আকাশের গায়ে কখনো লাগেনা দাগ । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে শতবর্ষী হতেন এবছর। ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে নিহত হন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ও স্থপতি।জাতীয় শোকদিবসে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত প্রশান্তিকার আয়োজন ‘রক্তস্নাত শোকাবহ আগস্ট’-এ লিখেছেন সিডনি প্রবাসী লেখক ও কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত।

খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। আজ যা ইতিহাস সেদিন তা ছিলো সত্য। আমাদের যৌবনে বঙ্গবন্ধুর নাম বলা যেতোনা। জয় বাংলা উচ্চারণে ছিলো বাঁধা। দিনের পর দিন নানা মঞ্চে আমরা তা বলে বলে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিলেও রাষ্ট্রীয় টিভি বেতার মিডিয়ায় ছিলো নিষিদ্ধ। সে নিষিদ্ধ যে কতটা জাগ্রত আর আবেগময় হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জেতার পর। প্রথম যেদিন ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারিত হলো। ঢাকা সহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর রাজপথ সন্ধ্যায় ফাঁকা হয়ে গেছিল। যেন কারফিউ।যেকোন হলিউড বলিউড ম্যু্ভির চাইতেও আকর্ষনে অধিক সে ভাষণ আমাদের বাড়ীতে টেনে নিয়ে গেছিল। যেন এক যাদুকরের যাদুময় টান। আজ কি আসলে সে অবস্থা আছে? অতি প্রচার আর অকারণ প্রচারে আমরা কি তার ধার কমিয়ে ফেলিনি?

একটা সময় বঙ্গবন্ধু পরিষদের মিছিল ছিলো চোখে পড়ার মত। আশা জাগানিয়া সেই মিছিল পনের আগস্টে কখন রাস্তায় নামবে সেটা দেখার জন্য কৌতু্হলী মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। বিচারপতি থেকে চাষী বা সাধারণ মানুষের সেই সব শোভাযাত্রা আজ কিংবদন্তি। মানুষ চোখের পানি লুকিয়ে সবুর করতো কখন আবার জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হবে দেশ। কখন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাবেন। আজ কি সে জায়গাটা তেমন রেখেছে রাজনীতি? স্পষ্ট মনে আছে জীবনের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বারবার বলতেন, ‘মানুষ আমাকে কেন এত ভালোবাসে? আমিতো তাদের তেমন কিছু দিতে পারি নাই।’ যে মানুষদের তিনি সুখি স্বচ্ছল আর আধুনিক করতে জান দিয়েছিলেন তারা কষ্ট অভাব অনটন এড়িয়ে তাঁর জন্য গাছের ফল, বাগানের ফুল, মাঠের ফসল নিবে আসতো। দু’ হাত ভরে গ্রহণ করে চোখের পানিতে ভাসতেন বঙ্গবন্ধু। কি বেদনা আর কি অভিমান ছিলো তাঁর গলায়। নিজের অপারগতার কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেননা। আর আজ? নেতারা ফল ফুল গ্রহণ করেননা। কোথাও তারা পায় সোনার নৌকা, কোথাও সোনার মুকুট আর টাকার পাহাড়। এরাই আবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তুলে ধরার গল্প শোনান আমাদের।

রাজনীতি সবকালে সবসময় তার নিজের মত করে চলে। সেখানে অবিমিশ্র ভালো মন্দ বলতে কিছু নাই। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে কিছু ভুল নিশ্চয়ই ছিলো। যার বড় একটি তাজউদ্দীনকে মূল্যায়ন না করা। আর একটি মোশতাকের মত সাপ খল মীরজাফরকে বিশ্বাস করা। তার পরিণতি দেখেছি আমরা। রক্তের বন্যায় ভেসে যাওয়া ইতিহাসে তার নমুনা আছে। কিন্তু এ থেকে কি পাঠ নিয়েছে রাজনীতি? আজো ঘরে ঘরে মীরজাফর আর দুশমনের দল । তারাই ঘিরে আছে গদীওয়ালাদের। দূরে হটে গেছে নিবেদিত সৈনিকেরা। দল থকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত সেইসব ত্যাগীদের দীর্ঘশ্বাস কি ছেড়ে কথা বলবে? আজকের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কিছু নাই। এটা কোন শুভ বিষয় হতে পারেনা। সবাই জানে দলে দলের ভেতরে সবজায়গায় সুবিধাভোগীরা ঢুকে গেছে। একেকটা বৈরী পরিবেশ বা রাজপথে ঘটনা দূর্ঘটনাতেই দেখি দল বা রাজনীতি কতটা অসমর্থ। এই টুকু কে না বোঝে? কিন্তু সিংহাসনে থাকলে হয়তো তা চোখে পড়েনা। রাজা যেমন প্রজা ব্যতীত সেনা উজির নাজির নিয়ে বেশীদিন চলতে পারেনা গণতন্ত্র ও জনগণ ছাড়া বাস্তবে অকার্যকর। আওয়ামী লীগের ভাগ্য ইতিহাস তাদের সাথে আছে। এদেশের অতীত ঘটনায় তাদের অবদান প্রয়াত নেতাদের ভূমিকা জীবিত কিংবদন্তীদের কারনেই দল এখনো সচল। নতুন প্রজন্মের দিকে তাকালে সে ভরসা পাইনা। বরং ভয় জাগে।

এই সেদিনও আমরা রাজপথে নেমে আসা তারুণ্যের বুকে লাগানো পোষ্টারের ভাষা দেখে চমকে উঠেছি। কোটা আন্দোলনের নামে যে উত্তপ্ত রাজপথ তার কারণে নেমে আসা যুবকের বুকে লেখা ছিলো “আমি রাজাকার”। কৌশলে বা অপকৌশলে রাজাকার শব্দটি জায়েজ করা হচ্ছে। এখন যুবসমাজে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোন আবেগ নাই। এটা না মানলে আপনি সত্য অস্বীকার করছেন মাত্র। কিন্তু কেন নাই? তা কি ভেবে দেখছি আমরা? যেকোন বিষয়কে খুব বেশী কচলাতে নেই। তাতে তেতো হয়ে যায় সবকিছু। মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবময় অতীত। তার সাথে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু ও জাতির সম্মান। সে কথাটা ভুলে যত্রতত্র যেভাবে ইচ্ছে এর ব্যবহার আর কি ফল বয়ে আনতে পারে? তাই একথাটা মনে করিয়ে দিতে চাই এখনো সময় আছে, পাশের দেশগুলোর দিকে তাকান। সেসব দেশে সরকার বদল আরো কতকিছু ঘটে কিন্তু ইতিহাস বদলায়না। ইতিহাস নিয়া মারামারি তর্ক থাকলেও নাই অস্বীকার বা সত্য এড়িয়ে যাওয়া। আওয়ামী লীগ যে অপশক্তির ভয়ে তা করে বা নিজেদের ভেতর দূর্বলতা তৈরী করে তার উত্তরণে তারুণ্যের জড়িত হবার বিকল্প নাই। কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুর আমলে যে ছাত্রলীগ ছিলো অগ্রগামী তারাই সবচাইতে ভয়ংকর। তাদের নামে বা তাদের কারণে যা হচ্ছে তাকে কি কেবল ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেয়া যায়? কারনে অকারনে তাদের যে ভয়াবহ রুপ আসলে তা সামাল দেয়ার কেউ নাই। অথচ বঙ্গবন্ধু একবার এসে দাঁড়ালে বীরের দল বাঘ থেকে ইঁদুর হয়ে গর্তে লুকাতো।

বলছিলাম আমাদের যৌবনের কথা। সেসময় জাতি নিশ্চিত ভাবে জানতো আমাদের মাথার ওপর অভিভাবক আছেন। শত বিপদেও যিনি দেশ ও জাতিকে ফেলে যাবেননা। বা বুক দিয়ে আগলে রাখবেন। তাঁর সেই বুক যারা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো সেই শয়তানদের বিচার ও শাস্তি হলেও দলের মীরজাফরদের ব্যাপারে নীরবতা আজো বোধগম্য না। কারণ এরা না থাকলে কেউ খুন করতে সাহস পেতোনা। সমীকরণের নতুন অংকে জায়েজ হয়ে যাওয়া এদের না ঠেকালে কি করে নিরাপদ হবে আওয়ামী লীগ? আর একটা বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, সুষ্ঠু ও সমান্তরাল বিরোধিতা না থাকলে কোন দেশের উন্নতি বা অগ্রগতি টেক সই হয়না। এটা নতুন কিছুনা। নতুন শুধু এই আজকাল রাজনীতি সহ্য শক্তি হারিয়ে কেবলই একক আর সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।

এই সর্বগ্রাসীতা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর দোসর ও রাজনীতিকে মানায়না। কারণ তিনি সবার। তিনি যদি সর্বজনীন হতে না পারেন বা হতে দেয়া না হয় তো এসব কাঙালি ভোজন আর শোকের মাতম একদিন পথ হারাবেই। পথ এখনো হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। মানুষের মন ও বিবেকে যে বঙ্গবন্ধু তিনি যে কতটা শক্তিশালী সেটা আমরা পুরো এরশাদ আমল, জিয়ার আমল আর বিএনপির আমলে দেখেছি। সে শক্তিটা যত্ন করে তুলে রাখাই ছিলো বিবেচনার কাজ। সেটা কেউ করছেনা। যা করছে তার নাম কোলাহল। একদিকে দলে, দলের বাইরে মোশতাক গং কিলবিল করছে। আরেকদিকে চলছে ষড়যন্ত্র। দেশে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ আর্থিকভাবে উন্নত হলেও নান কারণে নিম্মমুখি। সেটা মনে রাখলে সময় ছেড়ে কথা বলবেনা।

সব চাইতে জরুরী বাংলাদেশ ও তার মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি ও সম্মান বজায় রাখা। নানা ষড়যন্ত্রে ভগবান ভূত হবার সমাজ আমাদের। বদলে যাবার জন্য একপায়ে খাড়া দেশে কোন কিছুই স্থায়ী না। এমনকি ইতিহাসও। তাই বড় ভয় লাগে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। তারপরও আমরা যেন এমন অস্ত্র এমন ভালোবাসা আর এমন আশ্রয়কে অপব্যবহারে মলিন না করি। যেদিকে তাকাই বন্দনা আর স্তাবকতায় অন্ধ রাজনীতি তাঁকেও রেহাই দিতে পারছেনা। মনে হয় সে গানটিই যেন সত্য : তোমার কথা হেথা কেহতো বলেনা করে শুধু মিছে কোলাহল।”

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একাকার অভিন্ন বলেই তাঁকে পবিত্র রাখা জাতীয় দায়িত্ব। অবশ্য তিনি সেই কবিতার মতো। মেঘেরা যা খুশী লিখে রেখে যাক, আকাশের গায়ে কখনো লাগেনা দাগ।
সিডনি, ১৩ আগস্ট ২০২০।

অজয় দাশগুপ্ত
লেখক ও কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments