অসংখ্য চরিত্র ও অনুভবের মাঝেই বেঁচে থাকবেন সমরেশ । নাদেরা সুলতানা নদী

  
    

যতদূর মনে পড়ে সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ আমার পড়া প্রথম উপন্যাস। কোন উপন্যাস পড়ে প্রথম একটা ঘোর লাগা অনুভব। দীপাবলি চরিত্রটা ঘিরে কিশোরী মনে একটা স্থায়ী ছাপ পড়েভীষণদৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন নারী কেমন হতে পারে বুঝার চেষ্টা করি। 


‘’ঈশ্বর যদি মানুষকে অন্তত একদিনের জন্যে অন্যের মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দিতেনতাহলে নব্বই ভাগ মানুষ কেউ কারো সঙ্গে থাকতে পারতনা।‘’ এমন সব কথার গাঁথুনিতে চিন্তার জগতে ছোট ছোট তোলপাড় টের পাই এই উপন্যাস পড়ে। 

‘’আমাদের এখানে মেয়েরা বিয়ে করে নাতাদের বিয়ে দেওয়া হয়।‘’ সাতকাহনেই পড়ি এমন 

চিন্তা চেতনার কোন গভীরতা থেকে লেখকের এই উপলব্ধিআমাকে ভাবায়। 

ভাবায় তাঁর আরো অনেক অনেক ছোট ছোট প্রকাশনানান চরিত্রের কথোপকথন। 

‘’একসঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেও মানুষের সঙ্গে মানুষের চেনাশোনা হয়না।‘’ (উত্তরাধিকার)

বলেছি অনেকবার, ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাস এবং এর জয়িতা চরিত্রটি আমার উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলা এক চরিত্র। যে সময় বইটা পড়েছিতখন বুঝা না বুঝা একটা সময়। জয়িতার মতো হয়ে উঠবার সুযোগসাহস কোনটাই ছিলোনাকিন্তু আমি প্রথম বিশ্বাস করতে শুরু করি-  ছেলেমেয়েতে বন্ধু হয়। জয়িতাসুদীপআনন্দ আর কল্যাণ এই চার বন্ধুর সেই রোমাঞ্চকরদুঃসাহসিক অভিযানের গল্প আমার ভেতরের আমিটাকে ভেঙে চূড়ে যেন অন্য একটা আমি সন্ধান দেয়

গত  মে ২০২৩ প্রখ্যাত এই ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। 

তাঁর অসংখ্য লেখার কিছু নূতন করে পড়ছিলাম আজ এই মুহূ্র্তে তাঁকে নিয়ে কিছু লিখবো বলে। এক লেখায় বলেছেন


‘’আমাদের মধ্যে অনেকগুলো ‘একা’ আছে ! প্রিয়জন চলে যাওয়ার সময় একএকটি জানান দেয়এই করতে করতে যখন সব একা ভেঙ্গে পড়বে তখন চুপচাপ শেষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্যকোনও উপায় নেই।‘’

একটা সময় পরআমি খুব ভালো লেগেছে কোন লেখা বা যে কোন শিল্পমাধ্যমের কাজসেই সব শিল্পীদের আমি আমার একান্ত জগতেই ধরে রাখি ভালোবাসায় শ্রদ্ধায়। ব্যক্তি জীবনের কোন কিছু অপ্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসে কোন প্রিয়কে হারানোর বেদনায় যেন পড়তে না হয় এটা নিয়ে বেশ ভাবনা হয় আমার, নিজের অজান্তেই সচেতন থাকি। 

সমরেশ মজুমদারের অন্য একটা লেখা

‘’সন্দেহ এবং অস্বীকার করতে অভ্যস্ত এই আমরা ভাবতেই রাজি নই আমরা যে জীবন যাপন করি তার বাইরেও জীবন আছে  সেই জীবনযাপন যারা করেন তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ আছে যার সঙ্গে আমাদের নাও মিলতে পারে।‘’ (মনে পাপ নেই)

আমি মনে করি প্রিয় কোন লেখকসাহিত্যিক বা শিল্পীকেই আমাদের খুব কাছের মানুষ মনে করার কোন কারণ নেই

উনিই বলেছেন

‘’আমি নদীর মত। প্রতিটি ঘাটের মানুষ মনে করে আমি তার  শুধু আমিই জানি না।‘’  (নবীন সন্ন্যাসী)

তারপরও একজন লেখকের লেখার যাদুতে আমরা বিমোহিত হইতাঁর জীবন দর্শন আমাদেরকে প্রভাবিত করে তাঁকে হৃদয়ের বিশেষ স্থানে জায়গা করে নেবার

‘’আমি সবুজ ভালোবাসিনধর ঘাসেরা যখন সবুজ গালিচা হয়ে থাকে তখন মনে বড় মায়া আসে। প্রয়োজনে এগিয়ে যেতে হলে সেই ঘাসে পাফেলে যেতে হয়  কিন্তু ফুলের ওপর পা ফেলে হাঁটা বড় কষ্টের।‘’

বাংলাদেশে এই সময়ে বিখ্যাতজনপ্রিয় বা অজনপ্রিয়যে কেউ প্রয়াত হলে দেখছিন্যূনতম শিষ্টাচার ভুলে কেউ কেউ আক্রমণাত্নক কিছু শেয়ার করছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেগুলো নিয়ে লম্বা কোন লেখার ইচ্ছে বা সময় আজ আমার নেইতাই লেখক সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে শুধুই তাঁর লেখা নিয়েই থাকুক আমার এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন 

আরো একটা লেখার উদ্ধৃতি দেই

‘’বাঙালির স্বভাব হল যা পছন্দ হবে না তা এড়িয়ে যাওয়া। আমাদেরবাবাঠাকুরদা যদি কোনও ভুল করে থাকেন তাহলে কেন তার সমালোচনা করতে পারব না। সমালোচনা মানে তো অশ্রদ্ধা নয়।‘’ সমরেশ মজুমদার (আকাশে হেলান দিয়ে)

তাই যে বা যারা সমালোচনা করছেন তাদের জন্যে থাকুক লেখকেরই কথা। 

এক জীবনে অনেক জীবন’  বলেছেন
‘’শুনেছিবিখ্যাতঅতিবিখ্যাত মানুষেরা নাকি সমালোচনা মেনে নিতে সবসময় পারেন না। ত্রুটির উল্লেখ করলে ভাবেন আক্রান্ত হচ্ছেন।‘’ 

আমি মনে করিউনি সমালোচনা নিতে পারতেন। এই সময়ে তাঁরসাহিত্য মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে কী যায় আসে তাঁর প্রিয় পাঠকদের। 

বাংলাদেশে একটি পত্রিকায় বোধ হয় লিখেছিলেন কিছু সময়সেই লেখানিয়েই উনি বলেছেন

‘’এই যে আমিকলকাতার কাগজগুলোতে লিখি আর আপনারাবাংলাদেশের মানুষেরাসেগুলো বই হয়ে বেরুবার পর পড়েনএতে আমার তৃপ্তি হয় না  ইচ্ছে হতসরাসরি আপনাদের কাছে পৌঁছাতে কালি  কলমের স্তম্ভআমার প্রিয় আনিসদাসেই সুযোগ করে দিলেন এখন আমার মাথায় যা আসেবুকে যেইচ্ছে ফোটেতাই সরাসরি আপনাদের নিবেদন করতে পারছি। হয়তো সব লেখাই উতরোচ্ছে নাকিন্তু ঘরের ছেলের ত্রুটিবিচ্যুতি তো ঘরের মানুষেরা ক্ষমার চোখেদ্যাখেনসেই ভরসায় লিখে যাচ্ছি।‘’ সমরেশ মজুমদার (জীবনটাকেচেখে দেখুন)

তারপরও প্রয়াত লেখকের কোন লেখা পড়ে বা না পড়ে যে বা যারা ভীষণজ্ঞানগর্ভ আলোচনা উগড়ে দিচ্ছেন তাদের জন্যে খুঁজে নিয়ে এলাম এইছোট কিছু প্রকাশ।

যদিও ‘রুচি’ নিয়ে কিছু বলা মানেই কাউকে না কাউকে ঠিক হার্ট করাআমি সে দলে নইআমি আমার নিজের দলে… কিন্তু বলতেই হচ্ছেসমরেশ মজুমদারের ভাষাতেই বলি

‘’রুচি যাদের সর্বদাই নিম্নগামী আমি তাদের দলে নই।‘’

হয়তো অনেকের অজানাসমরেশ মজুমদার আরো লিখেছেন

‘’পৃথিবীটা ভীষণ রঙিনকিন্তু এখানে এসে সাদাকালোর দ্বন্দ্বে যারাপড়েছেতারাই মরেছে।‘’

আমার খুব মনে হয়একজন লেখকের লেখালিখির পুরো সময়টাইতিহাসে রয়ে যায় একটা সময়ের জার্নি হিসেবে। লেখক তাঁর লেখায়নিয়ে আসেন তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস। কেউ খুব সহজকরেকেউ বা তা খুব কঠিন করে তুলে ধরেন। আমরা আমাদের সীমিতবা অগাধ বোধ বিবেচনা দিয়ে সেই জার্নির অল্প কিছুই করি ধারণ বাস্মরণ আমাদের জীবনে। 

লেখক কতোটা কার মনে থাকবেনসেটা নিয়ে হয়তো খুব কম লেখকইব্যাপক পরিকল্পনা করে কাজ করেন বা করতে পারেন সমরেশমজুমদারপরানের পদ্মবনেতে বলেছেন

‘’কত মানুষ তো এই পৃথিবীতে এখনও রয়েছে যারা আমার জীবন থেকেহারিয়ে গিয়েছেযাদের জীবনের কোথাও আমি নেই।‘’

আমাদের সবার জীবনে কেউ না কেউই পুরোটা জুড়ে থাকে। জীবনেরনানা সময়ে যে বা যারা এসে যোগ দেয় আঁকেবাঁকে আসে, তাঁদের মাঝে স্থায়ীভাবে থাকে কজনই বা

তবে যা না বললেই নয়আমরা যদি কোন কারণে একেবারেই স্বাভাবিকবোধ বিবেচনা হারিয়ে ফেলিঅনেক এলোমেলো কথাই বলতে পারি

‘’মাতালদের মস্তিস্ক খারাপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।‘’ না এটা আমারকথা নাসমরেশ মজুমদারই তাঁর লেখায় বলে গেছেন। 

আমি বিশ্বাস করতে চাইউনি হয়তো বিশ্বাস নিয়েই এই উচ্চারণ রেখে গেছেন
‘’কেউ কারোও জায়গা নিতে পারে না।‘’ (মেঘ ছিলবৃষ্টিও)

উনার জায়গাটাও কেউ নিতে পারবেনা। যা একজন লেখকের অসামান্য প্রাপ্য। 

আমাদের যার প্রিয় যে লেখা বা গানসেই সৃষ্টির আসলে মৃত্যু হয়নাযতদিন না আমরা চিরতরে ছেড়ে যাচ্ছি এই পৃথিবীএটা আমারউপলব্ধি। সমরেশ মজুমদারের না পড়া লেখার আরো অনেকগুলোলেখা আমার পড়ার ইচ্ছে অনেকদিনের। সময় করতে পারছিনা। 

শেষ করি তাঁর আরো একটি লেখা দিয়েই

আজকাল মৃত্যু সংবাদ শুনলে অস্বস্তি হয় , মন খারাপ হয় না।” (ছায়ারপাখি)

আমার মন খারাপ হয়নি, কারণ আমার কাছে লেখক সমরেশ বেঁচে থাকবেন… তাঁর লেখায়। 

বাংলা সাহিত্যে উনার লেখা পাঠ নির্যাস অটুট থাকুকথাকুক সমুজ্জ্বল সাহিত্য প্রেমীদের হৃদয়ে অনেক অনেক বছর এই চাওয়া আমার!

শ্রদ্ধাঞ্জলি সমরেশ মজুমদার। 

নাদেরা সুলতানা নদী : সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments