এই লেখাটি যখন লিখছি তখন অস্ট্রেলিয়ার সহস্র পরিবার গৃহহীন। এমন একটি সময়ে ভিক্টোরিয়ার সর্বসাধারণ বিধ্বংসী ব্ল্যাক স্যাটারডের ১১তম বর্ষ উদযাপন করছে। ভিক্টোরিয়ার ব্ল্যাক স্যাটারডের দাবানলে ১৭৩ জন মানুষ মারা গিয়েছিলো। আজকের দিনটিকে ঘিরে অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে যা। অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে প্যারেননি। একেক জন আরেকজনকে সান্তনা দিতে গিয়েও আবেগপ্রবণ হয়ে যান। অনেকে বলতে থাকেন আমাদের পোড়া মাটি ক্ষত আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে কিন্তু চলে যাওয়া মানুষ হারানোর বেদনায় আমাদের হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরী হয়েছে তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না, আর আমরা তোমাদের ভুলবো না।

শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ সালে ভিক্টোরিয়া বাসিন্দাগণ বিশেষ করে (এরিয়া ) এলাকার বাসিন্দাগণ চরম আবহাওয়ার অভিজ্ঞতার শিকার হন। দাবানল শুরুর আগে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত বাতাসের প্রবাহ। ফলশ্রুতিতে, ব্ল্যাক স্যাটারডের বিগত কয়েকদিন আগে বেশ কয়েকটি উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। সারাদিনে সারা ভিক্টোরিয়ায় তেমন মেঘ ছিল না, বেশিরভাগ জায়গা ছিল সূর্যকরোজ্জ্বল। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২৩ ডিগ্রী বেশি। ভিক্টোরিয়ার অনেক স্থানের তাপমাত্রা ছিল রেকর্ড তাপমাত্রার উপরে। মেলবোর্ন শহরে ৪৬.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যেটি ছিলো মেলবোর্নের ইতিহাসে অন্যতম। পার্শ্ববর্তী এলাকা পোর্ট ফিলিপ (আ্যভালন এয়ারপোর্ট) এবং হোপেটোন যথাক্রমে ৪৭.৯ এবং ৪৮.৮ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এই রেকর্ড গুলো এই শহরগুলোর ১৫৪ বছরের রেকর্ডকে অতিক্রম করে।
এ সময়ে তাসমান সাগরের উপর একটি ধীরে অগ্রসরমান উচ্চচাপ (হাই-প্রেসার সিস্টেম) বিরাজ করছিলো যার সামনের দিকে ছিল একটি সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর ট্রফ (নিম্মচাপের নিম্ন অংশ যেখানে উচ্চচাপ শুরু হয়) যার প্রভাবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় গরম বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার দিন বিকেল নাগাদ প্রবল বেগে উত্তুরে বাতাস বইতে থাকে, একই সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে আসতে থাকে ঠান্ডা বাতাস । ঠান্ডা আর গরম বায়ুর সংমিশ্রনের প্রভাবে শক্তিশালী ঝড়ো বাতাস, শুষ্ক বায়ু (নিম্ন আদ্রতা) এবং বিরাজমান উচ্চ তাপমাত্রা (দেখুন প্রব ১) চরম আগুনের লাগবার মতো পরিস্থিতির তৈরী করে কুল চেঞ্জার ফ্রন্টের আগে আগে আগাতে থাকে। যখন কিনা বাতাসের দিক পরিবর্তন হতে থাকে, সে সময়টি দাবানলের মত বিপদজ্জনক ঘটনা ঘটে।
ছবি : ভিক্টরিয়ার ২০০৯ সালের দাবানল। ছবি সূত্র : ব্যুরো অফ মেটেওরোলজি।
১৯৯৭ – ২০০৯ সালগুলো ছিল অত্যন্ত শুস্ক। বস্তুত মাটির আদ্রতা ছিল রেকর্ড পরিমান কম। ধারণা করা হচ্ছিলো বড় মাপের কোনো দাবানল হতে পারে। এই ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি মাসগুলিতে দাবানল সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণে তথ্য ভিক্টোরিয়ান সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৯ জানুয়ারী গণমাধ্যমের প্রকাশনা, ঘটনা ও সংবাদ সম্মেলনগুলি জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। জানুয়ারীর শেষের দিকে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে প্রতিবেদনগুলো তীব্রতর হয়। ৩০ জানুয়ারি এবং ৫ ফেব্রুয়ারির সময়ে ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার(প্রধানমন্ত্রী) বেশ কয়েক বার জনসাধারণকে সজাগ হবার আহ্বান জানিয়ে সাধারণ বিবৃতি দেন তাতে শুস্কতার(ড্রাইনেস) কথা বিশদ ব্যাখ্যা করেন। ৪ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ভিক্টোরিয়ার পরিবেশ মন্ত্রনালয় (ডিএসই), মেট্রোপলিটন ফায়ার, কান্ট্রি ফায়ার অথরিটি এবং ইমার্জেন্সি সার্ভিস এক যুক্ত বিবৃতিতে ৬-৭ তারিখের আগুন লাগবার উপযুক্ত আবহাওয়া (ফায়ার ওয়েদার) হুমকি – ঝুঁকি ব্যাখ্যা করেন। তারা বলেন দাবানল শুরু হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আবহাওয়া আগুন ছড়ানোর হারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কয়েকটি মৌলিক বিষয় আগুন ছড়ানোর হারকে নিয়ন্ত্রণ করে যেমন তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আদ্রতা, বায়ুর গতি আর দিক এবং বায়ুমণ্ডলীয় স্থিতিশীলতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৬-৭ ফেব্রুয়ারি সময়ে ঐ সকল বিষয়গুলো ছিল চরম এবং কোন কোনো ক্ষেত্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী।
৭ ফেব্রুয়ারি তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, ১১টা নাগাদ ভিক্টোরিয়ার সর্বত্র তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির (সে:) উপরে উঠে যায়। মাটির আদ্রতা ছিল ২০% এর কাছাকাছি, প্রবল বাতাস উত্তর-পশ্চিমের বাতাস মাটির কাছাকাছি পৌঁছে ফলে বিকেল নাগাদ আদ্রতা ১০% এ চলে আসে।
কিলমোর এলাকায় বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ১১:৪৫ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। প্রেটি স্যালি ফায়ার টাওয়ার থেকে ১১:৪৭ মিনিটে প্রথম আগুনের কুণ্ডুলি দেখা যায়। ১১:৪৯ মিনিটে সি,এফ,এ তে আগুন রিপোর্ট করা হয়। ১১.৫০ মিনিটে কিলমোর,বোর্ডফোর্ড, কলনবিনান, উনডং এবং ওয়ালান ফায়ার বিগ্রেড সাড়া দেয় ( যারা হিউমে হাইওয়ে ধরে মেলবোর্নে – সিডনি যাতায়ত করেন তাদের কাছে এই এলাকাগুলো বেশ পরিচিত)। ১২:০৩ মিনিটের মধ্যে আগুনের ব্যাপকতা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে আরও ৭ টি ফায়ার বিগ্রেড তলব করা হয়। বিকেল ৩:৩০ এর মধ্যে অবসন্ন প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পুড়ে যায়। ৪ টার মধ্যে আগুনের ব্যাপকতা অনেক বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার কথা বিবেচনায় সকল বিগ্রেডকে নির্দেশ দেয়া হয় শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য যা করণীয় তা করতে। বিকেল ৫ টায় প্রথম হতাহত খবর পাওয়া যায় । ৫:৪৫ নাগাদ রেড ফ্ল্যাগ (সর্বোচ্চ সতর্কতা) জারি করা হয় । সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে আগুন হিউমভিল, ইয়াড়াগেলেন, হিলসভিলে পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। ১১৫০ জনের বিশাল অগ্নিনির্বাপন কর্মী জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানুষের জীবন বাঁচাতে। বিধ্বংসী এই দাবানলে ১,২৪২টি বাড়িঘর পুড়ে যায়, এতে ১১৯জন মারা যান, ২৩২ জন মারাত্বক ভাবে অগ্নিদগ্ধ হন, ৫০০০ জন হতাহত হন । ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
গত ১১ বছরে ভিক্টরিয়ার ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট নেয়া পরিবর্তন হয়েছে। প্রস্তুতি নিতে প্রতিক্রিয়া করতে এবং পুনরুদ্ধার কর্মের জন্য অনেক যে বিষয়গুলো প্রয়োজন তা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ভিক্টরিয়ার ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন হয়েছে, কমুনিটির কল্যাণ নিশ্চিত করা সেই কেন্দ্রবিন্দুর অন্যতম।
অস্ট্রেলিয়া তাদের পেছনের কর্মকান্ড থেকে শিখেছে এবং ক্রমাগত শিখছে, পরিবর্তন আসছে, নতুনকে গ্রহণ করা হচ্ছে।
চলবে ..
সালাহউদ্দিন আহমদ–সিনিয়র প্রজেক্টর অফিসার,ভিক্টোরিয়ান ফরেস্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ও আলোকচিত্র শিল্পী।
আহমেদ আবিদ–গবেষক, মানবাধিকার, সমাজ ও সমন্বিত শাসন, ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাদুয়াবিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি।