দেবী দর্শন-মা অন্নপূর্ণা (দ্বিতীয় পর্ব) – তানিম হায়াত খান রাজিত

  
    

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর সম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবী। সুরসম্রাজ্ঞী অন্নপূর্ণা একসময় সহধর্মিনী ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের। ১৩ অক্টোবর অন্নপূর্ণা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।তাঁকে নিয়ে দেবী দর্শন লেখাটি লিখেছেন তাঁর ভাইপো এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান ও সঙ্গীত শিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমিনের কনিষ্ঠ সন্তান তানিম হায়াত খান রাজিত। অন্নপূর্ণার জীবদ্দশায় এই লেখাটি প্রকাশের বারণ ছিলো। তার অন্তর্ধানের পর পরই রাজিত প্রশান্তিকায় লিখলেন এই মূল্যবান লেখাটি।

এদিকে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে আমার পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষা দিতে গিয়েও মাথায় এক চিন্তা – কি ব্যাপার, চিঠি কি পৌঁছালো না ? এর মাঝে মাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে করতে বিরক্ত করে ফেলেছি, মা আমার কোনো চিঠি এসেছে? স্বভাবতই উত্তর থাকে, না। এরপর এলো সেই দিন! ১৮ ফেব্রয়ারি, পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। আমার ঘরে ঢুকেই দেখি টেবিলের উপরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাম্প লাগানো একটা চিঠির খাম ! সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম, মা, মনে হয় পেয়ে গেছি …খামটা সাবধানে ছিঁড়লাম। চিঠির একবারে শেষে দেখলাম হাতে লেখা ‘তোমাদের পিসিমা ‘, একদম বাংলাতে ! চিঠিটার মূল লেখাটা পুরোটাই ইংলিশে টাইপ করা। আমার মনে হলো স্বপ্ন দেখছি না তো ? কোনোমতে উত্তেজনা আটকে চিঠিটা পড়লাম।

Dear Rajit,
I was pleased to receive your letter. Thank you for remembering me.
Please forgive me for replying you in English …. if I have to sit down to reply to
you in Bengali, it might take a long time for a letter to reach you.
I was touched by your sentiments about me. However, please know that I do not perceive myself as somebody great. I am a humble shishya of Baba. It might interest you to know that I never go out nor do I meet anybody excepting my music students.
You people whom I consider my own, live so far away that maintaining regular contact is difficult…
I will be pleased to meet you during your visit to Mumbai. As soon as your plans are final, please write to me the date on which you will be coming here. Please come to my place at 6.30 PM on that day … thanks.
With respect to my elders and kind regards and best wishes to all of you.
তোমাদের পিসিমা

পিসেমশাই রুশী কুমার পান্ডের সাথে লেখক

এরপরে কেমন করে যে দিনগুলো চলে গেলো জানিনা। অস্থিরতায় দিন কাটছিলো , কারণ তর সইছিলোনা পিসিমার সাথে দেখা করবার, কারণ পিসিমার এই অনুমতি বারবার মিলে না।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের ১০ তারিখ আমরা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম ঢাকা থেকে, সোহাগ পরিবহনের বাসে। সাথে ভারতের সন্তুর শিল্পি পন্ডিত তরুণ ভট্টাচার্য্য, তবলা শিল্পী সুভাষ দত্ত আর নৃত্য শিল্পী ইন্দ্রানী সাহা আর আমার আরেক জ্যাঠাতো ভাই  উস্তাদ কিরীট খান  (মেঝো জ্যাঠা উস্তাদ বাহাদুর খান সাহেবের ছেলে )। বাবা উৎকণ্ঠায় ছিলেন বলে কিরীট দাদাকে বলে দিয়েছিলেন যেন আমাদের কলকাতায় পৌঁছিয়ে মুম্বাইয়ের ট্রেনে উঠিয়ে দেন , কারণ কিরিটীদাও তখন ঢাকায় কনসার্ট শেষ করে শিল্পীদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাচ্ছিলেন। বিস্ময়কর ভাবে পথে তরুণদা বারবার আমাকে নিরাশ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন, বলছিলেন বারবার যেন কষ্ট করে না যাই। কারণ দারোয়ান নাকি সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দিবেনা, কিরীটদাদা শুধু কানে কানে একটা কথাই বললেন আমাকে, আসলে বুঝেছো তো তরুণকে হয়তো ঢুকতে দেয়নি তো তাই এতো হিংসে করছে, আর তুমি তো একেবারে চিঠি পেয়ে বসে আছো …..

আমরা বেনাপোল হয়ে কলকাতা পৌঁছালাম ১১ মার্চ দুপুরে। মেঝো জ্যাঠা বাহাদুর খাঁ সাহেবের বাড়িতে  আস্তানা গাড়লাম আমি আর আমান, চললো বিলাস আর রোজির সাথে আড্ডা। বিলাস আর রোজি বিদ্যুৎ দাদার ছেলে মেয়ে। কিরীট দাদা আর বিদ্যুৎ দাদা হলেন দুই ভাই। রাতে কিরীট দাদা সব প্ল্যান ফাইনাল করে দিলেন, বললেন যে ১২ মার্চ সন্ধ্যায় আমার বোম্বে মেইল ধরবো। সেই মোতাবেক ১১ তারিখ বিশ্রাম নিয়ে ১২ তারিখ আমরা টিকেট কাটতে বের বলাম। কিন্তু ১২ তারিখের কোনো টিকেট পেলাম না ! পেলাম ১৩ তারিখের টিকেট – তাও আবার ওয়েটিং লিস্টে। এবং এই ওয়েটিং লিস্ট থেকে  reservation এ আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবুও চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দুর্ভ্যাগ্য যেন আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল।

পরের দিন  ১৩ মার্চ কিরীট দাদা ভুল করে ভুল প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর কারণে সেই ট্রেন আমরা মিস করলাম। শুরু হলো নতুন ঝামেলা। কিরীট দাদা প্রচন্ড ছুটাছুটি করে স্টেশন মাস্টারকে ধরে অনেক অনুরোধ করে ১৪ তারিখের একটা ব্যবস্থা করলেন। সেদিনের  মতো আমরা বাড়িতে ফিরে গেলাম। কিন্তু এখানেই দুর্ভাগ্যের শেষ নয়, ১৪ তারিখ স্টেশনে গিয়ে জানতে পারলাম ৩ টা ও ২ টার কোনো রিসারভেশন নেই। দুটো টিকিট স্টেশন মাস্টার আমাদের জন্য কোনোমতে আটকে রেখেছেন যার দাম একেকটা ১,২৪০ রুপি। অর্থাৎ দুইজনের ২,৪৮০ রুপি। সমস্ত সঞ্চয়ের অর্ধেক টাকা এখানেই শেষ হয়ে গেলো।দাঁতে দাঁত   চেপে আমি আর আমান টাকাটা দিয়ে দিলাম আর প্রতিজ্ঞা করলাম তবু বোম্বে যাবোই।

১৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৩০ এ বোম্বে মেইলে চড়ে আমাদের শুরু হলো দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টার এক যাত্রা। অর্থাৎ ট্রেনটা পৌঁছাবে ১৬ মার্চ সকাল ৭:৩০ টায়। ভাগ্যদেবী মনে হয় তখনও আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়া শেষ করেননি। দেড় দিন ঠিক মতো চলার পর ট্রেনটা ১৬ মার্চ সকাল ৫:০০ টার সময় মুম্বাইয়ের বাইরে কল্যাণ নামে এক জায়গায় দীর্ঘ ৫ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলো লাইনের ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ায়। আমাদের হাত থেকে মূল্যবান ৫ টি ঘন্টা হুশ করে বেরিয়ে গেলো। অথচ পিসিমার সাথে দেখা করবার যে তারিখ আর সময় দিয়েছিলাম তা হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছিলো।

যাহোক সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে ট্রেনটা বোম্বের ভিক্টোরিয়া টার্মিনালে পৌঁছালো সকাল ৭:৩০ এর পরিবর্তে দুপুর ১:০০ টায়। সেখান থেকে বের হয়ে প্রথমেই আগের থেকে প্ল্যান করা নিউ বেঙ্গল লজে উঠলাম। সেখানে মাল সামান রেখে আমান ঘোষণা দিলো মুভি দেখবে। বোম্বেতে এসেছি বোম্বের সিনেমা হলে মুভি না দেখলে চলে?  আমার মাথায় তো অন্য চিন্তা। আজকেই পিসিমার বাড়িতে আমার যাবার কথা বিকাল ৬:৩০ টার মধ্যে। আমি মুভি তে ঢুকলেও মন বসাতে পারছিলাম না, তাই এক ঘন্টা পরেই ৪:৩০টায় বের হয়ে গেলাম। কারণ আমি সময় থাকতে পিসিমার বাড়ি খুঁজে নিবো যাতে সময় মতো হাজির হতে পারি। একেতো ভিন্ন দেশ, তার উপর হিন্দি বলতে পারিনা। কোনোমতে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম আমাকে ওয়ার্ডেন রোডে নিয়ে যেতে যেখানে পিসিমা থাকেন। সেখানে গিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম পদব্রজে ঠিকানা খুঁজবো বলে। কিছুক্ষন এদিক ওদিক হাঁটার পরেই পেয়ে গেলাম বহু প্রতীক্ষিত ‘আকাশ গঙ্গা’ ! আমার তো দম বন্ধ হবার জোগাড়। স্বপ্ন নাকি সত্যি! সত্যি ‘আকাশগঙ্গা’ নামে কিছু আছে ! হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম বিল্ডিংটা কিছুক্ষন। আস্তে আস্তে হেঁটে রিসেপশনের দিকে গেলাম, কানে বাজছে তরুণদার কথা, দারোয়ান তোমাকে রিসেপশন থেকেই  বিদায় করে দিবে…। রিসেপশনের ভিতরে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা বোর্ডে লেখা সমস্ত বাসিন্দাদের লিস্ট। দ্বিতীয় নাম্বারে দেখলাম লেখা ‘Srimati Annapurna Devi’   ।ঠিক মতো তাকিয়ে দেখলাম – ঠিক দেখছি তো ?  আমি কি সত্যি-ই পিসিমার বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ?

রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো ? আমি চট করে বলে দিলাম , “ম্যায় মিস্টার রুশী কুমার পান্ডে কি সাথে মিলনা চাতা হুঁ..” ঠিক কি ভুল হিন্দি বললাম জানিনা , সেই লোক আমাকে লিফ্ট দেখিয়ে দিলো। আমি লিফটে উঠলাম, কিন্তু এতো নার্ভাস ছিলাম যে এক ফ্লোর আগেই নেমে গেলাম। এক ফ্লোর আগে যে নেমেছি সেটাও বুঝিনি প্রথমে, লিফ্ট থেকে বের হয়ে চারটা দরজার কোনোটাতে পিসিমার নাম দেখতে না পেয়ে আবার লিফটে উঠে লিফটম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম রুশীজির apartment কোন তলায়? লিফটম্যান এবার একেবারে দরজা পর্যন্ত দেখিয়ে চলে গেলো। আমি এসে দাঁড়ালাম সেই দরজার সামনে যেখানে লেখা ‘Annapurna Devi’ এবং আরও লেখা ‘Ustad Allauddin Khan Music Circle’ ।আর তার নিচে লেখা caution – যেখানে ইংলিশে লেখা :

১. তিনবার বেল বাজানোর পরে যদি কেউ দরজা না খুলে তবে অনুগ্রহ করে আর বেল বাজাবেন না।

২. যদি কিছু বলার থাকে তাহলে চিরকুট লিখে দরজার নিচে দিয়ে পাঠিয়ে দিবেন।

৩. পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে চিঠি লিখবেন এবং আগে থেকে যোগাযোগ না করে আসবেন না এবং তারপরেও দরজা খোলা বা না খোলার ব্যাপারটা এই ফ্লোরের বাসিন্দার ইচ্ছানুযায়ী হবে দরজা খোলা হবে কেবল মাত্র রবি, মঙ্গল আর বৃহস্পতিবার।

আমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। যদি দরজা না খুলেন তাহলে কি হবে? এতো কাছে এসে ফিরে যাবো ? যেমনটা হয়েছিল আমার বড় ভাইয়ের ক্ষেত্রে , কারণ ও আগের থেকে নোটিফাই করে আসেনি, তাই দরজা খোলা হয়নি। আবার ভাবলাম নাহলে কিরীট দাদার strategy ফলো করবো – সিঁড়ি থেকে চিৎকার করে কিরীটদা বলতেন, “পিসিমা দরজা খুলুন! আমি কিরীট, আমি কিরীট, আমি কিরীট ! ”

অতঃপর ধীরে ধীরে বেল পুশ করলাম – একবার, দুইবার ! মনে মনে ভাবছি আরেকবার দিলেই তো তিনবার হয়ে যাবে – তখন? তিনবারের বার বেল টিপতে যাবো হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে গেলো। দেখি এক মিস্ত্রি দাঁড়িয়ে আছে। পুরো Anti Climax ! আমি তো অবাক ! এ লোক আবার কোথা থেকে আসলো? সে কিন্তু দরজা খুলেই দিয়েই আবার ভেতরে চলে গেলো। আর আমি অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পর সম্পূর্ণ সাদা চুলের এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলেন , ” আপ কেয়া চাহিয়ে ?” আমি সোজা বাংলায় বললাম, ” আমার নাম রাজিত “। আমি বাংলায় বললাম কারণ আমি ততক্ষনে বুঝে গেছি ইনিই পিসে মশাই রুশী কুমার পান্ডে এবং আমি জানতাম তিনি বাংলা বুঝেন।

রুশীজী সানফ্রানসিস্কো তো বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে Stress Management এর উপরে লেকচার দিতেন। ওনার ডিগ্রীর সংখ্যা লিখতে গেলে সাধারণ পাবলিসশড বইয়ের দুই লাইন লাগে। উনি বিপত্নীক হবার পর কানাডায় ১৪ বছর আর আমেরিকায় ৬ বছর লেকচার দিয়েছেন বিভিন্ন স্টেট ঘুরে ঘুরে। রুশীজি সেতারও বাজাতেন দারুণ, শিখতেন আলী আকবর খাঁ সাহেবের কাছে। ১৯৭৩ সালে রুশীজি সিদ্ধান্ত নেন ইন্ডিয়াতে ফিরে যাবার। মুম্বাইতেই সেটেল হবার সিদ্ধান্ত নেন উনি। তখন আলী আকবর জ্যাঠা মশাই ছোট বোন পিসীমা অন্নপূর্ণার রেফারেন্স দিয়ে দেন যেন সেখানে গিয়ে পিসিমার সাথে সাক্ষাত করে আলী আকবর খাঁ সাহেবের রেফারেন্স দিয়ে বাজনা শিখেন।

এখানে রুশীজি সম্পর্কে আরো কিছু বলা দরকার। কারণ অনেকেই ভাবেন পিসিমা অনেক কষ্টের জীবন কাটিয়েছেন ! কিন্তু এসবই  ভুল। রুশীজি পিসিমার জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে এসেছিলেন। রুশীজি ইংলিশ আর ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছিলেন হামবোল্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি  অফ ক্যালিফর্নিয়া আর কংকোর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি ইন মন্ট্রিয়েল থেকে। উনি ওনার পিএইচডি’র coursework কমপ্লিট করলেও থিসিস জমা দেননি সেতারের সাথে ততদিনে সক্ষতা গড়ে ওঠার কারণে।

১৯৭৩ সালে রুশীজি অন্নপূর্ণা পিসিমার দরজায় বেল বাজালেন। তখন হিপি যুগ চলছে, রুশী কুমার পান্ডেজীও হিপি যুগের সাথে দারুণ মিলিয়ে চলছেন, পিঠ পর্যন্ত লম্বা লম্বা চুল। পিসিমা দরজা থেকেই পারলে বিদায় করে দেন এই বলে, আমি হিপিদের ভারতীয় সংগীত শিখাই না। কিন্তু রুশীজি নাছোড়বান্দা। পিসিমা এরপর জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে দেখা করতে চান ? রুশীজি উত্তর দিলেন, আপনার সাথে। পিসিমা বললেন , আমি কাউকে শিখাই না (এটা পিসিমার এক চরম পরীক্ষার প্রশ্ন )। রুশীজি তখন আলী আকবর খান সাহেবের রেফারেন্স দিলেন এবং বললেন, আপনার দাদা আমাকে পাঠিয়েছেন, অন্তত ঘরে ঢুকতে দিন। পিসিমা রুশীজির বোল্ডনেস দেখে একটু অবাক হয়েই দরজা খুলে দিলেন। কিছুক্ষন বসার পর পিসিমা রুশীজিকে বাজাতে বললেন। রুশীজি যেটুকু পারেন বাজালেন। এরপর পিসিমা গান গেয়ে রাগ yamon  এর গৎ গেয়ে বললেন রুশীজিকে বাজাতে। এভাবে আড়াই ঘন্টা ধরে বিলম্বিতের গৎ তুলবার পর পিসিমা বললেন, শেখা হয় গেছে না ? এবার আপনি আসুন। রুশীজি বললেন , মাত্র শেখা শুরু করলাম ,এখনই যাই কিভাবে ? রুশীজি পরীক্ষায় পাশ করে গেলেন আর নিয়মিত ছাত্র হয় গেলেন।

পরবর্তী ৯ বছর রুশীজি ওনার আমেরিকাতে সাইকোলোজিক্যাল কাউন্সিলরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পিসিমার মাঝে পরিবর্তন আনেন এবং  ১৯৮২ সালে পিসিমা কে গুরু সেবা করবার সারাজীবনের সুযোগ পাবার জন্য বলেন, “I want to marry you” (হিন্দিতে অবশ্যই)। পিসিমার রবিশঙ্করের সাথে বিয়েটার অভিজ্ঞতার কারণে আবার বিয়ে করবার চিন্তাই করতে পারছিলেন না। কিন্তু রুশীজির গুরু ভক্তি ওনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল। ১৯৮২ সালের ৯ ডিসেম্বর ওনারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, ১৩ এপ্রিল ২০১৩ তে  রুশীজি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান পিসিমা কে একা করে দিয়ে। আর রুশীজি চলে যাবার পরে পিসিমার সাথে যোগাযোগ রাখাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল আমাদের জন্য , কারণ রুশীজি ফোন , ইমেইল , ফেইসবুক -এ আমাদের সাথে রেগুলার যোগাযোগ রাখতেন।

ফিরে আসি ১৯৯৮ সালের বোম্বেতে। আমি সোজা বাংলায় বললাম, আমার নাম রাজিত। আমি বাংলায় বললাম কারণ আমি ততক্ষনে বুঝে গেছি ইনিই পিসে মশাই রুশী কুমার পান্ডে এবংআমি জানি তিনি বাংলা বুঝেন। তখন ভদ্রলোক বললেন, One minute please.

একটু পরে ভেতর থেকে ভদ্রলোক গলা উঁচু করে ডাকলেন (পরিষ্কার বাংলায় ) , রাজিত , আসুন। আমি জুতোর ফিতে খুলছিলাম, ফিতে খুলে মাথা উঁচু করে তাকিয়েই দেখি এক ভদ্রমহিলা, যেন সাক্ষাৎ দেবী, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাকাতেই হাসিমুখে বললেন , আমি তোমার পিসিমা।
চলবে।

তানিম হায়াত খান রাজিত
সরোদ আর্টিস্ট, শিল্পী ও সুরকার
ভাইপো- অন্নপূর্ণা দেবী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments