সময়ের দৌড়ের সঙ্গে পেড়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। সৃষ্টিপর্ব (মহাবিশ্ব) থেকে বহমান মহাকালের প্রচ্ছদে একজন মানুষের জীবনকাল নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। বড়জোড় ৭০-৮০ বছর? মহাকালের হিসেবে মহাসমুদ্রে একবিন্দু জলও তো নয়। কিন্তু আমাদের নিজস্ব গণ্ডিতে এটাই একজীবন মানে আজীবন। এরমধ্যে আবার সবচেয়ে সুবর্ণ সময়টা সুপ্ত অবস্থায় জেগে রয় স্মৃতিপটে। এ যেন অক্ষয়, অমোচনীয়। কিছু কিছু ঘটনা আবার এতো বেশি জীবন্ত যে, মনে হয় কালকের বিষয়। মনে হয়, আমি সবেমাত্র বেরিয়ে এলাম সেই ঘটনা প্রবাহ থেকে। আমার সাংবাদিকতা জীবনের বিগত ৩০ বছরের সূচনাপর্বটি আজও যেন কালকের ঘটনা।
তখন একদল তরুণ কাজ করি আজকের কাগজে। চোখে স্বপ্ন দুর্নিবার আকাশ ছোঁয়ার। রক্তে উম্মাদনা নতুন কিছু করার। দ্রোহ আর সৃষ্টিশীলতার মিশেলে নিশ্চয়ই দারুণ কিছু হচ্ছিলো। তা না হলে সেই ৯১ পরবর্তি সময়টাতে আজকের কাগজ তুমুল জনপ্রিয় হতো না। মানুষের সাড়া আমাদের তরুণ টিমটাকে ভীষণ রকম উজ্জীবিত করতো। আর্থিক-রাজনৈতিক চাপ, বারবার ভাঙন আর টানাপোড়েনও দমাতে পারেনি আমাদের। তখনকার তরুণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে দারুণ সুচনাপর্বের পর সাহসী আর স্বপ্নবাজ কাজী শাহেদ আহমেদের হাত ধরে চলতে থাকে নিয়ত স্বপ্নপূরণ পর্ব। নাবিল ভাই (কাজী নাবিল আহমেদ, আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ সভাপতি) ও কাজী আনিস আহমেদ (জেমকন গ্রুপের এমডি, ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক) আমাদের প্রবল উৎসাহ যোগাতেন। পকেটে হয়তো টানাটানি কিন্তু উচ্ছ্বাসে ঘাটতি? না একদমই ছিল না। দিন-রাত এক করে শুধু কাজ আর কাজ। নাঈম ভাই এখনো সেই টগবগে তরুণ। ক’দিন আগে ঢাকায় দেখা হয়েছিল তার সাথে। হৈ রৈ আড্ডা চললো অনেকক্ষণ। ঘুরে ফিরে সেই আজকের কাগজ প্রসঙ্গ। সর্বশেষ একুশের বই মেলায় দেখা হয়ে গেল প্রিয় কাজী শাহেদ আহমেদের সঙ্গে। সেই সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি। হাতে লাঠি। অসুস্থতার কারণে আজকাল খুব একটা বের হননা। সেদিন বই মেলায় এসেছিলেন হুইল চেয়ারে করে ছেলে কাজী আনিস আহমেদের সঙ্গে তার নতুন একটা বই প্রকাশিত হওয়া উপলক্ষে। অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য হাতে কলম নিয়ে বসেছিলেন। দেখা হতেই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লেন। বললেন, কি সুন্দর দিন না কাটিয়েছি আমরা। আজো তিনি স্বপ্ন দেখেন নতুন করে কিছু করার। জিজ্ঞেস করলেন, আফতাব থাকবে তো সঙ্গে? আমার চোখ ভিজে আসে। আনিস ভাই বললেন, আজকের কাগজ আর নাই বা হলো, সেই দুপুর ১২টার মিটিংটা যদি রেগুলার করা যেত, আব্বা (কাজী শাহেদ আহমেদ) তাহলে অনেক ভালো থাকতেন। সত্যি তাই। কি সুন্দর সময়ইনা ছিল সেটা।
আজকের কাগজে যারা কাজ করেছেন, দেখা বা যোগাযোগ হলে তারা সবাই বলেন এ কথা। এর মূলে আসলে কোন্দলহীন একটি পারিবারিক পরিবেশ আর কাজের অবারিত স্বাধীনতা। আজকের কাগজের দীর্ঘ পথচলায় বিভিন্ন পর্বে যুক্ত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। তাদের অনেকেই আজ বিভিন্ন মিডিয়ার শীর্ষপদে। আবার আমার মত অনেকেই প্রবাসী। যত দূরেই থাকি প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই রমরমার যুগে কেউ আজ বিচ্ছিন্ন নয়। এরই কল্যাণে বন্ধুত্ব আর পরিচিতিকে মূল্যায়ন করেন এমন সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। এই যেমন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে প্রকাশিত অনলাইন পোর্টাল প্রশান্তিকার সম্পাদক ও প্রকাশক আতিকুর রহমান শুভ। আজকের কাগজে কাজ করতে করতে ২০০০ সালে দুম করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল পড়াশোনা করতে। খুবই মেধাবী এক ছেলে। আমার প্রিয়ভাজন। মেসেঞ্জারে ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয় নিয়মিত। সপ্তাহ খানেক আগে ও জানালো সে একটি মিডিয়া চালায়। সেখানে লেখা দিতে হবে। আমি একটু অবাক। বললাম, এখনো মিডিয়াতেই মজে আছে? বোঝা গেল ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। জবাবে ও জানালো, শান্তি লাগে ভাই। আরো বললো, ফেইসবুকে আমি ‘অলস কলম নামে’ যে কলামটি লিখি সেটাই সে সিরিজ আকারে প্রকাশ করতে চায়। ওর এই অনুরোধ ফেলা সম্ভব হলো না। প্রশান্তিকার জন্মদিনে এই লেখা দিয়ে সে পর্ব শুরু।
আজকের কাগজ আসলে সাংবাদিকতা শিক্ষার একটি অনন্য প্লাটফর্ম ছিলো। কত জনের সঙ্গে যে সেখানে পরিচয়, আন্তরিকতা সৃষ্ট হয়েছে তা আর বলার নয়। সিডনিতেই আছেন আমার আরো দুইজন প্রিয় মানুষ। ফুয়াদের কথা বলতেই হয়। স্পোর্টস রিপোর্টার ছিল। তখন বয়সে তরুণ, কিছুটা ক্ষেপাটে। বলার সাথে সাথে সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তো। একদিন হঠাৎ বিদেশ পাড়ি জমালো। সিডনিতে আরো আছেন আমার অতি প্রিয় রেজা আরেফিন ভাই। এখন সিডনিতে এসবিএস রেডিওর বাংলা বিভাগের প্রধান। জন্মভূমি নামে একটি টিভি চ্যানেলও চালান। ঢাকায় থাকতে বাংলাদেশ এলেই যোগাযোগ করতেন। দেখা হতো। এখন আমি আমেরিকায় থাকাই দেখা সাক্ষাৎটা বন্ধ। এই রেজা ভাই সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবেনা। অনেক স্মৃতি। তবে দু একটা ঘটনা উল্লেখ না করে পারলাম না। একবার একটা রিপোর্ট প্রকাশের পর সেই রিপোর্টারের (মাকসুদুল হায়দার) ওপর ভীষণ চটে উঠেছিল একটি চক্র। তারা ফোন করে নানা হুমকি দেওয়া শুরু করলো। রেজা ভাই ছিলেন আজকের কাগজের নিউজ এডিটর। বেশ মোটাসোটা মানে স্বাস্থ্যবান আর কি। হাবভাবে বেশ মাস্তানি ভাব। ওই ঘটনার রেশ ধরে একদিন তাকে ফোন করে এক ব্যক্তি গুলি করার হুমকি দিলেন। জবাবে রেজা ভাই বলেছিলেন, শোনেন শোনেন। আমার সাইজ তো দেখেন নাই। কাটা রাইফেলের দশটা গুলিও আমারে শোয়াইতে পারবো না। পত্রিকার নগর সংস্করণ বের হতে প্রায়ই দেরি হয়ে যেত। কারণ মধ্যরাতের আড্ডাটা ছিল দারুণ জম্পেশ। কোথা দিয়ে যে সময় বয়ে যেত বলতে পারবো না। রাত আড়াইটা তিনটায় কাজ শেষে সেলোফেন যখন প্রেসে যেত, আমাদের রেজা ভাই তখন আমিন বাজার বা কাচপুর ব্রিজে। কেন? অন্যান্য পত্রিকা নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাওয়া বাসগুলোক আটকানোর জন্য। এর জন্য অবশ্য প্রতিদিনই তার পকেট হালকা হতো। রাতে কাজের সময় গামলা ভরে সিঙ্গারা নিয়ে বসতেন। হাঁক দিতেন আফতাব চলবে নাকি? হাতের রিপোর্টটা একটু গুছিয়ে উঠতে উঠতে গামলা প্রায় খালি। একটা করে সিঙ্গারা এক দফায় মুখে চালান হয়ে যেত তার। যেন নাপা ট্যাবলেট খাচ্ছেন। প্রায়ই মাঝরাতে কাজী শাহেদ আহমেদ এসে হাজির। এসেই হাঁক দিতেন তোমাদের ফার্স্ট এডিশন শেষ হলো। এসো সবাই মিলে খাই। নিজের হাতে রান্না করা খিঁচুরি আর ডিমের ঝোল নিয়ে আসতেন তিনি। প্রায় পুর্ণিমা রাতে তার বাড়ির ছাদে পার্টি থাকতো। সেখানে আমরা আমন্ত্রিত। প্রতি দু’মাসে সাভারের বাগান বাড়িতে পিকনিক। এসব আনন্দময় ঘটনার মাঝে কস্টেরও অনেক স্মৃতি আছে। আমার অতি প্রিয় সিনিয়র সাব এডিটর পার্থ প্রতীম আচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি খেয়ে নিথর হয়ে গেল একদিন। স্পোর্টস বিভাগের ছাব্বিশ বছরের তরুণ কর্মী মনোয়ার হার্ট অ্যাটাকে মরে গেল দুম করে। বন্ধু সুলেরি জামান (সিনিয়র সাব এডিটর) অসুস্থ হয়ে মারা গেল। আগে পিছে আরো গেলেন মারুফ চিনু, মোস্তাক হোসেন, আহমেদ ফারুক হাসান। এই তো ক’দিন আগে চলে গেলেন আবু বকর চৌধুরী, আমাদের প্রিয় বকর ভাই। এরা সবাই ছিলেন আজকের কাগজে আমার সহকর্মী। যাদের সান্নিধ্যে কেটেছে জীবনের অতি উজ্জ্বল একটা সময়। যারা জাতিকে, সমাজকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছু, কিন্তু নিজেরা পাননি প্রায় কিছুই। অনেকে টানাটানির সংসার চালিয়ে গেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। কেউ কেউ অর্থের অভাবে সুচিকিৎসাটা পর্যন্ত পাননি। আমাদের সমাজ কী তাদের অবদানের কথাটা মনে রেখেছে? কি জানি। তবে একজন সৎ মিডিয়া কর্মী হিসাবে তারা সমাজকে কিছু দেওয়ার গর্ব নিয়ে বিদায় নিয়েছেন নিশ্চিত। চলতি সময়ে যার প্রকট অভাব। আর আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি তারা হারানো সহকর্মীদের স্মৃতি বয়ে চলেছি অবিরত। আর হ্যাঁ অবশ্যই বুক ভরা গর্ব আছে আমাদেরও। আমরা সমাজ-রাজনীতির অনাচার, ব্যাভিচার, অন্ধকার সাহসের সঙ্গে উন্মোচিত করতে পেরেছি বলে।
চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।
সাংবাদিকতা: আজকের কাগজ, সমকাল, কালের কন্ঠ।
ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ।