অলৌকিক ভালোবাসা -সাকিনা আক্তার

  
    
সাকিনা আক্তার

অলৌকিক ভালোবাসা অনুভব করেছি একবার। অহনা আমার ছোটবেলার বন্ধু, স্কুল-কলেজে সে কখনো দ্বিতীয় হয়নি। ডাক্তারি পড়বে বলে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হল। বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী গল্পের নায়িকার মত অনিন্দ্য সুন্দরী ছিল সে। গভীর কালো কবিতার মত চোখ, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি লেগেই থাকতো। কোমর ছড়ানো ঘন কালো ঝরঝরে চুলের আকর্ষণীয় সৌন্দর্য দৃষ্টি এড়াতো না কারও।

আজ অনেক বছর পর, অহনা বসে আছে ওর বিছানায়। নিরাপদ দূরত্বে আমি একটা চেয়ারে বসে ছিলাম। বললাম তোর শিকলের বাঁধনটা খুলে দেই? ও বারণ করল। আজ সেই মেঘের মতো কালো চুল ঘাড়ের উপরে ছোট করে কাটা। হাসিটা কেমন যেন অপার্থিব। চোখ চিকচিক করছে অব্যক্ত যন্ত্রনায়। আমার বন্ধু যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও।

তেমন কোন কথা হচ্ছিল না, দুজনেরই চোখ ঝাপসা।মেডিকেল প্রথম বর্ষ পড়তে পড়তে, অহনা একটা ভুল প্রেমে পড়েছিল। বিয়েও করেছিলো পরিবারের অমতে। কেন জানিনা ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মেডিকেল তৃতীয় বর্ষে পড়া সারা জীবনের অদ্বিতীয় মেয়েটার তারপরে অবস্থান হয় মানসিক হাসপাতালে।

হঠাৎ করে বলল আমাকে একটু কাগজ আর কলম এনে দিতে পারবি? বিস্মিত হলাম, কেন? বলল তুই তো অনেক বছর পরে এসেছিস আবার চলে যাবি। খুব আবেগ মাখা কন্ঠে বলল জানিস, আমাকে সবাই ভয় পায় কেউ দেখতে আসে না। অবশ্য আমিও ডাক্তারের দেয়া ওষুধগুলো খেয়ে বেশিরভাগ সময় ঘুমেই থাকি।

কাগজ-কলম পেয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। খুশিতে ঝলমল করছে। আমাকে বললো যেভাবে আছিস ঠিক সেভাবে সোজা বসে থাকবি, কোন নড়াচড়া করবি না। আমি একটু হাত নাড়তেই খুব ধমক দিলো, বলেছি না স্থির থাক, ছবিটা নষ্ট হয়ে যাবে তো। আমার দুচোখ ছাপিয়ে অঝোরে অশ্রু ধারা বয়ে যাচ্ছে কষ্টে। ছবিটা শেষ করে অহনা হাত নেড়ে কাছে ডাকলো। তাকিয়ে আমার বুক ফেটে কান্না এলো। একটা তিন চার বছর বয়সী বাচ্চার মত আমাকে এঁকেছে সে। সরু সরু হাত পা, গোল্লা একটা মাথায়, ক গাছি চুল! এই কি ওর মানসিক বয়স?

আমাকে বলতে শুরু করল আমি চলে যাবার পর নাকি এই ছবিটাই ওর সঙ্গী হয়ে থাকবে। আমি আর কোনদিন হারাবো না, সারাক্ষণ সাথে থাকবো। আরো বড় চমক অপেক্ষা করছিল। অহনা বলে ওর যখন চার বছর বয়স তখন একটা পুতুল ছিল, নাম রেখেছিল দীপা। আমার সারা শরীরে একটা ঠান্ডা শিহরণ অনুভব করলাম। আমার ডাকনাম দীপা। বলল জানিস কেউ শিখিয়ে দেয়নি, ওদের পরিবারেও এই নামে কেউ ছিলনা। কখনো কোথাও শুনে এই নামটা ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তোকে আমি ভালোবাসি তোকে জানার দেখার আগ থেকেই! পরে ওর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে জেনেছি, এটা সত্য দীপা ছাড়া ও ঘুমাতো না।

গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করল। ঠিক বুঝলাম না কোন সুর। আনন্দ-বেদনা মাখানো কেমন যেন অন্যরকম আবেদন। স্কুলে থাকতে খুব ওয়ার্ল্ড মিউজিক পছন্দ করত ও, মনে পড়ে গেল।

সময়ের স্রোতে, জীবনের বাস্তবতায়, দূরত্ব  সব মিলে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল অহনা। আজ এত বছর পরে আমার বন্ধুর কথা ভেবে সারা দুনিয়া এলোমেলো লাগছে আমার। আমারও পাগলের মত অসহায় লাগছে।

আর একটা মুহূর্তের জন্য হাত ছাড়বোনা তোর। প্রতীক্ষা করব দেখা হবার। কাছে থাকা আর পাশে থাকা এক নয়। মনের আঙিনায় ছুটে বেড়াবো ছোট্ট বেলার মত আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর অকৃত্রিম  ভালোবাসায়।

শুনেছি  খুব একটা ভালো নেই অহনা। ঠিক কেমন আছে অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। চারিদিকে  করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাব। সারাক্ষণ অজানা আশঙ্কা। কেটে যাক সব অনিশ্চয়তা।

মনেপ্রাণে প্রার্থণা করছি যেখানেই থাক, ভালো থাক, শান্তিতে থাক বন্ধু আমার।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments