অসুখ হয়েছিল। এছাড়া রামপাল নিয়ে আরেকটা বড় ভয়ের কারণ ছিল, তা হলো, ২০০০সালে নির্বাচনের পর রামপালে বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছিল। ওখানকার সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয়েছিল। আমরাও ঠিক সেই সময়টাতেই রামপাল যাচ্ছিলাম। তাই রামপালের নাম শুনে আমরা একটু ভড়কে গেলাম। কি আর করা! যেতে তো হবেই দেখা যাক্ কি হয়। আমরা যত বেশী পারলাম খাবার পানি সাথে নিয়ে রামপালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমার সহযাত্রী মেই, নিরো, তপন আর জুবায়ের ভাই।
যথারীতি প্রশিকার ADCতে (Area Development Centre) উঠলাম। প্রত্যেকটা ADCতে একজন রান্নার বুয়া নিযুক্ত আছেন। যাদেরকে আমরা খালা ডাকতাম। এখানকার খালার রান্নার প্রশংসা আমরা আগেই শুনে এসেছি। প্রথম দিন রুই মাছের তরকারি খেয়ে আমরা সব ফিদা। পানি যেমনই হোক খাবার খেয়ে মজা পাবো, সেটা ভেবেই আমরা খুশী।
প্রথমদিন গেলাম দূরের গ্রামটিতে, নাম কাকঁড়াবুনিয়া। এমন নামকরণের কারণ হলো, ওখানকার লোকেদের প্রধান পেশা কাকঁড়া চাষ। কুমারখালী নদীর উপর দিয়ে, ট্রলারে করে গ্রামটিতে যেতে হয়। যাবার পথটা অদ্ভুত সুন্দর। নদীর দুপাশে গোলপাতা গাছ আর শ্বাসমূলে ভরা। যেন সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। ট্রলারটি আমাদেরকে গ্রামে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিকেলে এসে আবার নিয়ে যাবে। আমরা গ্রামের মেম্বার বা চেয়ারম্যানের বাসায় বসলাম। সারাদিন FGD (Focus group Discussion) শেষ করে যখন বের হলাম, দেখি পুরো গ্রাম পানিতে থৈ থৈ করছে, যেন বন্যা হয়েছে। আমরা তো হতবাক! এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি নৌকায় যেতে হবে এমন পানি। ব্যাপার কি? না বৃষ্টি না বাদল, তাহলে পানি এলো কোথা থেকে? জানলাম, এমনি হয় প্রতিদিন। সকালে ভাটায় গ্রামটা শুকনা থাকে আর বিকেলে জোয়ারে পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। কী অদ্ভুত!!! প্রকৃতির কী বিচিত্র রূপ!
পরেরদিনও আমরা ওই গ্রামেই গেলাম। এবার হত দরিদ্র পরিবারগুলির সাথে আলাপ হলো। প্রত্যেকের জীবন বিষাদময় দারিদ্রে ভরা। কেউ কাকঁড়া/চিংড়ির ঘেরে বর্গা খাটে, তো কেউ দিনমজুরের কাজ করে। ঘেরে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই মারা যায়। কারণ ঘের নিয়ে প্রচুর রাজনীতি চলে। প্রায়ই মারামারি হয়, বেশীর ভাগ সময় মারা পরে নিরীহ মানুষগুলো। এমন নি:স্ব হয়ে যাওয়া কিছু পরিবারের সাথে কথা হলো। কোনো পুরুষ সেসব পরিবারে বেঁচে নেই। কেমন অসহায় বাড়ীর মহিলাগুলো! ককেকজনের বাড়িঘর না থাকার মত। একজনের বাড়ি বলতে শুধুমাত্র চারটা খুঁটির একটা ঘর, যার না আছে দরজা, না আছে জানালা। ঘুমানোর সময় ছালা দিয়ে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করে। আরেকটা পরিবারের সাথে কথা হলো, যারা সেদিন সারাদিন না খেয়ে আছে। শেষ খাবার খেয়েছিল আগেরদিন সন্ধ্যায়। বাড়ীর মহিলাটি তার মেয়েটার জন্য আমাদের কাছে জামা কাপড় চাইলো। কেঁদে কেঁদে বললো, মেয়ে বড় হচ্ছে কিন্তু মেয়ের সম্ভ্রম মা হয়ে রক্ষা করতে পারছেনা। আমি কথাটি শুনে কষ্টে মহিলার চোখের দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না। আমাদের সাথে দেবার মত কিছু ছিলো না। হায়রে নিঠুর বাস্তবতা!
ফেরার পথে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সারাদিনের ক্লান্তি আর বিষন্নতায় ট্রলারে আমরা চুপ করে বসে ছিলাম। হঠাৎ পূব আকাশে উদিত হলো বিশাল এক চাঁদ। প্রকৃতির সেই অপার সৌন্দর্য্যের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। নির্জন সন্ধ্যায় বৈঠার মৃদু শব্দ, বাকী সব সুনসান। পূর্ণিমার চাঁদ তার কোমল আলোর পরশে, আমাদের মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিল, পরম মমতায়। আমরা এক মনে চাঁদের সেই রূপ উপভোগ করলাম। মনে হচ্ছিল ট্রলার যেন থেমে না যায়, এমনি চলতেই থাকে, অনন্তকাল।
কাছের গ্রামটির নাম, তালবুনিয়া। ওখানে কিছু তালগাছ দেখেছি। কিন্তু সেজন্য এই নাম কিনা তা জানতে পারিনি। সেখানে আমরা যেতে পারছিলাম না। রাজনীতির কালো হাত ওই গ্রামটিকে খুব ভালভাবেই গ্রাস করে রেখেছিল। যেজন্য নিরাপত্তার কারনে আমাদেরকে যেতে দেয়া হচ্ছিল না। আমরা একটা দিন কর্মহীন কাটালাম। সেদিন আমরা চিংড়ির ঘেরে গেলাম। অদ্ভুত সে অভিজ্ঞতা। জমি ভরা চিংড়ি মাছ নেঁচে নেঁচে বেড়াচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সাইজের চিংড়ি আর ছোট ছোট কয়েকটি কাঁকড়া কিনে নিয়ে এলাম। মেই নিজে হাতে রান্না করলো। রান্নার সময়েই এমন মজার সুগন্ধ বের হচ্ছিল যে, বলার অপেক্ষা রাখে না খাবার কেমন সুস্বাদু ছিল।
পরেরদিন গেলাম তালবুনিয়াতে। কিন্তু কোনো বাড়ীর মানুষ কথা বলতে চায়না। এক বাড়ী গেলাম বাড়ীর সেই মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে, কোনো খোঁজ নাই। আরেক বাড়ীর ছেলেকে মেরে ফেলেছে। বাকী দুই ছেলেকে এর মধ্যেই ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে। এক একটা ঘটনা শুনি আর চমকে উঠি। কষ্টে বুক ভেঙ্গে যায়। কেমন থমথমে, গা ছমছম করা সেই অভিজ্ঞতা। আমরা দুই একটা বাসায় যাও গেলাম, সেটাও দরজা বন্ধ করে ফিসফিস করে কথা বললাম। তেমন কোন কাজ আসলে হলো না। রাতে ফিরে সবাই মন ভার করে ঘুমাতে গেলাম।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এমন গুলির শব্দ প্রায়ই শুনতাম। কিন্তু এযেন রীতিমত যুদ্ধ হচ্ছে। ভয়ে সারারাত হীম হয়ে রইলাম। ঘুম হলো না একটুও। সকালে উঠে জানতে পারলাম, গোলাগুলি হয়েছে চিংড়ির ঘেরের দখল-বেদখল নিয়ে। এটা নাকি নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা।
যেজন্যই হোক এবার এখান থেকে জান নিয়ে বাড়ী ফিরতে পারলে বাঁচি। বাসের টিকেট করতে গিয়ে জানা গেল, পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। কবে ভাঙ্গবে কেউ জানেনা। হায়রে! এতো দেখি মরার উপর খারার ঘাঁ। কিছুই করার নেই। আমাদের খাবার পানিও ফুরিয়ে এসেছে। পানি দূর থেকে কিনে আনতে হলো। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলোনা। এরই মধ্যে আমাদের দুই সহকর্মী ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হলেন। আমার কাছে প্রচুর খাবার স্যালাইন ছিলো। সব একদিনেই শেষ হয়ে গেল। কারণ তারা অবস্থা দফারফা।
বহু কষ্টে পরেরদিন একটা প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া করা হলো, আমাদের খুলনা পর্যন্ত দিয়ে আসবে। গাড়ীর চেহারা দেখে হতাশ হতেও ভুলে গেলাম। গাড়ির চেহারা বলে, গাড়ি চালু হবে না। আর চালু হলেও থামবে কিনা সন্দেহ। তবুও আল্লাহর নামে রওনা দিলাম। দু:চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমি আর মেই সারারাস্তা হেরে গলায় গান গাইতে গাইতে এলাম। রাত ৮টায় খুলনা পৌছে, রাত ১১টার বাস ধরে পরের দিন দুপুরে ঢাকা।
আহ্! ওম্ শান্তি ওম্!
কিন্তু ঢাকায় পৌছেই টের পেলাম, আমার মুখ ও সমস্ত শরীর চাকা চাকা Allergyতে ভরে গেছে। আমার মা এই চেহারা দেখে প্রায় জ্ঞান হারালেন। মা তো জানেন না কোন মসিবত পার করে এসেছি। সেই Allergy সারতে প্রায় ১৫/১৬দিন সময় লেগেছিল। তাতে কি? অফিসে ফিরেই জানতে পারলাম পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হয়ে গেছে। কোনো নিস্তার নেই। আমরাও কি ভয় পাই নাকি?
“এখন যৌবন যার,
যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”
…চললাম পুঠিয়া, রাজশাহী…
(চলবে)
অনীলা পারভীন: কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।