অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে-সাদাত হোসাইন

  
    

রকমারির সামগ্রিক বেস্ট সেলার বই বিক্রির তালিকায় কেন অমুক তমুক বই এসেছে, কেন বিশেষ বিশেষ বই আসেনি, এই নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্কে আমি একটা অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর পেলাম না, আচ্ছা, এই দায় কী রকমারি ডট কম নামের একটি প্রতিষ্ঠানের? কিংবা  দায়টা কার?
একটু বলি, রকমারি স্রেফ একটা বই বিপণনকারী ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।  তাদের মূল কাজ বেশি বেশি বই বিক্রি করা। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ভাবনা এবং সেটি কার্যকর করা অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিলো। দেশে রকমারিই প্রথম ক্যাশ অন ডেলিভারির ভিত্তিতে বই বিক্রি শুরু করে। অর্থাৎ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠকের কাছে স্রেফ অর্ডারের ভিত্তিতে বই পৌঁছে দিচ্ছে রকমারি।বই হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করছে পাঠক। একটি অনভ্যস্ত ক্রেতার দেশে এতে বিরাট ব্যবসায়ীক ঝুঁকি ছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের কন্টেক্সটে এই ঝুঁকিটি রকমারি নেয়। কিন্তু এমন একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে যে পরিমাণ লোকবল, অর্থ দরকার হয়, তা সত্যিই বিপুল। অনলাইনে শুধু বই সরবরাহ করে রকমারির পক্ষে লাভতো দূরের কথা এই খরচ উঠানোই সম্ভব না। কারণ একটা ১০০ টাকার বইতে তাদের কম-বেশি প্রফিট থাকে ১৫ টাকা। অথচ বাংলাদেশে পাঠকদের বই পড়ার প্রতি ক্রমশই অনাগ্রহ,  অনলাইনে বই কেনার অপরিচিত ব্যবস্থা ও অনভ্যস্ততার মতো সময়ে তারা এই ঝুঁকিটি নেয়। ফলে বাইরে থেকে রকমারির রমরমা বিজনেস পরিলক্ষিত হলেও তাদের ব্রেক ইভেনে যেতেও লেগে যায় বছরের পর বছর। এখনো পুরোপুরি যেতে পেরেছে কিনা আমি নিশ্চিত নই, প্রফিটেবল হয়ে ওঠাতো বহুদূরের কথা!
কিন্তু বছরের পর বছর লোকসান গোনা সত্বেও তারা ব্যবসাটি চালিয়ে যায় এই ভেবে যে একটা সময় মানুষ আবার বই পড়বে এবং  অনলাইনে বই কেনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এটি একটা বিপ্লবের মতোই। একদমই অপরিচিত, অনভ্যস্ত একটা জাতিকে অনলাইনে বই কেনাতে অভ্যস্ত করে তুলেছে রকমারি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বই কারা কিনছে? কোন পাঠক? কি বই কিনছে?
সেটির দায় কি রকমারির?

তর্ক বা আলোচনার সুবিধার্থে ধরুন,
আপনার দোকানে যদি দুধ, মদ, ফল, সিগারেট বিক্রি হয় (আমি এমন দেশের প্রেক্ষিতে উদাহরণ দিচ্ছি, যেখানে মদ খাওয়া বা প্রচারণা নিষিদ্ধ নয়) এবং মানুষ দুধের চেয়ে মদ বেশি খায়, তাহলে আপনি কি দোকানীকে ব্লেম করবেন? দোকানীর কাজ কিন্তু বিজনেস। আপনি ব্লেম করবেন হয় যারা ক্রেতা তাদের, অথবা যারা দুধ বিক্রি করছে তাদের। কারণ, তারা ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে দুধ আর মদের ফারাক বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা দোকানী কেন মদ বিক্রি করছে, এই চিৎকার  করলেতো হবেনা! (কারণ সেখানে সেটি নিষিদ্ধ কোন বস্তু নয়)। এখন মাস শেষে যদি দেখা যায় ২ কেজি দুধের বিপরীতে ১০ লিটার মদ বিক্রি হয়েছে, তাহলে দোকানী তো মদকেই বেস্ট সেলার বলবেন। যেহেতু সেই দেশে মদ বিক্রয় নিষিদ্ধ কোন বস্তু নয়।

বাংলাদেশের তরুণরা কেন সাহিত্য পড়ছেনা? তারা যদি তথাকথিত ‘হাবিজাবি’ বই পড়ে, তার দায় কাদের? শুধুই তরুণদের? সাহিত্যিকদের দায় নেই? তারা সারাক্ষণ গালভরা বড় বড় বুলি আওড়াবেন। নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করবেন, ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াবেন, তরুণ প্রজন্মের রুচি চিন্তা নিয়ে নাক সিটকাবেন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন, নিজেদের অভিজাত চিন্তা ও ভাবনার দন্ডমুণ্ডের কর্তা ভেবে একটা হায়ারার্কি তৈরি করবেন, তো তাদের কাছে তরুণ পাঠকরা কেন যাবে?

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের ‘বেশিরভাগের’ চিন্তাই অগভীর ‘, রুচি ‘মানসম্মত ‘ নয়, তো এটি হলে তার দায় কার?
কেন একজন লেখক (সাহিত্যিক অর্থে) তার লেখা বা সাহিত্য দিয়ে এই তরুণ প্রজন্মের বিস্তৃত অংশের কাছে পৌছাতে পারছেন না?
তাদের আইকন হয়ে উঠতে পারছেন না? আপনি যদি কাউকে স্পর্শ করতে না পারেন, তবে সেই দোষ কী তার? না আপনার ব্যর্থতা?

এটি সাহিত্যিকদের বুঝতে হবে। সময় বদলেছে, মানুষের মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর একটা বড় কারণ প্রযৌক্তিক মুহুর্মুহু উৎকর্ষতা, যা সকল পরিসরে জনমানুষের বিশেষ করে তরুণদের আচরণে, চিন্তায় ম্যাসিভ এবং ফ্রিকুয়েন্ট পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে, অস্থির করে তুলেছে। এই বাস্তবতাটা আপনাকে বুঝতে হবে। শুধু শুধু তাদের গায়ে দায় চাপালেই সমস্যার সমাধান হবে না। আগ তরুণদের সামনে বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম ছিল একটি, ব্ল্যাক এন্ড  হোয়াইট টিভিতে  শুক্রবার একটা বাংলা সিনেমা, আর বই। এছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু এখন? অসংখ্য বিকল্প বিনোদন। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিভিতে হাজার চ্যানেল, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট,  হাজার হাজার বিষয়। এই সময় তরুণদের ‘সত্যিকারের সাহিত্যের’ কাছে ফিরিয়ে আনা আর পঞ্চাশ একশ বছর আগের তরুণদের বাস্তবতা কী এক?
এক না।
এই সামান্য বাস্তবতা টুকু যারা না বুঝে কেন তরুণরা সাহিত্যের বই পড়ছেনা, কেন রকমারি বেস্ট সেলারে ‘সৃজনশীল সাহিত্য’ নেই, এরূপ ঢালাও, চিন্তাহীন অভিযোগ করে চলেছেন, আমার মতে তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

তাদের আগে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি ধরতে,  বুঝতে পারতে হবে। মনে রাখতে হবে এই তরুণরাই আগামীদিনের ভবিষ্যত। সুতরাং তাদের গালিগালাজ করা, উপেক্ষা করা, নাক সিটকানো, অভিযোগ করা কিংবা স্রেফ নাকচ করে দেয়া এর সমাধান নয়।

সমাধান নয় রকমারির কাঁধে দোষ চাপানোও। রকমারি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, তারা রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে চলেনা। বই বিক্রি করে তাদের টিকে থাকতে হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সেই বইয়ের প্রতি মনোযোগী হবে, যেগুলো পাঠক চাহিদার শীর্ষে। সেগুলোই তারা প্রমোটও করবে। কারণ বই বিক্রি করেই তাদের টিকে থাকতে হবে। সত্যিকারে সাহিত্য নিয়ে পাঠকের আগ্রহ না থাকলে সেটি তৈরি করার দায়িত্ব রকমারির নয়। এর দায় আপনি যিনি অভিযোগে গলা ফাঠাচ্ছেন তার, আপনি যিনি সাহিত্য রচনা করছেন তার, কারণ আপনি মহান সাহিত্য রচনা করে ফেলেছেন ভেবেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাত ঘুম দিয়ে সবাই আপনার বই কিনে পড়ে হাততালি দেবে বলে দিবাস্বপ্নে বিভোর, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছেনা বলে ক্ষিপ্ত হয়ে অভিযোগের তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। কিন্তু আপনি একবারও নিজের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে দেখেছেন, যে কেন পাঠক আপনার বই না পড়ে মোটিভেশনাল স্পিকারদের বই পড়ছে? এখানে পাঠকের কাছে না পৌছাতে পারার আপনার অক্ষমতা, অসামর্থ্যতা আসলে কী? তরুণ প্রজন্মের বিশাল পাঠকশ্রেণীর সাথে আপনার চিন্তার গ্যাপটা কোথায়? কেন তারা আর আপনি যদি মনেই করেন যে ধ্রুপদী সাহিত্যের নির্যাস, মূল্য অনুধাবন করতে পাঠকের যুগের পর যুগ লেগে যায়, এবং আপনি যেহেতু সেই ধ্রুপদী সাহিত্যই রচনা করেছেন, তাহলে এখন পাঠক কে কার বই কিনছে, রকমারিতে কার কোন বই বেস্ট সেলার হচ্ছে এটি নিয়ে আপনার এতো হাপিত্যেশ কেন?

কেবল রকমারি তাকেই বেস্ট সেলার করবে, যার বই বেশি বিক্রি হয়। এটা এতোটাই সিম্পল ইক্যুয়েশন  যে এটি বুঝতে আপনাকে আমাকে রকেট সায়েন্স শিখতে হবেনা। কিন্তু আমরা যারা এটি নিয়ে চিন্তার ভুল জায়গা থেকে অভিযোগ তুলছি, তাদের অনুধাবন ক্ষমতা আশ্চর্যরকম হতাশাজনক।
আমাদের ভাবা উচিত ছিল, কীভাবে একটি প্রজন্মকে আমরা ধীরে ধীরে সাহিত্যবিমুখ করে তুলেছি, সেই কারণগুলো কী? তাদের সাহিত্যের কাছে ফিরিয়ে আনতে হলে কী করণীয়? নাকি কেবল ফেসবুকে অভিযোগ করেই সাহিত্যের জাত উদ্ধার করা সম্ভব?  অন্যের সীমাবদ্ধতা আইডেন্টিফাই করার আগে আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করছি তাদের আগে নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো আইডেন্টিফাই করা উচিত।
অন্ধ হলেই কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকেনা।
কিন্তু আমরা সেটি না করে কেবল অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি করে ভাবি বাঘ শিকার হয়ে গেছে।

রকমারি পাঠকের রুচি তৈরির দায়িত্ব নেয়নি। এটি কোন সেবামূলক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও নয়। এটি স্রেফ একটি বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যা তাদের ক্রেতা বা ভোক্তার সেবা নিশ্চিত করে। আপনি রকমারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন তখন, যখন তারা আপনার অর্ডারকৃত বইয়ের ডেলিভারিতে বিলম্ব করবে, ঠিকঠাক ডেলিভারি নিবেনা, ছেড়াফাটা বই সরবরাহ করবে, এক বইয়ের বদলে অন্য বই দিয়ে দিবে তখন। কিন্তু তারা কোন বই বিক্রি করবে, কোনটি তাদের বেস্ট সেলার হবে, সেটি আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। তারা সেই বইই বিক্রি করবে যেটি তাদের ক্রেতা চাহিদায় থাকে (যদি সেটি রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ না হয়ে থাকে), তাদের লিস্টে সেই বইই বেস্ট সেলার বই হবে, যেটি পাঠক বা ক্রেতা সবচেয়ে বেশি কিনবে। এটি খুবই সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক হিসেব।

আপনি বরং রাষ্ট্র কে বলতে পারেন এমন কোন বইবিপণনকারী প্রতিষ্ঠান চালু করতে যেটি ‘সৃজনশীল সাহিত্য’, ‘ভালো সাহিত্য’ শুধু সরবরাহ করা হবে, প্রমোট করবে এবং তাদের বেস্ট সেলারে কেবল সেই বইগুলোই থাকবে। ভালো সাহিত্য,উৎকৃষ্ট সাহিত্য, সৃজনশীল সাহিত্য।

এখন ক্রেতার রুচি যদি আপনার কাছে আপত্তিকর মনে হয়, তাহলে সেই রুচি বদলাতে আপনার ভূমিকা কি, সেটি ভাবুন। ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে আদতে লাভ নেই।

সাদাত হোসাইন: নির্মাতা, কথাসাহিত্যিক।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments