‘আগষ্ট ১৪’ দেখলাম। প্রথমেই নির্মাতা শিহাব শাহিনকে সাধুবাদ জানাই একটি উঁচুমানের ওয়েব সিরিজ বানাবার জন্য। খুঁটিনাটি অনেক বিষয় তিনি খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। বাংলাদেশের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এমন উন্নত মানের ব্যবস্থাপনা আছে এই সিরিজ না দেখলে জানতেই পারতাম না। মুগ্ধ হয়েছি অনেক কিছু দেখেই, গর্ব করবার মতো বেশ কিছু এলিমেন্টস রয়েছে এই সিরিজে। তাসনুভা তিশা খুব ভালো অভিনয় করেছে, মেয়েটি প্রশংসা পাবার যোগ্যতা রাখে। অভিনয় মোটামুটি সবারই ভালো হয়েছে। শেষ দৃশ্যটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, চোখের পানি আটকানো যায়না, আমিও পারিনি।
ঐশীকে নিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ বানানো হয়েছে শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। সাথে সাথেই দেখলাম। এক বসায় শেষ, ৩ ঘণ্টা ১৭ মিনিট।
শুধু দুটো বিষয়ে সমালোচনা করবো – একটা সিরিজ, আরেকটা ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।

১/ সিরিজের কোনো কোনো জায়গায় মনে হয়েছে টেনেছে বেশ, এতে করে টান টান উত্তেজনার অনুভূতিটা মিস করেছি। ওইসব জায়গাগুলোতে আরেকটু স্পিড থাকলে আমার ভালো লাগতো। এটা খুব সামান্য সময়, বাকিটা খুব ভালো হয়েছে।
২/ ভেবেছিলাম ঐশীর মানসিক দিকটা আরেকটু এক্সপ্লোর করবে। মনে হলো একদম মাঝামাঝি একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে গল্পটা বলা হয়েছে। আমার মন্তব্য হলো, সমস্যাটাকে হালকা করে দেখানো হয়েছে। আরেকটু গভীরে যেতে পারলে ভালো হতো।
১৫/১৬ বছর বয়সটাকে আরেকটু গুরুত্ব দিতে হবে। মনে হলো এটা শুধুমাত্র একটা বখে যাওয়া মেয়ের গল্প, যেটা খুব generalized perspective হয়ে গেলো। কিন্তু এটা তার চাইতে আরও বড় একটা বিষয় যেটা থেকে আমাদের সবারই জানবার এবং শিখবার ছিল অনেক।
একটা মানুষের জীবনে যেই পরিবর্তনটা মাত্র দুই বছর আগে শুরু হয় তার বীজ হয়তো আরও অনেক আগেই বোনা হয়ে গিয়েছিলো। পরিবর্তন আনতে চাইলে অর্থাৎ ঐশীর গল্পের পুনরুত্থান না চাইলে ওই বীজ বপনের সময় পর্যন্ত খুড়ে দেখা প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি, একদম ছোটবেলায়।
সোশ্যাল ওয়ার্কার মহিলার কাজটা পরিস্কার বোঝা গেলো না। বুঝলাম উনি ঐশীর ভালো মন্দের দিকে নজর রেখেছিলেন কিন্তু উনাদের কি আর কোন দায়িত্ব থাকে না? আমি বাংলাদেশের আইনের এই বিষয়টা জানি না তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্টের মতামত জানতে পারলে ভালো হতো। ঐশীর বলা গল্পের পেছনে ওর মনের খবরটা আরেকটু গভীর থেকে টেনে আনতে পারলে বোঝা যেতো কোথা থেকে এবং কবে থেকে ওর ইন্সিকিউরিটি শুরু হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি পর্ন, ইয়াবা, গাঁজা ছাড়াও, এমন কিছু বিষয় ছিল যা আমরা জানতে পারলাম না। যা জানলে আমরা হয়তো পরিবর্তন আনতে পারতাম। এই প্রজন্মকে বাঁচাতে পারতাম। অনেক ঐশীরা বাঁচাতে পারতো তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। সেই সাথে বাঁচতো ঐশীদের বাবা মা যারা অনেক ভালোবাসা দিয়েই তাঁদের সন্তানদের বড় করতে চান।
আমরা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এমন বেশ কিছু নিদর্শন দেখেছি। বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েরা বয়ঃসন্ধি থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত বাবা মা’ কে নৃশংস ভাবে এবং অনেক পরিকল্পনা করেই খুন করেছে। তাহলে আমাদের কি আরেকটু গবেষণা করা উচিৎ না এই ব্যাপারে ?
আমরা বলি, সন্তানদের সময় দেয়া উচিৎ। এই সময়টা কতোটুকু সময় ? কেমন সময় ? সেই ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। অনেকেই আবার মনে করেন মায়েরা বাইরে কাজ করলে সন্তান ভালো মানুষ হতে পারে না, এই কথাটার সত্যতা কতটুকু ? মনোবিজ্ঞানী ডঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ (সাইকিয়াট্রি, চাইল্ড এডোলেসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল ) বলেছেন , বাবা মা কাজ করার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নাই। এটা কোন অজুহাত নয়। শিশুর সাথে গুণগত সময় কাটানো, শিশুর আবেগ বুঝতে পারা এবং বাবা মায়ের আবেগ শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াই হচ্ছে অভিভাবকের দায়িত্ব। এই গুনগত সময়টাই একসময় তাদের মধ্যে বাবা মায়ের প্রতি একটি বিশ্বাস স্থাপন করার অবস্থান তৈরি করবে, যখন সন্তান অনেক কিছুই শেয়ার করতে সাহস পাবে। সেটা তাদের ভুল হলেও বাবা মা আকাশ মাটিতে নামিয়ে আনবে না বরং একটা সুস্থ সমাধানের চেষ্টা করবে। উনি জোর দিয়েছেন, বাসায় সন্তানের আবেগের বোঝাপড়াটা হচ্ছে কিনা, তাদের সাথে জাজমেন্টাল মন্তব্য না করে সুস্থ ইন্টারঅ্যাকশন হচ্ছে কিনা এগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে। এগুলো করতে পারলেই আমরা আমাদের সন্তানকে গুনগত সময় দিতে পারবো। যেটাকে বলা হয় quality time । এমনকি আমরা যদি অনেক সময় দিতেও থাকি, সেটা যদি গুনগত সময় না হয় তাহলে শিশুর ইতিবাচক বিকাশ হয় না বলেই ডঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন।
লক্ষ্য রাখতে হবে বাচ্চাদের মধ্যে কখন ইন্সিকিউরিটি ডেভেলপ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুপরিচিত ডঃ মেহতাব খানম বলেছেন একদম জন্মের পর থেকেই একজন ইন্সিকিউর হতে পারে। ওই সময় যেহেতু শিশুরা মুখে কিছু বলতেও পারে না, কেঁদে প্রকাশ করে ক্ষুধা লেগেছে কিনা, ন্যাপি বদলাতে হবে কিনা, গরম বা ঠাণ্ডা লাগছে কিনা, পেট ব্যথা বা কান ব্যথা করছে কিনা ইত্যাদি। মুখে বলতে পারে না কিন্তু প্রয়োজনগুলো তো থাকেই তাই এগুলো ওই সময় না পেলে ওদের মনের মধ্যে ইন্সিকিউরিটি ঢুকে যেতে পারে এবং ভাবতে অবাক লাগে যে এই শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলো সারাজীবন থাকে মানুষের সাথে।
একই কারণে সারাজীবন কিভাবে আরেকজন মানুষের কাছ থেকে এই অ্যাটাচমেন্ট নেয়া যায় সেটার দিক নির্দেশনাও তখনই তৈরি হয়ে যায়। তখন মানুষ ভীষণভাবে কাউকে খোঁজে। উনি বলেছেন, বেশীরভাগই ইন্সিকুর অ্যাটাচমেন্টে বড় হয়। তখন তারা বাইরের কাউকে খুঁজে যে তাদের ভেতরের শূন্যতা পূরণ করবে। খুব অল্প বয়সেই অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারে, কারণ তারা ভালোবাসা খুঁজতে থাকে। তারা মনে করে বাবা মা কেয়ার করে না তাই ভালোবাসার খোঁজে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এখানে কারো দোষ খোঁজার চেষ্টা নয় বরং ভুল থেকে শিখে নেবার প্রচেষ্টা থাকা ভালো। ওপরে বর্ণিত দুজন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানীর কথা শুনলে মনে হয় আমাদের অনেক জানবার আছে, বুঝবার আছে। সেই দিক গুলো আলোকপাত করলে আমরা হয়তো এখনকার প্রজন্মকে সুস্থ ভাবে বড় করতে পারবো।
ঐশীর ক্ষেত্রে কি বিষয়গুলো বিদ্যমান ছিলো? হোয়াট ওয়েন্ট রং ইন ঐশী’স লাইফ? প্রশ্নটা থেকেই গেলো আমার মনে !
শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।