যেখানে যে অবস্থায় আমাদের উপস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মিথষ্ক্রিয়া তার বাইরের কথা আমারা কিভাবে কিভাবে বুঝবো ? তার পূর্বে আমাদের ভেবে দেখতে হবে সীমানার বাইরের রহস্য উন্মোচন কেন জরুরী। অনেকেই এসব ভাবনায় জড়াতে চান না এ ভেবে পাছে তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। আমি তাদের এ ভাবনার সাথে একমত নই; কারন স্বাভাবিক জীবনের যে বস্তুগত ও ভাবগত উপাদান রয়েছে তার প্রকৃত উপলব্ধির অভাবে জীবন অর্থহীন এবং অসার। প্রতিনিয়তই সম্পর্কের সংঘাত, পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি, মানসিক দ্বন্দ, সামাজিক বিশৃংখলা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি যা কিনা স্বাভাবিক জীবন যাপনকে কলুষিত করে, তাদের সৃষ্টি ঐ জীবন সংশ্লিষ্ট উপাদান সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধির অভাব থেকে। সুতরাং চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত করা জরুরী। প্রশ্ন আসে যে, সীমাবর্হিভূত বিষয়গুলির রহস্য কিভাবে রহস্যমুক্ত করা যায়।রহস্য বা রহস্যময় শব্দদ্বয়ের মধ্যে আমি ক্ষমতাহীনতার বা অজ্ঞতার অস্তিত্ব খুজেঁ পাই।জেনে-শুনে অক্ষমতাকে কে বহন করতে চায়? তবে অক্ষমতাকে জ্ঞান ও যুক্তিযুক্ত চিন্তা দ্বারা বিলুপ্ত করার চেষ্টাটি কিছুটা হলেও অক্ষম অস্তিত্বটির প্রচ্ছন্ন পরাজিত রূপ দংশন থেকে মুক্তি দেয়। মুক্তিতে আরাম বোধ হয়; আর প্রাণীরাতো সর্বদা আরামের দিকেই ধাবিত।রহস্যমুক্ত করা বা তার প্রয়াশটি আমাদের সুস্থ, সুন্দর আর প্রশান্তিময় অবস্থা উপহার দেয়।
প্রাণ যেহেতু আছে, প্রাণের চাহিদা মেটানোইতো প্রাণীর সহজাত প্রবৃত্তি। প্রাণের অনেক চাহিদার একটি হলো অস্তিত্বের রহস্যকে রহস্যহীন করা। কিভাবে সম্ভব রহস্যহীন করা?
অবাক লাগে মানুষের জন্ম প্রক্রিয়াটি নিয়ে ভাবলে। অবাক হই এই ভেবে যে, পৃথিবীটি তার এত ওজন নিয়েও শূন্যে ভাসমান। অবাক হয়ে ভাবি মানুষের মস্তিষ্কের কাজ দেখে। আমরা সাধারণত: আমাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়েই সব কিছুর উপসংহার টানার চেষ্টা করি।অভিজ্ঞতা অন্যরকম হলে কি সব প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলি রহস্যময় বা মিথ্যার কাছাকাছি চলে যেত না? একটা পিপঁড়ার কাছে তার অভিজ্ঞতা লব্ধ ভাড়ের অনুভূতিটি আমার কাছে কতটা সত্য? সময়ের অনুভূতিটি যে প্রাণীর পূর্ণ জীবনচক্র সাতদিনে সীমাবদ্ধ সেটি বনাম শতবর্ষ জীবনচক্রে সীমাবদ্ধ আমাদের সময়ানুভূতিটির মধ্যে পার্থক্য আছে কি? সম্পূর্ণ জাগতিক বা মহাজাগতিক ধারনাগুলো শুধুই আপাত বা আপেক্ষিক নয় কি? আগুনের ভংয়কর তাপমাত্রাটি কি শুধুই আমাদের সহনীয় ক্ষমতার উপর অনুভূত নয়? আমাদের তাপ সহনীয় ক্ষমতা সহশ্র ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে আগুনের উত্তাপটি নিশ্চয়ই অসহ্য হতো না। পদার্থের ধর্ম ও আচরন যা দেখছি ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা মূলত: পদার্থের ভড়, গতি, ভারসাম্য, আকৃতি ও রাসায়নিক গঠনের উপরই ভিত্তি করে করা হয়েছে। এই ভড়, গতি, ভারসাম্য, আকৃতি ও গঠন আবার পৃথিবী নামক গ্রহটির উপাদানের সন্মিলিত প্রভাব এবং মহাজাগতিক অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র ও শূন্য স্থানের প্রভাবের উপর নির্ভরশীল। একটি সতত পরিবর্তনশীল আপেক্ষিক মানদন্ডের উপর রেখে আর একটি বস্তুর ধর্মকে কিভাবে পরম বলে আখ্যায়িত করা যায়? তাহলে সবই আপেক্ষিক, পরম বলতে কিছু নেই। অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে ধারনার পরিবর্তন ঘটতে পারে। সুতরাং আমাদের সামগ্রিক ধারনাটিই হয়তো অন্যরকম। শূণ্য সম্পর্কে আমাদের ধারনা, সূচনা বা শুরু বলতে আমরা যা বুঝি, দৃশ্যমান না থাকা ও স্পর্শানুভূতিহীনতা মানে কোনকিছুর অস্তিত্বহীনতার ধারনা কতটুকু সত্য? সব কিছুর সূচনা কখন হলো? শুরু ও সময় গুরত্বপূর্ণ। শুরু নেই, অবস্থাটি চলমান । আমাদের বোধগম্যতার ক্ষমতা অনুযায়ী শুরুর দাগটি আমরা দিয়েছি। বিস্কিট তৈরীর শুরু কোনটি? উপাদান সংগ্রহ? উপাদান উৎপাদন? না কি উপাদান মিশ্রণ? কে তৈরী করে? উপাদান সংগ্রহকারক? উৎপাদক না কি প্রক্রীয়াকারক? সিদ্ধান্তটি নির্ভর করে কৃতিত্বের মুকুটটি কাকে পরাবো তার উপড়। অতএব, প্রক্রীয়াটি চলমান এবং স্রষ্টা হলো সামগ্রীক আয়োজনের সন্মিলিত প্রভাব। কখন থেকে মহাজগতের আয়োজনটি? সময় সম্পর্কে আমাদের সংজ্ঞা, বোধ ও সময়ের সাথে সম্পূর্ণ আয়োজনটির পরিবর্তন বা বিবর্তনের ধারা উপলব্ধির বর্তমান ক্ষমতাটি শুধুই আমাদের অর্থাৎ মানুষ প্রজাতির। এক বিলিয়ন বছরের ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটু ধারনা করুন। এটা কল্পনাতীত । এই ব্যাপ্তি কালের পরিবর্তনগুলি বা বিবর্তনগুলি কতটা আমরা সন্নিবেশ করতে পেরেছি? এই পরিবর্তন বা বিবর্তনগুলি কিছুটা ধারনা করার জন্য কসমিক ক্যালেন্ডারের সাহায্য নেয়া হয়েছে যেখানে ৪৩৭.৫ বছরকে এক সেকেন্ড ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য সময়ের সাথে পরিবর্তন গুলি অনুধাবন করা। একটি গাছের বড় হওয়া কিংবা একটি শিশুর বড় হওয়ার ধারাটি আমরা সাধারণত দেখতে পাই না; কিন্তু যদি এক বছরের সময়ের ব্যাপ্তিকে অনুধাবনযোগ্য এক সেকেন্ডে রূপান্তর করা যায়, তবে সহজেই সেই পরিবর্তন গুলি খেয়াল করা সম্ভব।তাহলে সময়ের ধারনা আমাদের অনুভব ও উপলব্ধি করার ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আমাদের সীমাবদ্ধতার বাইরে হয়তো এক বিলিয়ন বছর এক সেকেন্ডের মত! তদ্রূপ, শূন্য মানে কিছু না, এই ধারনায় বস্তুকে অর্থাৎ পদার্থকেই বিবেচনা করা হয়েছে। পদার্থের অনুপস্থিতি মানে শূন্য এ ব্যাপারটি আমাদেরই সৃষ্টি। আলো কনিকা যা কি না শক্তির একটি রূপ, চুম্বক ক্ষেত্র, তড়িৎ শক্তি ও অসংজ্ঞায়িত অন্যান্য কিছুর উপস্হিতিকে শূন্য বিবেচনা করা যুক্তিবিরুদ্ধ । আমাদের বোধগম্যতাকে আদর্শ ধরে যা তা উপসংহার টানলে সাময়িক স্বস্তি লাভ হয় কিন্তু স্বস্তিতে আসল ব্যাপারটি জানা হয়ে গেছে তা নিশ্চিত নয়। আর একটি উপাদান যাকে আমরা স্থান বলে জানি অর্থাৎ যেখানে আমাদের অবস্থান তার উপর আমাদের বোধগম্যতা নির্ভর করে। এমনটিওতো হতে পারে যে, আমরা মানুষ প্রজাতি ও চতুর্পাশের সবকিছুই কোন একটি অজানা অনেক বড় প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়, যেখানে প্রক্রিয়াটি অনন্তকাল ব্যাপী চলমান আর বোধগম্যতার মধ্যে ঐ পর্যায়টির ব্যাপ্তী ধরা যাক আনুমানিক একশত বিলিয়ন বছর। প্রতি দশ হাজার বছরে পর্যায়টির যে পরিবর্তন বা বিবর্তন তা মূল পর্যায়টির সম্পূর্ন পরিবর্তনের দশ মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ০.০০০০০০১ অংশ। তাহলে এটি নিশ্চিত যে মানুষের পক্ষে এই পর্যায়টির পরিবর্তনের বা বিবর্তনের অনুভব সম্ভব নয়; সম্পূর্ন প্রক্রিয়াটিতো অনেক দূরের কথা।
অতএব, যে মঞ্চে আমাদের অবস্থান, সেটি কল্পনাতীত বিশাল; যে ধারনাসমূহ আমরা পোষন করি তাও হয়তো ভিন্ন। যেমন, উপর ও নীচ শুধুমাত্র ভূমির বিবেচনায়ই সংজ্ঞায়িত কিংবা কোন কিছু হতে হলে তার একজন প্রস্তুতকারক থাকতে হবে অথবা সম্পূ্র্ণ আয়োজনটিকেই আমরা প্রস্তুতকারক বলছি এরূপ মতবাদ, ধারনা ও বিশ্বাস।
আমরা এবং আমাদের সর্বদিকে যা কিছু আছে অর্থাৎ যা দৃশ্যমান সেগুলির অস্তিত্ব, গঠন ও কার্যপ্রনালী যেভাবে বুঝতে চেয়েছি সেভাবেই বুঝেছি। ক্ষতি নেই এ বুঝে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং আমাদের অস্তিত্ব ও ধারনা কতটা আপেক্ষিক তা অনুধাবন করার জন্যই উপরের ব্যাখ্যার অবতারনা। কোন কিছুই অসম্ভব নয়। অনেক অদেখা ঘটনাও ঘটতে পারে। যেমন, সমুদ্রের পানিও দুই ভাগ হয়ে মাঝখানে ফাঁকা রাস্তা তৈরী হতে পারে যদি প্রতিটি ভাগের পানির ঘূর্নন বিপরীত দিকে হয় এবং তীব্র গতিতে হয়। আমাদের প্রাণের স্ফুরণ যেভাবেই হোক না কেন, আমরা আমাদের প্রাণের আরামটিকেই প্রাধান্য দিব। প্রাণের প্রতিটি স্পন্দনকে সাবলিল ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহারেই আত্মার প্রশান্তি। মতবাদ ও বিশ্বাস যেহেতু একক ব্যক্তির আত্মতৃপ্তির ভিত্তি সেহেতু সেগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করে সে ব্যক্তির বিশ্বাসের ঘরটি ভেঁঙ্গে দেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই যুক্তি সংগত।
ধারনা যাই হোক, এটি অন্তত পরম সত্য যে, আমাদের প্রাণের অস্তিত্বটি আসলেই অতি তুচ্ছ ও নগন্য। তাহলে আমাদের কি করনীয়? যা করনীয় তা হলো,প্রাণের সম্পূর্ণ ও সর্বোচ্চ নির্যাস আহরনে সাবলীল পদচারনা। অস্তিত্বের ক্ষনস্থায়ীত্বটি মাথায় রেখে ছোট ছোট নির্মল সুখের বিষয়গুলিতে অবগাহন করাই মানবের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিৎ। মনে রাখা জরুরী যে, সুখগুলি যেন হয় নির্মল ।
স্রোতস্বিনী নদী যার দুধারে ঘন সবুজ ও কাশফুলের সমারোহ তার কলকলে-ছলছলে বুকে হিমেল হাওয়ায় পাল ফুলানো নৌকা গুলির অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্য অনুভব , বৃষ্টিস্নাত কদম-গন্ধরাজ আর শীতের সকালে শিশিরে ভেজা শিউলির রূপ-গন্ধ-মোহে মুগ্ধতা, ভালবাসায় আর আহলাদে প্রিয় মানুষগুলির সংস্পর্শানুভূতির মত ছোট ছোট বিন্দুসম অনুভবগুলি যদি মহাসমূদ্রতূল্য জীবনের উপাদান হয় ক্ষতি কি? ধারনাগুলি এরকম যে, জীবনকে উপভোগ্য ও প্রানবন্ত করার উদ্দেশ্যে এরকম সহস্রাধিক সুখানুভূতি ও আরামের উপাদান গুলির প্রাপ্তি নিজের জন্য ও অপরের জন্য নিশ্চিত করা। সুবিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কার্যপ্রনালী সমূহ যুক্তি দিয়ে অনুধাবন এজন্যই প্রয়োজন যেন আমরা বেপরোয়া হয়ে না যাই। কোন কিছুর প্রাপ্তিতে অতি আহলাদ এবং হারানোর দু:খে ভেঁঙ্গে পড়াটাকে বিশালত্বে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব ভাবনা দিয়ে প্রশমিত করা যায়। সীমাবদ্ধতায় সীমিত প্রাণটিকে অসীম উপলব্ধির মহাসাগরের উদারতায় মহাপ্রাণ তো করাই যায়।
দীন মোহাম্মদ মনির: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।