যখন কোনো একটি দেশের সরকার দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে, ‘আমরা একজন মানুষকেও করোনায় মরতে দিতে চাই না। তার জন্য যা কিছু করা দরকার, তাই করবো’। একটি দেশ যখন তার দেশের নাগরিকদের জন্য মাথাপিছু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করে, তখন সত্যিই তা করা যায়। তাই তো অস্ট্রেলিয়া ‘করোনা যুদ্ধ’ জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা, সাউথ অস্ট্রেলিয়া (এডিলেইড), ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (পার্থ) এবং নর্থদার্ন টেরিটোরিতে এখন করোনা সংক্রমনের হার শূন্যতে নামিয়ে এনেছে। এখন লক ডাউন তুলে নেয়ার কথা ভাবছে। তবে লক ডাউন তুলে নিলে আবার যদি করোনার দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ওয়েভ আসে, তাহলে কি করবে? সেই ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করেছে। গত কয়েকদিন আগে “COVID SAFE” নামক একটি মোবাইল ফোন এপ্লিকেশন এনেছে। দেশের মানুষকে তা মোবাইলে ইন্সটল করার জন্য অনুরোধ করেছে। মাত্র পাঁচ দিনে ৪০ লাখের বেশি মানুষ ইন্সটল করেছে এবং এখনো করছে। উক্ত মোবাইল এপ্লিকেশনের মাধ্যমে খুব সহজেই করোনা রোগীকে শনাক্ত এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করা যাবে। এ ছাড়াও হাসপাতালগুলোতে প্রচুর সংখ্যক আইসিইউ বেড বৃদ্ধি করেছে। স্থানীয়ভাবে পিপিই (মাস্ক, গ্লাভস এবং নিরাপদ পোশাক) এবং ভেন্টিলেটর তৈরির ব্যবস্থা করেছে।
অস্ট্রেলিয়াতে এখন পর্যন্ত করোনা টেস্ট করা হয়েছে ৬,১১,৫৮৩ জনের, যা মোট জনসংখ্যার ১.১%। দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭৮৩ জন। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৩ জন (মৃত্যু হার ১.৩৭%), যা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এই মুহুর্তে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মোট ৭৯ জন, যাদের মধ্যে আইসিইউতে ২৮ জন। সুস্থ হয়েছেন ৫৭৮৯ জন (টেবিল-১ এবং চিত্র-১)। এখনও অসুস্থ আছেন ৮৯৯ জন। প্রথম কেইস ধরা পড়েছিল ২২ জানুয়ারি ২০২০, সর্বোচ্চ সংখ্যক কেইস পাওয়া গিয়েছিল মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে এবং এখন আক্রান্তের হার কমে যাচ্ছে। গত সাত দিনে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৮৯ জন (চিত্র-২)।

সুত্রঃ ২ মে ২০২০, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, অস্ট্রেলিয়া।


অস্ট্রেলিয়ার করোনা এপিসেন্টার নিউ সাউথওয়েলস (সিডনি); এখানে আক্রান্ত এবং মৃত্যু সংখ্যা দুটোই বেশি। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩০৩১ জন এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৪১ জন। আক্রান্তের সংখ্যা সর্বনিম্ন নর্থদার্ন টেরিটোরিতে মাত্র ২৯ জন এবং সেখানে এখনো কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি (চিত্র-১)।
অস্ট্রেলিয়ায় করোনায় আক্রান্ত রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় ৬৩.৫% মানুষ অন্য কোনো দেশ থেকে করোনা আক্রান্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছেন। ৩৬.১% অস্ট্রেলিয়াতে আক্রান্ত এবং ০.৪% এর বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অনুসন্ধান চলছে (চিত্র-৩)।
অস্ট্রেলিয়াতে বয়সের বিবেচনায় ৩০-৬০ বছর বয়সী মানুষেরা সবচেয়ে বেশি (৪৪.৪%) আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের মধ্যে প্রায় ৩০.৭% ( টেবিল-১)। তবে ৭০ বছরের বেশি মানুষের মধ্যে মৃত্যু হার বেশি। সার্বিক বিবেচনায় লিঙ্গভেদে নারী-পুরুষের আক্রান্তের হারের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে ২০-২৯ বছর বয়সী আক্রান্ত মানুষের মধ্যে নারীদের হার পুরুষের তুলনায় বেশি (৫৬.৩%)। ৬০-৮৯ বছর বয়সী পুরুষরা একই বয়সী নারীদের তুলনায় বেশি মারা গেছে (চিত্র-৩)।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩,২৮,৪২৫, মৃত্যু ২,৪৩,৮৩২ এবং মৃত্যুর হার ৭.১১%। আক্রান্তদের মধ্যে ১০,৯৩,১৯৯ জন সুস্থ হয়েছে (সুত্রঃ ৩ মে ২০২০ জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি)। আক্রান্তের তালিকায় শীর্ষে অবস্থিত দেশ গুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ১১,৩৩,৪৬১ জন। তার মধ্যে ৬৪,৯৪৩ জন মৃত্যু হয়েছে। শীর্ষে থাকা অপর দেশগুলোর মধ্যে স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ইরান, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এ দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা (৫ দিন গড়ে) কমে কিছুটা কমছে। কিন্তু ব্রাজিল, ইকুয়েডরসহ ল্যাটিন আমেরিকায় ভয়াবহতা বাড়ছে। মৃত্যুর হার এর দিক দিয়ে শীর্ষে বেলজিয়াম (১৫.৭%) ও যুক্তরাজ্য (১৫.৪%)। এখনো প্রতিদিন ৮০-৯০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, ৩-৪ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং চীনে দুই লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। ইকুয়েডরের রাস্তায় এখনো শত শত লাশ পড়ে আছে। তবে আশার কথা, বিশ্বব্যাপী করোনা আক্রান্তের হার ধীরে ধীরে কমছে (চিত্র-৪)।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এই সাফল্যের রহস্য কি? জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়াতে করোনা ভাইরাস দেখা দিলে ১৯ মার্চ দেশটি তার সব ধরনের সীমানা (আকাশ এবং জল পথ) বন্ধ করে দেয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি সরকার বিশেষভাবে মনোযোগী হয়। প্রচুর সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীকে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং স্বাস্থ্যখাতে দ্রুত বাজেট এবং লোকবল বৃদ্ধি করে। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্সদের কাজে ফিরিয়ে আনে। সারাদেশে একযোগে লক ডাউন ঘোষনা করে এবং তা শতভাগ কার্যকর করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার জনগণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলো তাতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
কন্টাক্ট ট্রেসিং এর মাধ্যমে কমিউনিটি সংক্রমনকে কন্টেইন্ড করতে সমর্থ হয়। একই সাথে ব্যাপক হারে করোনা টেস্ট (পিসিআর) অব্যহত রাখে। প্রতি দশ লাখ লোকের মধ্যে ২৩,৯৮৪ জনকে টেস্ট করেছে এবং করোনা বিস্তার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। এমন কি নিয়মের ব্যতয় ঘটানোর অভিযোগে একজন মন্ত্রীকে পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়। নিত্য-পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য সরকার নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সফলতা পায়। করোনার কারনে বেকার হয়ে যাওয়া মানুষদের বেকার ভাতা প্রদান, বাড়ির মর্টগেজ (ব্যাংক পেমেন্ট) ছয়মাসের জন্য স্থগিত, পেনশন ফান্ড থেকে দশ থেকে বিশ হাজার ডলার পর্যন্ত উত্তোলনের সুযোগ, এবং ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্ট মওকুফ কিংবা স্থগিত করে দেয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহনে কোনো রকম সময়ক্ষেপণ করেনি কিংবা দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি এবং উটপাখি সংঘের (The Ostrich Alliance) সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, বেলারুশ, তুর্কমেনিস্তান এবং নিকারাগুয়া) হয়নি। কিংবা হার্ড ইমিউনিটির কথাও চিন্তা করেনি। যার ফলে অস্ট্রেলিয়া এই মুহুর্তে করোনা নিয়ন্ত্রনে একটি বৈশ্বিক মডেল। কারণ দেশটি ইতোমধ্যে করোনায় মরবিডিটি এবং মরটালিটি কার্ভকে প্রায় ফ্লাটেন (সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা) করতে পেরেছে। এছাড়াও করোনা রোগীদেরকে উচ্চ হারে সুস্থ করে তোলার দিক থেকেও ঈর্ষনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। যখন সারা বিশ্বের মানুষ একটি কার্যকরী টিকা কিংবা ঔষধের জন্য প্রতীক্ষা করছে, তখন টিকা কিংবা ঔষধ ছাড়াও যে এই ভয়ংকর মহামারীকে ঠেকিয়ে দেয়া যায়, অস্ট্রেলিয়া তা খুব ভালোভাবে প্রমান করেছে।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেনঃ
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন এবং ড. মোঃ দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার, এপিডেমিওলজিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। ডা. রিদওয়ানা মেহের মান্না, ডা. মেহেদী হাসান, ডা. আনিকা নাজিয়া, মুনিয়া আফরোজ, ডা. কাজী ফারহানা মতিন, ডা. শামিমা নাসরিন, ডা. ফাজ্জারনা উইয়ন সিথি, ডা. আমেনা বিনতে আউয়াল, ডা. সুজমিন সরকার, ডা. মেহনাজ শারমিন চৌধুরী এবং ফাতেমা ফেরদৌসী, শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক হেলথ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।