বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। শুধু উপন্যসই নয়, অবিস্মরনীয় অনেক গল্পের স্রষ্টা তিনি। সৃজনশীল এক স্রষ্টা, যিনি তাঁর লেখায় গভীর মমতায় মাটি ও মানুষের বহুমাত্রিক জীবনালেখ্য ফুটিয়ে তোলেন এক অপূর্ব দক্ষতায়। তাঁর শক্তিশালী লেখনি, ক্ষুরধার বচনভঙ্গিতে লেখা গল্পগুলো যেন সুদক্ষ শিল্পীর তুলিতে আঁকা একেকটি জীবন্ত পোর্টেট। ‘আগুনপাখি’ তাঁর লেখা একটি অসাধারণ উপন্যাস। তিনি তার ফেলে আসা বিচরণভূমি রাঢ়-অঞ্চলকে এই উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
রাঢ়-অঞ্চলের উপভাষায় লেখা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী। একান্নবর্তী পরিবারের একজন সাধারণ গৃহবধূ; যার কোনদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ধীরে ধীরে এই সাধারণ নারীটিই একসময় হয়ে ওঠে অসাধারণ। একজন গৃহবধূ নিজের ছোট্ট পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো ভারতবর্ষের মানবকল্যাণের চিন্তায় নিজেকে সামিল করে ফেলে।
চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই হয়ে ওঠে তার একমাত্র ঠিকানা। বিয়ের পর সেই যে অন্দরমহলে এসে প্রবেশ করে, স্বামী-শ্বাশুরী-ননদ-দেবর-জা’দের নিয়েই গড়ে তোলে তার জগৎ। বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি আর আশেপাশে কয়েক ঘর বাসিন্দার বাইরে সমগ্র ভূ-ভারতের কিছুই তার জানা নেই। বিয়ের পর ধীরে ধীরে অবলোকন করে কমলে-কঠোরে মিশানো তার স্বামীর চারিপাশে আশ্চর্য শক্ত এক বলয়। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটিই একসময় হয়ে ওঠে তার শিক্ষাগুরু; তার একান্ত আগ্রহেই একটু একটু করে পড়তে শেখে। সারাদিন সংসারের নানান ঝক্কি-ঝামেলা সামলিয়ে রাতে একান্তে স্বামীর কাছে শেখে অক্ষরজ্ঞান। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারে দেশের খবর, যুদ্ধ, ইংরেজ শাসন, বহির্বিশ্ব সম্পর্কে।
একান্নবর্তী পরিবারটি আরও বড় হয়, বাড়ে জনসংখ্যা। মোষের গাড়ির পর কত্তার (এই উপন্যাসে স্বামীকে কত্তা বলেই সম্বোধণ করে সে) একটি নিজস্ব বাহন ঘোড়া কেনা হয়; ধন-দৌলতেও বাড়ন্ত অবস্থা দেখে মনেও সুখ জাগে। সে লক্ষ করে তার কত্তা একসময় জড়িয়ে পড়ে সামাজিক কাজে। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কাছেই হয়ে ওঠে সমান জনপ্রিয়। তবে সব সুখ যে চিরস্থায়ী নয় তা সে অল্পদিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করে। ধন-দৌলতে বাড়ন্ত সংসারেও একসময় অভাব এসে ভর করে। পর পর দু’বছর খরা আর বন্যায় ফসল না হওয়ায় সারা দেশে হাহাকার লেগে যায়, তার রেশ এসে পড়ে এই পরিবারের উপরেও। এই অভাবই গভীর মমতা আর ভালোবাসার সেতুবন্ধনে গড়া এই একান্নবর্তী সংসারেও ভাঙন ধরিয়ে দেয়। একান্নবর্তী সংসার ভেঙে যায়, যার যার নিজের আলাদা সংসার হয়।
সংসার আলাদা হবার সাথে সাথেই রব ওঠে দেশ ভাগের। শোনা যায় হিন্দু-মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ হবে। তার মনে প্রশ্ন জাগে- দেশ আবার ভাগ হয় কি করে? হিন্দু-মুসলমানের জন্য আবার আলাদা দেশ কি? ধীরে ধীরে লক্ষ করে তার কত্তা প্রায় সময়ই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। যারা এই আলাদা দেশ চায় তাদের উপর। দেশ ভাগ নিয়ে স্বামীর ক্ষোভ দিনে দিনে তার মধ্যেও সঞ্চালিত হয়। স্বামীর রাগ করে বলা কথা তার মধ্যেই দারুণভাবে প্রভাব ফেলে-
“এই জিন্না লোকটা একটা দিন জেল খাটলে না, একটা দিন উপোস করলে না গান্ধীর মতো, মুসলমানের কিছুই নাই তার, জানাকাপড় আগে পরত সাহেবদের মতো, এখন মুসলমানদের নেতা হয়েছে, শেরওয়ানি পরে, মাথায় পরে তার নিজের কায়দার টুপি” কিংবা
“সারা দেশের মানুষ কি চায়, না চায়, তার খবর নিতে হবে না? কাগজ-কলম নিয়ে শুধু ঘরে বসে আঁক কষলেই হবে?”
“কোথা ভারতের স্বাধীনতা তার কোনো খবর নাই। আঙুলটা পর্যন্ত কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তোলে নাই আর যখুনি এই দেশের স্বাধীনতা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার অবস্থা ব্রিটিশদের, দিশেহারা অবস্থা, তখুনি সে বলছে মুসলমানদের আলাদা দেশ দিতে হবে। আবার প্যাটেল-ম্যাটেল কটা হিন্দু নেতা আছে যারা হিন্দু-মুসলমান দুই দুই না করে কোনো কোথা ভাবতেও পারে না। ”
এভাবেই একসময় সত্যি সত্যিই লেগে গেল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। শহরে শুরু হওয়া হানাহানি-কাটাকাটি গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লো। “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” বলে মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো, তেমনি হিন্দুরাও মুসলমান বধে ঝাপিয়ে পড়লো। দেশ ভাগ হল।
এই দেশ ভাগের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় দেশ ছাড়ার হিড়িক; তথা শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট। এই নারীও সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পায় না। একে একে চার সন্তান তাকে ছেড়ে পরবাসী হয়। সবশেষে তার স্বামী, যার কাছে তার হাতেখড়ি, সমস্ত স্বত্বা জুড়ে সে যার সাথে মিশে আছে, সেও যখন সব ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমানোর কথা ভাবে- তখন বিদ্রোহ করে বসে সে। যে কোন কিছুর মূল্যে দেশ ছেড়ে যাবে না সে।
“আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর যায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।”
একজন সাধারণ নারী দেশ-মাটির টানে সবকিছু তুচ্ছ করে, কেবলমাত্র শেকড়ের জন্য নিজের সবকিছু ত্যাগ করে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিতেও দ্বিধা করে না।
এভাবেই হাসান আজিজুল হক তার আগুনপাখি উপন্যাসে শেকড় ছেঁড়ার কষ্টগাঁথা তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। আশা করি সমস্ত পাঠকদের উপন্যাসটি ভাল লাগবে।
এস এম জাকির হোসেন
কথাসাহিত্যিক, ঢাকা।