অস্ট্রেলিয়ার আকাশ জুড়ে দাবানলের ধোঁয়ার কুন্ডলী আর কুন্ডলী। আকাশ থেকে নেয়া ছবি বলছে ‘বুশ ফায়ার’ বা ‘বনদাহ’ থেকে দাবানল এখন পেচিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্র । বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তীব্র জ্বালাময়ী ধোঁয়া আর কার্বন কণার মিশ্রণ। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকায় বৃষ্টি হলেও তা সামগ্রিকভাবে তেমন প্রভাব ফেলেনি। ভয়ানক এ দাবানল থেকে রেহাই পেতে এখন প্রয়োজন অবিরাম বর্ষণ। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ এলাকা। আদিবাসী এ মহাদেশ এখন অবিরাম ধারাপাতের অপেক্ষায়।

অস্ট্রেলিয়ার এই বুশফায়ারের কারণ কি ?
পুরাণ মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী খান্ডব নামের অরণ্য দগ্ধ করে তার সমুদয় প্রাণ অগ্নিকে উপহার দেয়া হয় তার ক্ষিদে মেটাবার জন্য। সেজন্য পঞ্চপাণ্ডব চারিদিক বেষ্টন করে খান্ডব অরণ্যে আগুন জ্বালায়, তাতে হরিণ, বাঘ, সাপ সহ সব প্রাণী আগুনের গ্রাসে পতিত হয়। পুরাণের এই পাণ্ডবদের মত অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে কিছু পাষণ্ড জড়িত বলে জানা গেছে। ২৪ জনকে অগ্নি সংযোগের অভিযুক্ত করা ছাড়াও ১৮৩ জনকে আইনানুগ প্রক্রিয়ার সম্মুখীন করেছে নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ। তবে মানবসৃষ্ট অগ্নি সংযোগের বাইরে প্রাকৃতিক ভাবেও আগুন লাগতে পারে। পৃথিবীরই অনেক দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ ইউরোপের দেশ যেমন স্পেন, পর্তুগালে প্রাকৃতিক ভাবে দাবানল হয়ে থাকে। আর দক্ষিণ পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার দাবানল এদের মধ্যে ভয়াবহতম । অ্যাশ ওয়েন্সডে, ব্ল্যাক স্যাটারডে মতো দাবানলগুলোতে শত শত মানুষ গৃহহারা হয়েছেন । যদিও বর্তমানে ঘন ঘন বুশফায়ারের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের জোড়ালো ভূমিকাকে দায়ী করা হচ্ছে। গত শতাব্দীতে অস্ট্রেলিয়ার গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর বৃদ্ধি হয়েছে । গড় তাপমাত্রা বাড়ার সাথে যুক্ত রয়েছে চরম বৈরী আবহাওয়া । অস্ট্রেলিয়ার বিগত বছরগুলোতে বৃষ্টিশূন্যতা, শুষ্ক আবহাওয়া, মাটির শুষ্কতা এবং বিগত মাসগুলোর চরম তাপমাত্রা এ বছরের বুশফায়ারের অন্যতম কারণ । যার প্রমাণ মিলে আবহাওয়া ব্যুরোর বন আগুন বিপদ সূচক (এফ, এফ, ডি, আই ) থেকে- যেটি তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ুর বেগ এবং শুষ্কতা থেকে হিসেব করা হয়। এফ, এফ, ডি, আই বিশ্লেষণে দেখা যায় যে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে বসন্ত এবং গ্রীষ্মের সময় বুশফায়ারের মতো বিপজ্জনক অবস্থার ব্যাপক প্রবণতা রয়েছে এবং যেগুলোর বিশালতাও চরম । সেটাই আমরা এ বছর দেখতে পেলাম ।

দাবানল অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতির সাথে মিশে আছে পুরোপুরি ! এদেশের ভূদৃশ্যের বনভূমি, উডল্যান্ড এবং গ্রাসল্যান্ড(তৃণভূমি) আগুনের ছোয়াতে নিয়ন্ত্রিত হয় । এছাড়া রয়েছে বনে জমাকৃত বন জ্বালানি (ফরেস্ট ফুয়েল) এবং জৈববস্তুপুঞ্জ (বোয়ামাস)। এ বছর অনেক এলাকা পুড়ে গিয়েছে যার কিছু অংশ ৩ বছর, ৫বছর বা ১০ বছর আগেও পুড়ে গিয়েছিলো। তবে কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘ সময়কাল ধরে বুশফায়ার না হওয়ায় বা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে জ্বালানি এবং জৈববস্তুপুঞ্জ নিয়ন্ত্রণ না করায় সে সব এলাকায় আগুন ছিল প্রবল ও ব্যাপক এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে । শুকনো মৌসুমে- শীতের শেষে আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বন ও ঘাস শুকিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরী হয়। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে সাধারণত ঠান্ডা দখিণা বায়ু প্রবাহিত হয়। বসন্ত-গ্রীষ্মের দিনগুলোতে উত্তুরে বাতাসের (নর্থেরলি উইন্ড) চাপের প্রভাবে দখিণা বায়ু আরো দক্ষিণে তাসমান সাগরে চলে যায় । তখন দিনের তাপমাত্রা ৪০এর উপর চলে যায় । যদিও দখিণা বায়ু প্রবল চাপ প্রয়োগ করে উত্তুরে হাওয়াকে সরিয়ে দিতে চায় এবং কোনো এক সময় তা করতে সমর্থ হয় যা কিনা “কুল চেঞ্জ” নামে পরিচিত । দুর্ভাগ্য যে কুল চেঞ্জ আসে ঝোড়ো বাতাস আর বৈরী আবহাওয়া নিয়ে- ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটার ঘন্টা বেগ বাতাসের দিক পরিবর্তনে হয় ঝড়, বৃষ্টি আর বজ্রপাত। বজ্রপাতের আগুন ঝরে পড়া শুকনো পাতা ও ঘাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেগবান বাতাস তা থেকে দাবানল সৃষ্টি করে। প্রতিটি কুল চেঞ্জে ৫০ থেকে ১০০ টি দাবানল হতে পারে। অস্ট্রেলিযার বিশাল ভূদৃশ্যে কোনো এক অংশে বনের মাঝে দাবানল শুরু হলেও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত লুকায়িত থাকতে পারে (বিশেষ করে রাতে) । এই সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ । এই সময়ের মধ্যে আগুন নিভিয়ে ফেলতে না পারলে তার পরিণাম হয় ভয়াবহ। যেটি আমরা এ বছর দেখছি ।

আগুন কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না !
আগুনের আকার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে তার তীব্রতা । এই তীব্রতা ৮০০কিলোওয়াট/মিটার থাকলে পানির সাহায্যে সরাসরি আক্রমণ করে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা যায় । তীব্রতা ২,০০০কিলোওয়াট/মিটার হলে ফায়ার ট্রাক ট্যাঙ্ক, জল বোমারু বিমান, ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা যেতে পারে। এই ধরণের পরিবেশে ফায়ার ফাইটারের আগুন নিরোধক পোশাক পরেও একজন মানুষের ১০ সেকেন্ডের বেশি টেকা সম্ভব না। তবে ৩,০০০কিলোওয়াট/মিটার এর বেশি হলে সে আগুন দমন করা অসম্ভব । বর্তমান সময়ের দাবানল গুলোর তীব্রতা ৫০,০০০ -১০০,০০০ কিলোওয়াট/মিটার পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে । উল্লেখ্য যে ২০০৯ সালের ব্ল্যাক স্যাটারডে দাবানলে ১০০,০০০ কিলোওয়াট/মিটার আগুনের তীব্রতা রেকর্ড করা হয়েছিল । তীব্র আগুনের তাপ তাদের নিজস্ব বিপজ্জনক আবহাওয়া তৈরি করে । তাপে বায়ু গরম হয়ে দ্রুত বেগে উপরে চলে যায় । ধোয়ার স্তর ১০কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে যাকে বলা হয় প্যারোকামূলনিম্বুস ক্লাউড । এবছর ভিক্টোরিয়াতে এরকম ২০ টি প্যারোকামূলনিম্বুস ক্লাউড দেখা গেছে যা থাকে বজ্রপাত এবং ফায়ার টর্নেডোর মতো ঘটনা ঘটেছে ।
(চলবে..)
সালাহউদ্দিন আহমদ: সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার,
ভিক্টোরিয়ান ফরেস্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ও আলোকচিত্র শিল্পী
আহমেদ আবিদ: গবেষক, মানবাধিকার, সমাজ ও সমন্বিত শাসন, ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি
[…] পর্বসমূহ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ( পর্ব ১ | পর্ব ২ […]