নিউ সাউথ ওয়েলস, এসিটি, ভিক্টোরিয়া, সাউথ অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সারা অস্ট্রেলিয়ার বনভূমিতে চারমাসেরও অধিক সময় ধরে ছিলো দাবানল। নিউ সাউথ ওয়েলস’এ একটানা বৃষ্টিতে দাবদাহ ও দাবানল কমে এসেছে। এখনও অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্থানে দাবানল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
দাবানল নিয়ে তথ্যমূলক এবং বিজ্ঞানসম্মত ধারাবাহিক রিপোর্টটি লিখছেন সালাহউদ্দিন আহমদ: সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার, ভিক্টোরিয়ান ফরেস্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ও আলোকচিত্র শিল্পী এবং আহমেদ আবিদ: গবেষক, মানবাধিকার, সমাজ ও সমন্বিত শাসন, ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ( পর্ব ১ | পর্ব ২ )
রেকর্ড ভাঙা দাবানলে এখন পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় ২০ মিলিয়ন হেক্টর (২ লক্ষ বর্গকিলোমিটার) এলাকা পুড়ে গেছে। নিউসাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি এবং ভিক্টোরিয়া রাজ্যের অনেক গুলো পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা এখনো আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহের শিলা-বৃষ্টি এবং পরবর্তী ধোঁয়া কমে যাওয়ায় অনেকে ধারণা করছেন যে বৃষ্টিতে আগুন নিভে গেছে । কয়েক মিলিমিটার বৃষ্টি বিশাল দাবানলের মতো আগুনকে পুরোপুরি নেভাতে পারেনা বরং বাড়তি উপদ্রব টেনে আনে, যেমন ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ডেব্রিস ফ্লো। এছাড়া বৃষ্টির কারণে দাবানল ছোট ছোট এলাকায় বিভক্ত হয়ে যেতে পারে যা অগ্নিনির্বাপন কৌশল বিঘ্নিত করে যেমন বুলডোজার দিয়ে নিয়ন্ত্রন রেখা তৈরী, ব্যাক বার্নিং ইত্যাদি। দাবানল ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে পারে এবং কর্দমাক্ত পরিবেশ অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের জন্য বিপদজনক করে ফেলে। বৃষ্টি পরবর্তী কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে দাবানলের আগুন পূর্ববর্তী অবস্থায় চলে যেতে পারে। দাবানলের আগুন বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাদেরকে আমরা সাধারণত ঘুমন্ত দানব বা স্লিপিং জায়েন্ট বলে থাকি। গরম আবহাওয়ায় স্লিপিং জায়েন্ট বড্ড ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা গত সপ্তাহে দেখলাম।
দাবানলের আগুন কোন পর্যায়ে কি অবস্থায় রয়েছে তার বিবরণ কেবলমাত্র কোন ধরণের অগ্নিনির্বাপন কর্ম হচ্ছে তা থেকে বোঝা যাবে “পুড়ছে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে” (গোয়িং অর আউট অফ কন্ট্রাল), “নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে” ( কন্টেইন্ড অর বিয়িং কন্ট্রোল্ড), “নিয়ন্ত্রিত বা টহলরত” (আন্ডার কন্ট্রাল অর পেট্রলড) এবং “নিরাপদ” (সেফ) এই সবগুলো দ্বারা। সম্প্রতি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো টম ডাফ খুব পরিস্কার ভাষায় এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। টমের লেখা অনুসরণ করে নিচে অংশটি ব্যাখ্যা করা হলো:
ছবি: ভিক্টোরিয়া, নিউসাউথ ওয়েলস এবং ক্যানবেরার যে এলাকাগুলো বর্তমানে আগুনে পুড়ছে তার কালার ইনফ্রারেড সেন্টিনেল স্যাটেলাইট ইমেজ। দাবানলের আগুনে ছড়িয়ে পড়ার হার অনেক গতিশীল, বর্তমান অবস্থা লাইভ দেখতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
ছবি সূত্র: সেন্টিনেল স্যাটেলাইট (২০২০০২০৩ ২২০০ঘণ্টা)
গোয়িং ফায়ার অর আউট অফ কন্ট্রাল ফায়ার:
দাবানলের আগুনে বন জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে, এমন ধরণের আগুনের বিবরণ দেয়া হয় “পুড়ছে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে” শব্দগুলো দ্বারা। এই ধরণের আগুন খুবই বিপজ্জনক কারণ এমন ধরণের আগুন থেকে কোন অরক্ষিত অঞ্চলে (যেখানে এখনো আগুন পৌঁছায়নি এমন এলাকায় ) ছড়িয়ে যাওয়ার খুবই সম্ভাবনা থাকে। আগুন পুড়িয়ে দেয়া বা নিয়ন্ত্রণ রেখার বাইরে চলে গেলেও তাকে পুড়ছে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরের আগুন বলা হয়ে থাকে ।
ছবি: হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটিয়ে আটকে যাওয়া একপাল ভেড়া রক্ষা করতে চেষ্টা করা হচ্ছে । ছবি সূত্র: ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়রনমেন্ট, ল্যান্ড, ওয়াটার এন্ড প্ল্যানিং, ভিক্টোরিয়া
কন্টেইন্ড ফায়ার অর বিয়িং কন্ট্রোল্ড ফায়ার:
নিয়ন্ত্রিত রেখা (পর্ব ২ দেখুন ) বা কৌশলগত ভাবে পুড়িয়ে ফেলে দাবানল গুলো বেষ্টন করা হয়েছে বা বেষ্টন করা প্রায় শেষ হচ্ছে এমন দাবানলকে নিয়ন্ত্রিত বা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলা হয়ে থাকে। দাবানল থামাবার বা ছড়িয়ে পড়া থামাতে নিয়ন্ত্রিত রেখার ভূমিকা অন্যতম । যদিও ছবিতে আমরা অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের হোস হাতে আগুন নিয়ন্ত্রন করতে দেখে থাকি কিন্তু আসল ঘটনা হলো বেশির ভাগ অগ্নিনির্বাপন কর্মকান্ড হয়ে থাকে পানির সংস্পর্শ ছাড়াই। বস্তুত দাবানল এলাকায় বা বনভূমিতে পানির সংস্থান নেই এবং দুর্গম পাহাড়ি পথঘাট বেয়ে পানি সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভবপর নয়। পানির ব্যবহার হয় সংকটপূর্ণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থাপনা যেমন রেডিও টাওয়ার অথবা কোনো এলাকা বসত বাড়িঘর অথবা স্পট ফায়ার নিয়ন্ত্রনে। পানি ব্যবহারের পরিবর্তে বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা আগুন ছড়িয়ে পড়তে বাঁধা দেন, নিয়ন্ত্রন রেখা তৈরী করেন, বন জ্বালানি (ফরেস্ট ফুয়েল) এবং জৈববস্তুপুঞ্জ সরিয়ে দেন যাতে নতুন কোনো স্থানে আগুন ছড়িয়ে না পরে। পানির সংস্পর্শ ছাড়া এই ধরণের কৌশলকে “ড্রাই ফায়ার ফাইটিং” নামে অভিহিত করা হয়। উল্লেখ্য যে অস্ট্রেলিয়ার বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা ড্রাই ফায়ার ফাইটিং কৌশল বাস্তবায়ন করতে পৃথিবীর অন্যতম সেরা অগ্নিনির্বাপন কর্মীদল। অত্যন্ত গরম, শুস্ক আবহাওয়া এবং প্রবল ঝড়ো বাতাসে ২০১৯/২০ দাবানল অনেকবার এত প্রবলভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের নিয়ন্ত্রিত রেখা তৈরীর কৌশলগত অগ্নিনির্বাপন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আন্ডার কন্ট্রোল ফায়ার অর পেট্রলড ফায়ার:
যখন কোনো আগুনের চারপাশে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত রেখা তৈরী করা যায় এবং যেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই সময়ে ভেতরের অংশটুকু পুড়ে যেতে দেয়া হয় যা “ব্ল্যাকইং আউট” নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে ওই এলাকায় বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা পায়ে হেটে হেটে সব আগুনের কাছে পৌঁছে সেটি নিভিয়ে ফেলেন এবং পুড়ে যাওয়া অংশের তাপ কমিয়ে ফেলেন যা “মপিং আপ” নামে পরিচিত। এ সময়টি বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের জন্য খুবই বিপদজনক। পুড়ে যাওয়া গাছ দুর্বল হয়ে যায়, গাছগুলো বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের উপর পড়তে পারে । মপিং আপ করার সময় বনের এসব দুর্বল কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ গাছ একের পর এক চিহ্নিত করে একে একে কেটে ফেলা হয়। আগুন নিভে গেলেও মপিং আপ করতে মাসখানেক সময় লেগে যায়। এ সময়টা অনেক অনিরাপদ- কাজেই অনেক রাস্তা বন্ধ রাখা হয়। যদিও বন অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা অসময়ে এই এলাকাতে পালাক্রমে টহল দিতে থাকেন।
সেফ ফায়ার:
দাবানলের সর্বশেষ অবস্থা হলো মপিং আপ পরবর্তী অবস্থা যখন বনের নিয়ন্ত্রিত রেখার ভেতরে আগুন লাগবার মতো কোনো উৎস আর অবশিষ্ট থাকে না যেখান থেকে আবার আগুন সূত্রপাত হতে পারে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে । কোনো দাবানল যখন নিরাপদ ঘোষণা করা হয় তখন সেখানে আর টহল দেবার প্রয়োজন থাকে না। পরবর্তী সময় বন ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ নিয়ন্ত্রিত রেখার মাঝে আবার নুতুন করে গাছ লাগিয়ে পূর্বের অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
বনের আগুনের এই সকল অবস্থা যেকোনো সময় আবহাওয়া জনিত কারণে বিশেষ করে গরম এবং ঝোড়ো বাতাসে পরিবর্তন হতে পারে।
চলবে ..
সালাহউদ্দিন আহমদ-সিনিয়র প্রজেক্টর অফিসার,
ভিক্টোরিয়ান ফরেস্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ও আলোকচিত্র শিল্পী।
আহমেদ আবিদ-গবেষক, মানবাধিকার, সমাজ ও সমন্বিত শাসন, ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি।