অহেতু বুদ্বুদঃ মনৌষধি নান্দনিক কাব্য – শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    

অনেকেই হয়তো জাহিদ সোহাগ এর ‘অহেতু বুদ্বুদ’ কাব্যগ্রন্থটি পড়েছেন। পুর্ব ইউরোপে পহেলা বৈশাখের সুপ্রভাতে বিছানায় শুয়েশুয়েই বইটি পড়ে ফেললাম। কেমন জানি (!) মনৌষধি (থেরাপিউটিক) ধরনের কবিতা। একটা সচেতন মনকে সুন্দরের-উপলব্ধির অবচেতনে নিয়ে যায়, সহজেই। কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে আর কিভাবে, কি বলা যায়? সারাটা দিন ভেবেছি। সমগ্র বইটি জুড়ে শব্দে, বাক্যে, পংতিতে পংতিতে প্রেম-অপ্রেম, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চেতন-অবচেতন-উপলব্ধি, মানব-মানবীর দেহ-মনের স্বপ্ন-আকাংখা-তৃষ্ণা। এমন কথায় আপনাদের মনে হতে পারে, যুবক বয়সী কবিদের কবিতা তো এমনই হয়। হ্যাঁ, তা হয়। অস্বীকার করছি না।

তবে সকলের প্রকাশের নান্দনিকতার মাত্রা-সৌন্দর্য্য এক নয়। তাই তো কেউ কেউ কবি, সকলেই কবি নয়। অনেকেই গান গায় কিন্তু কেউ কেউ শিল্পীগুণে পরিচিতি পায়। ‘অহেতু বুদ্বুদ’ বইটি সম্পর্কে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়- ভাষা শৈলী, চিত্রকল্পের ব্যপ্তি ও মাধুর্য্য, উপমার অভিনবত্ব ও আধুনিকতা এবং কবিতা মানে যে শুধু ছন্দবদ্ধ গীত নয়, কবিতা হতে পারে মুক্তপদ্যের সুষমাও; জাহিদ সোহাগ তার স্বাক্ষর রেখেছেন, বলিষ্ঠ ভাবে। তাঁর ‘অহেতু বুদ্বুদ’ তাঁকে একদিন কবিচিহ্নিতযশ এনে দিবেই।

নিশ্চয়ই প্রশ্ন থাকে, তিনি কী এমন লিখেছেন? যৌক্তিক প্রশ্ন। তাঁর কাব্যগুণের কিছু নমুনা অবশ্যই আপনাদের কাছে হাজির করবো। তার আগে আরেকটি কথা বলতে চাই। একজন ঐন্দ্রজালিককে জানতে হয় অভিনয়, বাচনবিদ্যা, স্বরবিদ্যা, আলোক ও রশ্মিবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, রসায়নবিদ্যা, দ্রব্যগুণ, শাস্র-পুরান। আর এতগুলো বিষয় এক সঙ্গে কাজ করে বলেই, জাদু এত আকর্ষনীয়, তাই না? আর একজন পুরোহিতকে জানতে অনিমান, লঘিমান, মহীমান, গরিমান, প্রাকাম্য, প্রাপ্তি, নৈর্মাণিকি, পারংমিকি, বশিত্ব, ঈশিত্ব, কুম্ভুক এবং বিদ্যা। কোনো কোনো পুরোহিত অঙ্গবিদ্যা, অহিবিদ্যা, বিষবিদ্যা, পক্কধ্যান, মণিকাবিদ্যা ও মৃগচক্রাদিও জানে। আর যদি কেউ ঐন্দ্রজালিক এবং পুরোহিতের সকল গুণাবলী ধারণ করতে পারেন, তাহলে তাকে কি বলা যায়? এক কথায় অবতার।

আমার কাছে একজন কবিও তেমন। একজন কবিকেও জানতে হয় অনেক কিছু। কবি মাত্রই সত্যাবতার স্রষ্টা, মুগ্ধতার জাদুকর, ঈশ্বরের প্রতিবেশি। যার বিচরণ-পর্যবেক্ষণ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে। জাহিদ সোহাগ তাঁর ‘অহেতু বুদ্বুদ’ গ্রন্থে ডুব দিয়েছেন প্রেম ও পরিখার জলে, ভেসেছেন নীল ও নীলিমায়। তাঁর রোদ চশমার নিচে চোখ ও ভ্রূর দিকটায় থাকে বার্ন ইউনিটের তেরো নম্বর কক্ষ। রাতের বেলা দিনের ট্যাংক থেকে তুলে নিতে পারেন কয়েকগুচ্ছ শিহরণ। প্রেমের প্রস্তাবে দেখেছেন নির্জন বিছানা; উত্তরঙ্গে আছড়ে পড়া নিরীহ নদী। আবার সকালে দরজা খুলে আকাশে যে কয়টি তারা দেখেন, তার নিচেই খেলা করে তাঁর প্রিয় খরগোশ।

কামনা করেন সেই কিশোরীকে, যে এখনো তার মায়ের রেজর চুরি করে। তাকে দেখে দেখে তাঁর চোখ, জিভ হয়ে যায়। সর্বান্তঃকরনে বলেন, এ চোখ শুধু তোমারই ক্রীতদাস। অন্যথায়, আমি এক অন্ধ যুবক। তোমার পথ ও পথের শিশিরে, আমার একটা জীবন ডালিমের মতো ফেটে আছে।

থৈ থৈ অজানা থেকে জোনাকি ধরতে গিয়ে, রমনীর শরীরে দেখেছেন নিহত পুরুষের লালা। বারবার জীবনকে জিজ্ঞেস করেছেন, ব্যর্থতা তুমিও আছো, পুরুষের সমান বেঁচে? অকস্মাৎ বাবার মুখোশ পরে জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, বাবার বন্ধুরা কেউ কেউ মা’কেও ফুসলায়। আহারে! মিথ্যে কথা রঙ্গিন হয়ে বাঁচে। পিঠের তলায় নক্ষত্র বিছিয়ে ঘুমালে কাব্যকলার সফেদ দেবী বলে, তোমার জন্য লাল রিবনে বেঁধে রেখেছি বৃষ্টি।

পেরেক ঠুকে যিশুর ছবি টাংগিয়ে লক্ষ্য করেন, তাঁর চোখ আর নদী সমান দূরগামী। সুতরাং পুকুরের লজ্জাস্থানের মতো ফোনের স্ক্রিন ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাজ নেই। রাস্ট্র এবং বিপ্লবের বাইরেও মানুষ থাকে। অতঃপর কিছুটা সুরের দিকে ফিরে বৃষ্টির অজুহাতে নত হয়ে যান। অবচেতনে তাঁকে হত্যার পর আততায়ী জিজ্ঞেস করে, সে মরবে কি না? বাতাসের দেবতা হয়ে তিনি বলেন, আমি হবো আকাশের উদ্ভিদ। আকাশের গায়ে কোনো মানুষের রেখা এঁকে, তাকে বন্ধু করে নিব। তবে ভীষণ দুঃখ পাব- যদি আমার গল্প শুনে, তাঁর চোখ থেকে জল পড়ে টপটপ আমার চোখে।

 

শাখাওয়াৎ নয়ন

অধ্যাপক, ব্যাবেশ বইউই ইউনিভার্সিটি, ক্লুজ-নাপোকা, রোমানিয়া, পহেলা বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।

 

 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments