এশীয় অঞ্চলে চলচ্চিত্রকে পরিচিত করে তোলার পেছনে আকিরা কুরোসাওয়ার অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রযোজক ও সম্পাদক। বিংশ শতাব্দীর সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একজন তিনি। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ১৯৪৩ সালের সানশিরো সুগাতা এবং শেষ চলচ্চিত্র ছিল ১৯৯৩ সালের মাদাদাইয়ো। তাঁর দুটি চলচ্চিত্র সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। তিনি একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার, লেজিওঁ দনর সহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ বলেছেন, “কুরোসাওয়া হচ্ছেন আমাদের সময়ের চলচ্চিত্রের শেক্সপিয়ার”। কুরোসাওয়ার মাত্র একটি ছবি দেখেছিলেন ইতালীয় নির্মাতা ফেদেরিকো ফেলিনি। ‘সেভেন সামুরাই’ দেখে তিনি বলেছিলেন, “একজন চলচ্চিত্রস্রষ্টা কেমন হওয়া উচিত, কুরোসাওয়া তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত।”
আরেক ইতালীয় নির্মাতা বার্নার্দো বার্তুলিসি বলেছিলেন, “কুরোসাওয়ার ছবি ও ফেলিনির ‘লা ডলসে ভিটা’ আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে অনুপ্রেরনা দান করেছে”। কিংবদন্তি নির্মাতা সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যান নিজের ছবি ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’ নিয়ে বলেছিলেন, “আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমার সিনেমাটি কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রের একটি অন্ধ অনুকরণ।” আমেরিকান নির্মাতা মার্টিন স্করসেস বলেছেন, “সারা দুনিয়ার চিত্রনির্মাতাদের ওপর কুরোসাওয়ার প্রভাব এতই গভীর যে তাঁর সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না”। মার্কিন নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা বলেছেন, “একটি ব্যাপার কুরোসাওয়াকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। তিনি একটি বা দুটি মাস্টারপিস বানান নি। তিনি বানিয়েছেন আটটি মাস্টারপিস”। কুরোসাওয়ার রাশোমন চলচ্চিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবদন্তিসম বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় বলেছেন, “আমার উপর এই ফিল্মের প্রভাব ছিল রোমাঞ্চকর। আমি পর পর তিনদিন ফিল্মটা দেখি এবং প্রতিবারই অবাক হয়ে ভেবেছি আর কোথাও কী এরকম আরেকটি ফিল্ম আছে যা ফিল্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্মাতার নিয়ন্ত্রণের দৃঢ় এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে।”
জাপানে চলচ্চিত্র সম্রাট বলে অভিহিত আকিরা কুরোসাওয়া ১৯১০ সালের ২৩শে মার্চ জাপানের রাজধানী টোকিওর শিনাগাওয়া উপশহর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে কুরোসাওয়া জাপানের একটি মূলধারার চলচ্চিত্র স্টুডিওতে পরিচালনার জন্য আয়োজিত একটি শিক্ষানবিশি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। পিসিএল নামের এই স্টুডিওটি পরবর্তীতে তোহো নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরিচালক কাজিরো ইয়ামামোতো তাকে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় কুরোসাওয়া তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ছিল ‘সানশিরো সুগাতা’। এর পর তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন জাপানি সরকার খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। এ কারণে এ সময়ের চলচ্চিত্রগুলোতে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা উঠে এসেছে। যেমন তার ‘দ্য মোস্ট বিউটিফুল’ নামের ছবিটি সামরিক অপটিক্সের কারখানায় কাজ করা এক নারীর জীবন নিয়ে করা। ‘জুডো সাগা ২’ ছবিতে জাপানি জুডোকে পশ্চিমা তথা মার্কিন বক্সিং থেকে উত্তম হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যুদ্ধের পর তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রে এ ধরনের কোনও প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না, বরং এতে পূর্বতন জাপান রাজতন্ত্রকে কটাক্ষ করা হয়েছে। ‘No Regrets for Our Youth’ চলচ্চিত্রটি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত এক ব্যক্তির স্ত্রীকে নিয়ে করা। এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ পুলিশের হাতে আটক হওয়া থেকেই কাহিনীর শুরু। সমসাময়িক জাপান নিয়ে কুরোসাওয়া আরও কিছু ছবি করেছেন যার মধ্যে আছে ‘স্ট্রে ডগ’। কিন্তু তাঁর পিরিয়ড চলচ্চিত্র ‘রাশোমোন’ তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এই ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার অর্জন করে এবং পরবর্তীতে একাডেমি পুরস্কারও লাভ করে।

‘রাশোমন’ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের একটি পরিচিত নাম। আকিরা কুরোসাওয়ার অসাধারণ নির্মাণে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে গণ্য করা হয় এই চলচ্চিত্রকে। ১৯৫০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে জাপানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সত্যিকারের সমাদর লাভ করে। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে কুরোসাওয়ার উত্থান আর জাপানের এগিয়ে যাওয়ার শুরু সেই থেকে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু আর একজন কাঠুরে বসে আছে একটি ভাঙ্গা দুর্গের দ্বারের নিচে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আরও একজন লোক উঠে এলো সেই ভাঙা দ্বারের নিচে। ঘটে যাওয়া মারাত্মক ঘটনাটি নিয়ে তার সাথে কথা বলেন ভিক্ষু এবং কাঠুরে। কাঠুরে জঙ্গলে গিয়েছিল কাঠ কাটতে। গিয়ে সে হঠাৎ দেখতে পায় একটি হ্যাট পড়ে আছে। কিছু দূরে সে দেখতে পায় একটি শবদেহ। এর পরে আদালতে কাঠুরেকে সাক্ষী দেয়ার জন্য তলব করা হয়। কারণ খুন হয়ে যাওয়া ব্যাক্তিটির হত্যার অভিযোগে একজন ডাকাতকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিক্ষুও আদালতে গেলেন স্বাক্ষী দিতে। কারণ তিনি মৃত লোকটিকে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছিলেন। লোকটির ঘোড়ার উপরে ছিল তার স্ত্রী। নিচে অস্ত্রসহ লোকটি হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঘোড়াটিকে। লোকটি ছিল একজন সামুরাই। ভিক্ষু এবং প্রথম লোকটি তাদের সাক্ষী দেবার পর ঘটনার শুরু হয়। ধৃত ডাকাতেরও জবানবন্দি নেয়া হয়। মৃত লোকটির স্ত্রী এসে সাক্ষী দেয় অন্যরকম। ভিক্ষু এবং কাঠুরে কারুরই ওই দুজনের কথা বিশ্বাস হয় না। তাই তারা যান একজন তান্ত্রিকের কাছে। তান্ত্রিক তার নিজের বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্রের সাহায্যে মৃত আত্মার সাথে কথা বলতে পারে। মৃত লোকটির আত্মাকে আনা হয়। মৃত লোকের আত্মা এসে সম্পূর্ণ ঘটনাটি অন্যভাবে বয়ান করে। এদিকে দর্শক পড়ে যায় মহা ঘোরের মধ্যে। দর্শকের মনের সন্দেহ কোনোভাবেই কাটে না। একের পর এক শিউরে ওঠার পালা দর্শকের। সত্য, মিথ্যা, কামনা, আকুতির বেড়াজালে কখন যে মস্তিষ্ক ও চোখজোড়া আটকে পড়ে গেছে টের পাওয়া যায় না। দর্শকের মনোজগত নিয়ে যে খেলাটা শুরু করেন পরিচালক, তাতে তিনি শতভাগ সফল। চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি, শৈল্পিক উপস্থাপন, শিল্পীদের সতেজ সাবলীল অভিনয়ে এই চলচ্চিত্র সর্বকালে আবেদনময়।পঁচিশতম অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় রাশোমনকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুক্তির পর অন্যরা সাদরে গ্রহণ করলেও জাপানের সিনে সমালোচকরা এটিকে ভালভাবে নেয় নি। “যদি স্বার্থপর না হও, সংগ্রাম করতে পারবে না।” – সিনেমার শেষদিকে বলা এমন আরো গোটাকয়েক সংলাপ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও জীবন্ত। চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দেয় মানব সত্তাকে।
১৯৫০-এর দশকের মধ্যে কুরোসাওয়া এমন কিছু কৌশল রপ্ত করেছিলেন যা তাঁর চলচ্চিত্রগুলোকে অনন্য করে তুলছে। ছবির শুটিংয়ের সময় তিনি ‘টেলিফটো লেন্স’ ব্যবহার করতেন কারণ তার বিশ্বাস ছিল অভিনেতার কাছ থেকে ক্যামেরা দূরে রাখলে অভিনয় ভাল হয়। এছাড়া তিনি একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। একাধিক ক্যামেরা ব্যবহারের জন্যই অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বিভিন্ন কোণ থেকে দেখানো সম্ভব হতো। কুরোসাওয়ার ছবির আরেকটি বড় ট্রেডমার্ক হল সম্পূর্ণ ভাব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আবহাওয়ার সাহায্য নেয়া।
একনায়কসুলভ পরিচালনার জন্য আকিরা চলচ্চিত্র মহলে ‘টেনো’ বা ‘সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কাঙ্ক্ষিত ভিজুয়াল ইফেক্ট তৈরির জন্য তিনি বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় করতেন। এক্ষেত্রে তাঁকে পারফেকশনিস্ট বলা চলে। রাশোমনের শুরুর দৃশ্যে ভারী বৃষ্টিপাতকে ফুটিয়ে তোলার জন্য শুটিং এলাকার স্থানীয় পানির পুরো সাপ্লাই শেষ করে ফেলেছিলেন। আর এই পানির সাথে ক্যালিগ্রাফির কালি মিশিয়ে কালো রঙের সৃষ্টি করেছিলেন। কারণ কালো রঙে বৃষ্টির গাঢ়তা বোঝা যায়। রান ছবির একটি দৃশ্যে বিশাল দুর্গ প্রাসাদ আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এজন্য মাউন্ট ফুজির উপরে একটি আলাদা দুর্গ সেট তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। এই দুর্গটি তৈরিই করা হয়েছিল পুড়িয়ে দেবার জন্য।
তাঁর পরিচালনা বিষয়ক আরও কিছু কাহিনী আছে। যেমন, সামনের অতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এই ভিজুয়াল ইফেক্ট আনার জন্য তিনি উল্টো দিক থেকে ঝোড়ো হাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ছবির একটি দৃশ্যে ট্রেন থেকে বাড়ির শট নেয়া হচ্ছিল। আকিরা মনে করেছিলেন সেই বাড়ির ছাদ থাকার কারণে শটটা দেখতে ভালো লাগছে না। এজন্য তিনি বাড়ির পুরো ছাদ সরিয়ে ফেলেছিলেন। পরে বাড়ির ছাদ অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। পোশাক সজ্জার ব্যাপারেও তিনি পারফেকশনিস্ট চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন অভিনেতাকে সিনেমার শটের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পোশাক দিলে বিষয়টি বাস্তবসম্মত হয় না। এজন্য অনেক সময় তিনি অভিনেতাদেরকে শুটিংয়ের এক সপ্তাহ আগে পোশাক দিয়ে দিতেন। অভিনেতাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই পোশাক পরতে হত এবং পোশাকের সাথে নিজের বন্ধন বাড়িয়ে তোলার অনুশীলন করতে হত। বিশেষ করে ‘সেভেন সামুরাই’ চলচ্চিত্রে তিনি এটার প্রয়োজন অনুভব কটেছিলেন। কারণ এ চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো অধিকাংশই ছিল গরিব কৃষক শ্রেণির। এ কারণে অভিনেতাদেরকে বারবার বলে দেয়া হয়েছিল, তারা যেন কাপড় এমনভাবে পরে যে শুটিঙের সময় বোঝাই যায় সেটার অবস্থা ভালো না।
এবার ‘ডেরসু উজালা’ প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রখ্যাত রুশ অভিযাত্রী ভ্লাদিমির আরসেনিয়েভের লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশ হয় ১৯২৩ সালে। আকিরা কুরোসাওয়া এই স্মৃতিকথা অবলম্বনে ১৯৭৫ সালে ‘ডেরসু উজালা’ চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। তাঁদের অভিযাত্রী দলের কাজ ছিল ভবিষ্যৎ নগরায়ণের জন্য নতুন নতুন দুর্গম বনভূমি ও সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর সংগ্রহ করে আনা। সেখানেই একাকী বৃদ্ধ বনজীবী ডেরসুর সঙ্গে রুশ অভিযাত্রীর সাক্ষাৎ হয়। বরফের গর্তে পড়ে যাওয়ার ঘোর বিপদ থেকে অভিযাত্রীকে বাঁচায় ডেরসু। ভয়ঙ্কর বরফ-ঝড়ে হাতের কাছে পাওয়া খড়কুটো দিয়ে মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় বানাতে শেখায়। নির্মম কঠোর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগে সে ছিল এক অদম্য বাঁচার লড়াই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বা তাকে পর্যুদস্ত করে নয়, নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করাই ছিল ডেরসুর শিক্ষা। প্রকৃতির সংহারমূর্তির বিপরীতে আর্ত মানুষের ক্ষুদ্র পদক্ষেপ গ্রহণ করে টিকে থাকার এই গল্পে দুই অসমবয়সি ও অসম শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধা গড়ে ওঠার কাহিনিটি অনবদ্য। ওই জঙ্গল, বরফ-প্রান্তরের প্রতিটি বিপদের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য আশ্রয়ের কথা ওই স্থানীয় জনজাতির মানুষটির ছিল নখদর্পণে। এই চলচ্চিত্রে কুরোসাওয়া দেখিয়েছেন, মানবসভ্যতা একজন নাগরিক ‘অভিযাত্রী’ এবং গ্রামীণ স্বশিক্ষিত মানুষের মধ্যে কতখানি অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে।

১৯৯০ সালে ‘ড্রিমস’ চলচ্চিত্রে কুরোসাওয়া আটটি টুকরো গল্পের মাধ্যমে তুলে আনলেন শৈশব, আধ্যাত্মিকতা, শিল্প, মৃত্যু, ভুল এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো সিরিয়াস বিষয়। বোদ্ধাদের অনেকেই চলচ্চিত্রটির সঙ্গে কুরোসাওয়ার আত্মজীবনী ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’র মিল খুঁজে পান। চলচ্চিত্রটির একটি গল্পে কুরোসাওয়া পরিবেশের ওপর পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন। ঠিক ২১ বছর পর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাই-ইচিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। গণমাধ্যমের ব্যাপক চর্চা হয়েছিল তখন থেকে ২১ বছর আগে নির্মিত কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস’ চলচ্চিত্রের কথা।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে কুরোসাওয়া বিশেষভাবে পরিচিত তাঁর গভীর মানবতাবোধ ও নৈতিকতা বিষয় উপস্থাপনে প্রবল আগ্রহের জন্য।ব্যক্তিমানুষের বস্তুনিষ্ঠ চরিত্রায়ণ তাঁর চলচ্চিত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। তৎকালীন জাপানি ঘরানার ভাবনার চাইতে তিনি ছিলেন অনেকাংশেই বিপ্লবী। তাঁর ইকিরু, হাই অ্যান্ড লো, সেভেন সামুরাই প্রভৃতি চলচ্চিত্রসমূহে চরিত্রগুলোর বস্তুনিষ্ঠ চরিত্রায়ণ শুধু ব্যক্তি ও সমাজের পরস্পর সম্পর্ককেই নিরিখ করে না, মানবতা বা মনুষ্যত্বের সীমারেখাকেও যেনো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে মানবিক শক্তি ও দুর্বলতার মাপকাঠিতে। পরিপূর্ণ সঙ্গীত চলচ্চিত্রের সাথে যায় না বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। এ কারণে চলচ্চিত্রের জন্য গান ও সুর নির্বাচনের বেলায় তিনি সেটাকে একটি মাত্র বাদ্যযন্ত্রে নামিয়ে আনতেন। অর্থাৎ একটি সুরের জন্য কেবল একটি সুরই ব্যবহার করতেন। চলচ্চিত্রের শেষের দিকে পরিপূর্ণ সঙ্গীতের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতেন তিনি।
কুরোসাওয়া বলতেন, সভ্যতা মানবতাকে বিষিয়ে তুলেছে। নির্মাতার মানবিক চরিত্র হচ্ছে একটা ভালো চলচ্চিত্রের মেরুদণ্ড। আমরা যদি নিজেদের কাছেই সৎ না থাকতে পারি তাহলে কখনোই একটা ভালো চলচ্চিত্র বানাতে পারবো না। তার মানে এই নয়, একটা দেশ যদি ভালো হয় তাহলে সেখানকার নির্মাতারা অনিবার্যভাবেই ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। যে ব্যক্তি ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম সে জানে দর্শকের মনের মধ্য থেকে কীভাবে তার উপায় খুঁজে বের করতে হয়। ১৯৯৮ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীতে রেখে গিয়েছেন এমন অনেকগুলো মনোমুগ্ধকর মাস্টারপিস চলচ্চিত্র যা তাকে বিংশ শতাব্দীর সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন করে তুলেছে।
মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী:
বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ, আবৃত্তি ও অনুবাদের পাশাপাশি একজন পরিব্রাজক। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে তাঁর নখদর্পনে। জন্ম ১৯৭৭ সালের ১১ এপ্রিল সরকারি চাকুরে পিতার কর্মস্থল মাদারিপুরের কালকিনি থানা এলাকায়।
শৈশব কৈশোর যৌবনের অনেকখানি কেটেছে মাতুলালয় নড়াইলের কালিয়ায় এবং পিতার কর্মস্থল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর অথচ ব্যক্তিগত পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে প্রাচীন ইতিহাসের অলিগলিতে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ছাত্রজীবনেই ছবি আঁকা, থিয়েটার,আবৃত্তি ও সাহিত্য চর্চা শুরু। লিটল ম্যাগ সম্পাদনা ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ফিচার লিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু। ভারতবর্ষে ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ গ্রন্থ ‘চাচনামাহ্’-এর প্রথম ও পূর্ণাঙ্গভাবে অনুবাদ তার হাতে। শিল্প-সংস্কৃতি-প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক অসংখ্য তথ্যচিত্রের নির্মাতা। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের উপযোগী সম্প্রতি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাণ শেষের পর্যায়ে। ভ্রমন ভালো লাগে তাই ব্যাগ ও বাহন সবসময় তৈরী। সময় পেলেই, পাহাড়, সমুদ্র, নদীর সাথে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন।