অন্য আকাশে…

  
    

       অন্য আকাশে..

       -আসাদ শামস 

 

সিডনিতে ডা. ফয়সালের সঙ্গে ডা.আসাদ শামস।

চট্রগ্রাম মেডিকেলে আমি ২৫ তম ব্যাচের, আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সাল ২৮ তম ব্যাচের। একজন সদাহাস্য সংস্কৃতিবান এবং বিনয়ী ছেলে হওয়াতে ওর সাথে খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো আমার।
সেই বন্যার্তদের সাহায্য, স্যালাইন প্রস্তুত ও বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি থেকে শুরু করে নাটক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনেও ছিলো অগ্রগামী। সাথে ছিলো লেখাপড়া।
দু’একটা দেশ ঘুড়ে পরে ইংল্যাণ্ডে ইউরোলজিষ্ট (সার্জন )হিসেবে কাজ করত।

খুব স্নেহ করতাম ওকে। আমার অনেক কাজে সমর্থন দিত। মেডিকেল ছাত্রজীবনে মনে আছে পটুয়া কামরুল হাসানের মৃত্যুর পর সামরিক শাসকের চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে আমরা তরঙ্গের উদ্যোগে কামরুলের যে চিত্র প্রদর্শণী করি সেখানেও ফয়সাল সমর্থন দিয়েছিলো। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলেও ওকে দেখেছি। মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদে সমাজকল্যাণ সম্পাদক হয়েছিলো বলে জানি। নাট্য আন্দোলন ছাড়াও টুকিটাকি আরও কিছু স্মৃতি এখনও আমাকে নাড়া দেয়।

১৯৯০ এর পর অনেকদিন যোগাযোগ নেই। ২০১৪ জানুয়ারির দিকে ফেসবুকের কল্যানে ওর সাথে আবার যোগাযোগ। আমাদের অনেক কর্মকাণ্ডে দূর থেকেই তার সমর্থন ছিলো নিয়মিত। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমার মেসেঞ্জারে ওর একটা ইংরেজিতে লেখা মেসেজ পাই যার মোটামুটি অর্থ করেছি:
“ প্রিয় আসাদ ভাই,
জেবা আপা ও আপনাকে সালাম।
আমি সিডনির ‘নীপবন পল্লী’
এবং ‘খামার বাড়ি’ সম্পর্কে কিছু ধারণা এবং তথ্য পেতে আপনার ব্যক্তিগত ইনবক্সে লিখছি। আপনারা সকলেই এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র দুটি দুর্দান্ত টিমের মাধ্যমে কাজ করেছেন বলেই মনে হচ্ছে।
আমরা এরকম কিছু বিবেচনা করছি এই লন্ডনে। লন্ডন, যেমন আপনি জমি এবং সম্পত্তি বাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল জানেন, সুতরাং আমরা কতটা এগিয়ে যেতে পারব তা নিশ্চিত নয়। আমাদের আপনার দলের কাছ থেকে কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত দরকার। সেজন্যে ব্যক্তিগত ইনবক্সে প্রতিটি জিনিস লেখা সম্ভব নয় ,আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি আপনার টেলিফোন নম্বরটি বাড়িতে এবং মোবাইল উভয় ক্ষেত্রেই রাখতে পারি যাতে আমি ফোনে আলোচনা করতে পারি?
লন্ডনে ‘নীপবন পল্লী’ বা ‘খামার বাড়ি’র যে কোনও সদস্য ও পরিবারের জন্য আমাদের উন্মুক্ত আমন্ত্রণ চিরকাল থাকবে।মহান স্রষ্টা আপনাদের সবাইকে মঙ্গল করুক। বেষ্ট উইশেস।
ফয়সাল এবং রাণী “(২৩/১/২০১৬)

ফয়সালের হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো এত তাড়াতাড়ি স্মৃতি হয়ে যাবে কেউ কি ভেবেছিলো।

এরপর কয়েকবার ফোনে, ভাইবার এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা হয়। ও ওর স্বপ্নের কথা বলে ,আমাদের স্বপ্নের প্রতি আবেগ আর সম্মান দেখায়। স্বপ্নের ঐক্যের কথা প্রতিবন্ধকতার কথা নিয়ে মতবিনিময় হয়।
সোশ্যাল মিডিয়াতে মাঝেমধ্যে দেখি বিভিন্ন বাংলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ওর প্রাণবন্ত উপস্থিতির চিত্রাবলী।

তারপর জানলাম ২০১৮ সালে ও সিডনি আসছে। ওর সিডনির বন্ধুরা ছোট একটা গেট টুগেদার করছে ফয়সালের এবং রাণীর (সেও সিএমসির ওর ক’বছরের জুনিয়র ) বন্ধুদের নিয়ে।আমাদের কয়েকটা পরিবারকেও সালাহউদ্দিন আসতে বলল। টেলিফোনে কথা হলো ওর সাথে। আমার স্ত্রী একটা সিএমসি বেলুন আর কেক নিয়ে আসল। সবাই খুব মজা করলাম অনেক রাত পর্যন্ত। লন্ডনে থেকেও ওদের আগ্রহে সন্তান দুটি দেখলাম বাংলা কালচারও বেশ চর্চা করছে।

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের প্রথম পাতায় ডাক্তার ফয়সাল, যখন তিনি শুধুই ছবি হয়ে গেছেন।

চোখে দেখতে চেয়েছিলো সিডনির ‘নীপবন পল্লী’ আর ‘খামার বাড়ি’ ,কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে হয়ে ওঠেনি।
ওরও স্বপ্ন ছিলো বিলেতে একটা বাংলা সংস্কৃতি পল্লী গড়ে তোলা। কাজের প্রতি ছিলো নিষ্ঠাবান। দেশ জাতি বর্ণভেদ ছিলোনা মনে। একজন মানবতাবাদী মানুষ।
একজন চিকিৎসকের মানবসেবার একটা পূর্বশর্ত যে তার নিজের নিরাপত্তারও নিঃশ্চয়তা বিধান সেটা অনুধাবন করেই কিন্তু ব্রিটেনের প্রধাণমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দিয়েছিল। করোনার এই প্রাদুর্ভাবে ফয়সাল কিন্তু নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেও মানুষকে সেবা দিয়ে গেছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হয়ে রইল অমর।
এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তার আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সাল আজ অন্য আকাশে।
১০ এপ্রিল, ২০২০।

আসাদ শামস
চিকিৎসক, লেখক, উপস্থাপক
সিডনি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments