আমি যখন ব্রিসবেনে গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখনকার গল্প বলি।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের রেডি করে, স্কুলে দিয়ে, কেনমোর থেকে মাউন্ট গ্রাভাট ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করে পাহাড়ের নীচে গাড়ি পার্ক করে, পায়ে হেঁটে পাহাড়ের ওপরে উঠে সারাদিন ক্লাস করে আবার ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করে স্কুল থেকে বাচ্চাদের তুলে বাড়ি ফেরা ছিল প্রতিদিনের রুটিন।
এই প্রতিদিনের জার্নিতেও অনেক গল্প আছে কিন্তু আজকের গল্পটা আমাকে নিয়ে নয়। বন্ধুদের নিয়ে।
প্রথম সেমিস্টারেই একটা ছোট বন্ধু মহল গড়ে উঠেছিল। অনেক বেশী গ্রুপ প্রোজেক্ট থাকতো আমাদের। একসঙ্গে লম্বা সময় নিয়ে রিসার্চ করতে হতো, কাজের ফাঁকে লাঞ্চ করা কিংবা চা কফি খাওয়া ইত্যাদি করতে করতে একজন আরেকজনের হাঁড়ির খবর জানা হয়ে গিয়েছিলো খুব অল্প সময়েই। ওরা সবাই ছিল বয়সে তরতাজা তরুণী। সদ্য এইচএসসি পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে, আর আমি তখন ২ বাচ্চার মা (এই বয়সে কেন ব্যাচেলর ডিগ্রী করতে ঢুকেছি সে গল্প আরেকদিন করা যাবে)।
আমরা ছয় জন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। একজন আরেকজনের বাসায় যাওয়া আসা শুরু করলাম। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেও চেনা পরিচয় বাড়তে থাকলো। একদিন এক বন্ধুর জন্মদিনে তার বাসায় স্লিপওভার করেছিলাম আমরা সবাই, সেই রাতে আমি ওদের সবার জন্য শাড়ী গয়না নিয়ে গিয়েছিলাম, আমরা সবাই অনেক রাত পর্যন্ত সাজগোজ করে নেচে গেয়ে, মহা আনন্দে জন্মদিনের উৎসব পালন করেছিলাম।
এদের বেশীরভাগই এইচএসসি পাশ করে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। সরকার থেকে স্টুডেন্টদের জন্য যেই টাকা (Austudy- youth allowance) দেয়া হতো, সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া দেয়ার পর যা থাকতো অনেক হিসেব করে খাওয়া খরচসহ অন্যান্য খরচ চালাতে হতো ওদের। মাঝে মাঝেই একসঙ্গে বাজার করতে যেতাম। ফ্যামিলি বাজার আর ব্যাচেলর বাজারতো একরকম নয়। তাই ওদের বাজার করার ধরন দেখে আমার নিজের খুব লজ্জা লাগতো। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও একটা একটা করে সবজি বা অন্যান্য কিছু খুব সামান্য করে কিনতাম।
ইউনিভার্সিটির শেষের দিকে একবার ইস্টারের ছুটিতে ক্যাম্পিং এ গিয়েছিলাম ওদের সাথে । ব্রিসবেন শহর থেকে ৩/৪ ঘণ্টা ড্রাইভ করে একটা পাহাড়ি এলাকায়। পাথুরে পাহাড় আর ঘন জঙ্গলের সমন্বয়ে জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল। কিন্তু আমার কিছু ভাবতে হয়নি।ওরা আমাকে এতো বেশী ভালোবাসতো, (এখনও ভালোবাসে) যে, সব আয়োজন ওরাই করেছিলো। ক্যাম্পিং এর সব খাওয়া দাওয়া, গরম কাপড়, স্লিপিং ব্যাগ, টেন্ট সব কিছু ওরাই জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছিলো। সারারাত ক্যাম্প ফায়ারের সামনে বসে কতো খেলা, গল্প, গান, নাচ। অত্যন্ত স্মরণীয় একটি সময় ছিলো সেটা।
আমি ছাড়া বাকি পাঁচ জনই অস্ট্রেলিয়ান কিন্তু তাতে কোথাও কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বয়সের ব্যবধান কোন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, গায়ের রঙ বা ধর্ম মাঝখানে এসে কোন বাঁধ সাধেনি। আমরা অনাবিল আনন্দে মিশে গিয়েছিলাম প্রকৃতির সাথে সেই ৩/৪ দিন।
ক্যাম্পিং থেকে ফিরবার পথে ওরা টুকটাক জামা কাপড় কিনবে বলে একটা ছোট টাউনে থামলো, সেখানে খুঁজে খুঁজে স্যাল্ভেশন আর্মিদের দ্বারা চালিত পুরনো কাপড় চোপড়ের দোকানে ঢুকে গেলাম আমরা। ১ ডলার ২ ডলারে জামা, জুতা, কিংবা অন্য দরকারি জিনিষ কিনতে দেখে খুব শ্রদ্ধা জাগলো আমার।কি যে ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারবো না।এই যে ১৮/১৯ বছরের মেয়েগুলো বাসা থেকে বাইরে থেকে, খুব অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে এতো হিসেব করে জীবন চালাতে শিখেছে, এটা নিজের চোখে না দেখলে জানতে পারতাম না।
এরপর আমার পুরো পরিবার নিয়ে, ওরা এবং ওদের ভাই বোনদের সাথে নিয়ে আরেকটা স্মরণীয় ক্যাম্পিং করেছিলাম আমরা। ওরা এখনও আমার খুব কাছের বন্ধু, এদের মধ্যে কয়েকজন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ বিয়ে করে সন্তানের মা হয়েছে। আমাদের মেসেঞ্জারে গ্রুপ রয়েছে সেখানে সবাই সবার আপডেট জানতে পারি। প্রতিবার ব্রিসবেনে যাওয়ার সাথে সাথেই ওদের সাথে দেখা করা, লাঞ্চ বা ডিনার করে আবার মিলিত হওয়া নিয়ে কখনো কারো মধ্যে কোন ক্লান্তি দেখিনি আমি।
সবাই চাকরী করছে, পিএইচডিও করেছে ওদের মধ্যে একজন। সবাই প্রতিষ্ঠিত এখন।
অভাব নিয়ে গর্বের ব্যাপারটা বলতে যেয়ে এতো গল্প করলাম। আমার বিশ্বাস জীবনে টানাপোড়েন না থাকলে সত্যিকারের জীবনকে উপলব্ধি করা যায়না। যার সব থাকে, সে সব থাকার মর্মই বুঝতে পারে না। কারণ কেবল মাত্র না থাকলেই থাকার সুখ খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব।
তাই অভাবে লজ্জা নেই কোন, অনেক কষ্ট আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবুও লজ্জা থাকতে নেই। আমি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। শুধু কষ্টের কথা ভাবলে হয়তো মন খারাপ হবে কিন্তু কষ্টের খোলসে মোড়ানো অভিজ্ঞতা জীবনের সত্যিকারের মূল্যবোধ শেখায়। আমার বেড়ে ওঠার সময় আমার দারিদ্রই আমার সবচেয়ে গর্বের স্তম্ভ।
শিল্পী রহমান: গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। কর্মসূত্রে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।