অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি ও একজন মোহাম্মাদ শাহে জামান টিটু -শিমুল শিকদার

  
    

বাংলাদেশীরা বিদেশে যাওয়ার সময় সুটকেস ভর্তি কাপড় চোপড়, খই মুড়ি চিঁড়া নাড়ু, পাটা-পুতা, কাঁথা বালিশ এসব নানান ছাতা মাথার সাথে নিয়ে আসে এক বুক ভরা স্বপ্ন। বিদেশের নুতন মাটিতে সে স্বপ্নের বীজ ছিটিয়ে দেয়। সার দেয়, পানি দেয়। স্বপ্নের গাছ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, সে গাছে ফুল, ফল ধরার আগেই মানুষগুলোর জীবনের তেল ফুরিয়ে যায়। স্বপ্নের গাছটি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এরকম এক স্বপ্নের বীজ বুনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফুল ধরিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন অল্প বয়সী বাংলাদেশী এক তরুণ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রাখার কিছুকালের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার সরকারী দল থেকে সংসদের গদিতে বসে অস্ট্রেলিয়ার ভাগ্য নির্ধারক হওয়ার একখান টিকেট বাগিয়ে ফেলেন। তা কোন ছল চাতুরী দিয়ে নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়েই। খবরটা শুনে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলাম। দেশে থাকতে জানতাম, সংসদ সদস্য হতে গেলে বড় নেতা হতে হয়। এই তরুণ ছেলেটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আরেক দেশে এসে অনেক বিদেশীদের পেছনে ফেলে বড় এক নেতা বনে গিয়েছেন। কল্পনায় দেখতে লাগলাম, পার্লামেন্টে মোটা মোটা সাদা বিদেশীদের মধ্যে দাড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশের সেই ছেলেটি হাত নেড়ে নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমরা ঘরে বসে টিভিতে সেই কাণ্ড কারখানা দেখছি। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! ছেলেটিকে বললাম, এ তো এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো। আজ থেকে শত বছর পরে এই অস্ট্রেলিয়ার বুকে যখন বাংলাদেশীদের ইতিহাস লিখা হবে, তখন এই ঘটনাটিও উঠে আসবে। এর কিছুদিনের মধ্যেই দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে তরুনটি বানানো পথ ধরে অনেকে হাঁটতে শুরু করেছেন। মনে মনে ভাবলাম, বাহ! এই ধারা বেয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে অনেকেই এই দেশের রাজা, মন্ত্রী, উজির, নাজির হবে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে?

২০১৬ সালে ফেডারেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শাহে জামান টিটু, ছবি: টিটুর ফেসবুক পেজ।

দেশ থেকে বিদেশে আসার সময় আমরা ব্যাগ ভর্তি অনেক কিছুর সাথে আরো কিছু জিনিস লুকিয়ে নিয়ে আসি। সেগুলো হলো মিথ্যা, হিংসা, ছলচাতুরী, দলাদলি। নানান ছুতায় দূষিত এই পদার্থগুলোকে ছড়িয়ে দেই বিদেশের মাটিতে। অস্ট্রেলিয়ার মুলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের প্রবেশের পর অবস্থা দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। দেশ থেকে এরা যে অসত্য এতদুর বয়ে নিয়ে এসেছে, নিজ দেশে রাজনৈতিক যে দলাদলি শিখে এসেছে তার বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে এদেশের রাজনীতিতে। কে কাকে টেনে নামাবে ইতিমধ্যে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশীদের এই দলাদলির দেখে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিবিদরা হতবাক। তাঁরা ভাবে, একি! এ আবার কেমন জাত! নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করে। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী রাজনীতিবিদরা দিনে দিনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ায় দোষের কিছু নাই। দোষ হয় তখনই, যখন তারা ভাবে, সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যেতে পারে, করা যেতে পারে ছলচাতুরী। অসৎ পথে সফলতা এলে, প্রশংসা হয়তো কিছুটা মেলে, কিন্তু ভালবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা মেলে না। এসব পেতে দরকার হয় উদারতা, সরলতা, নিষ্ঠার। এই ভক্তি, এই ভালবাসা এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় রাজনীতি করা কোন বাংলাদেশীর ভাগ্যে যদি জুটে থাকে, তবে তা সেই তরুনটির, যার নাম মোহাম্মদ জামান টিটু।
মোহাম্মদ জামান টিটু কতোটা সৎ, তা আমি দাঁড়িপাল্লা নিয়ে মাপতে বসিনি। রাজনীতির পথ বড় জটিল, পিচ্ছিল, ঘোলাটে। সে পথে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে খেয়ে তাদের চলতে হয়। রাজনৈতিক দরজার পেছনের কলকাঠি নাড়িয়ে তাদের টিকে থাকতে হয়। পৃথিবীর সমস্ত রাজনৈতিক নেতারাই এই সত্য মেনে নেয়। তাই দরজার পেছনের কার্যকলাপ দিয়ে রাজনৈতিকদের যাচাই করা জনগণের পক্ষে দুরূহ এক কাজ। আঁখ মারাই করার পর রসটুকু দিয়ে আঁখের গুনাগুন মাপা হয়। তেমনি রাজনীতিবিদরা যে রসটুকু দু’হাত ভরে দরজার বাইরে অপেক্ষায় থাকা জনগনের জন্য নিয়ে আসেন সেটুক দিয়ে রাজনীতিবিদদের বিচার চলে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলতে পারি, মোহাম্মদ জামান টিটু মিথ্যাকে সত্যের সাথে মিলিয়ে জল ঘোলা করবেন না, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

তাঁর জীবনে যে বিপর্যয় টেনে নামানো হয়েছে, তা অবশ্যই রাজনীতি নাটকের উত্থান পতনেরই একটি অংশ। এ মেঘ কেটে যাবে। কারণ, তাঁর নির্লোভ নিষ্ঠার অনেক অতীত দৃষ্টান্ত রয়ে গেছে। যুগে যুগে সফল মানুষদের অর্জনকে কলঙ্কিত করার অনেক নজির আমাদের সমাজে আছে। তাতে সৎ মানুষের পথ হয়তো সাময়িকভাবে আটকে রাখা যায়। কিন্তু বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তাঁরা বেরিয়ে আসবেনই আসবেন। অসৎরা তখন টের পাবে, তাদের মিথ্যা এ দম্ভ আর টিকলো না। কারণ, নূতন যারা রাজনীতিতে এসেছেন তাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই দেখেছি, মিথ্যাকে মন থেকে সরিয়ে সামনের দিকে তাকাতে শিখেছেন। মোহাম্মদ জামান টিটু নিজ থেকে হেরে গিয়েছেন ভবিষ্যতের দিনগুলোকে জয় করবার জন্য। এই থেমে যাওয়াই শেষ না। এর পরেও আরো অনেক রয়ে গেছে। কারণ, পরাজয়ের উঠান পেরোলেই জয়ের দেখা মেলে। মোহাম্মদ জামান টিটু যতদিন পর্যন্ত মানুষগুলোর প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর সমাজের প্রতি দায়ভারটুকু উপলব্ধি করতে থাকবেন, সমাজও তাঁর পুনরুত্থানের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে।

র‍্যাবি,সিডনি ৩ এপ্রিল, ২০২০।

শিমুল শিকদার
: গল্পকার, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments