আমরা সব সময় বলি আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই আগামী দিনে আমরা একজন মানুষের কাছে কি প্রত্যাশা করি? আরও বলি শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে, এটা তার জন্মগত অধিকার। সে জন্যে তাদের সঠিক যত্ন ওপরির্চযার প্রয়োজন। এই ‘সুনাগরিক’ কথাটার অর্থ কী এবং সঠিকযত্ন ও পরিচর্যাই বা কেমন? এই শব্দগুলোর মোটামুটি একটা সাধারণ অর্থ থাকলেও, প্রত্যেকটা মানুষের কাছে এগুলোর অর্থ বা গভীরতা ভিন্ন। মূল্যবোধের জায়গা থেকেও প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজ পরিবার, সমাজ এবং জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নেওয়া আদর্শই তাদের সন্তানকে শেখাতে চায়।
একজন মানুষ জন্ম থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার মধ্যে দিয়েই জীবন শেখে, তাই সেই শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা যেন তারা একটি সুস্থ্য ও সুখী পরিবেশ থেকে গ্রহন করতেপারে সেটাই হবে প্রধান লক্ষ্য। আমরা কী আমাদের সন্তানকে সেটাদিতে পারছি?
প্রথমিক দায়িত্বটা যদিও পরিবারের কিন্তু একটি শিশু ৩/৪ বয়সথেকেই স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে যেতে শুরু করে, শুরু হয় বাইরেরজগতের সাথে ওঠা বসা। পিতা মাতার আচার ব্যাবহার, নীতি–নৈতিকতার সাথে সাথে শিশুটি স্কুল থেকেও এসব শিখতে শুরু করে।মা–বাবার পরেই একটি শিশুর বিকাশে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করেন শিক্ষকেরা। এরপর রয়েছে সমাজ। পিতা মাতা, সমাজ এবং শিক্ষক মিলে একটি গোষ্ঠী-এই গোষ্ঠী একটি শিশুরমানসিক বিকাশে নির্দেশক আর পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশাল অবদানরাখে।
আমরা আমাদের সন্তানদের মুখে বলে বা বুঝিয়ে জীবনের পথ চলাশেখাতে চাই, কিন্তু তারচেয়েও যেটা বেশি কার্যকর, সেটা আমাদেরনিজেদের ব্যাবহার এবং মূল্যবোধ। আমাদেরই পথিকৃৎ বা ‘রোলমডেল’ হতে হবে তাদের জন্য অর্থাৎ শুধু মুখে নয়, আমাদের আচরণএবং ব্যবহৃত ভাষা হতে হবে সুস্থ্য এবং সুশীল। লক্ষ্য করবেন, আমরাবাড়িতে যেসব কথা বলি, একদম দু বছরের শিশুও সেটা তৎক্ষণাৎশিখে ফেলে। আমরা আহ্লাদ করে বলি, “ছেলেটা বা মেয়েটা খুব স্মার্টহয়েছে” । কথাটা একদম সত্যি কিন্তু আমরা কী সেটা মাথায় রেখেআমাদের ভাষা বা আচরণে পরিবর্তন এনেছি? ফোনে আমরা কীবলছি কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় কী কথা হচ্ছে শিশুরা খুব সহজেইতা শিখে নেয় । তারপর কোন একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়েঅনেক মানুষের মাঝে বেফাঁস বলে ফেলার কারণে হয়তো তারা বকাবা মারও খায়। কিন্তু তার সেই ভুলের দায় কিন্তু আমাদের।
আমরা মুখে বলে ওদের যেটা শেখাতে চাই, তার চাইতে বেশি শেখেআমাদের দেখে, তাই আমাদের সঠিক কাজটা করতে হবে। আমরাবাড়ির সাহায্যকারী, রিকশাওয়ালা কিংবা ওয়েটারের সাথে কীআচরণ করবো সেটা আমার সন্তান আমাকে দেখেই শিখবে। কারোগায়ের রঙ সাদা কিংবা কালো দেখে কি মন্তব্য করবো, চিকন বা মোটামানুষ সম্বন্ধে কী ধারণা পোষণ করবো সেটা আমার সন্তান জেনে যাবে, কারো পোশাক নিয়ে আমার মানসিকতা তাদেরকেও প্রভাবিত করবে, এমন কি আমার চোখের ভাষাও পড়ে নিতে পারে তারা। বাড়িতেস্বামী তার স্ত্রী বা পরিবারের অন্যদের সাথে কী ব্যাবহার করছে, গালাগালি থেকে শুরু করে মারামারি পর্যন্ত। স্ত্রী তার স্বামী বাপরিবারের অন্যদের সাথে কেমন ব্যাবহার করছে বা কতোটা অত্যাচারনিজে মেনে নিচ্ছে এর সবই তাদেরকে প্রভাবিত করে। এসব দেখেবেড়ে ওঠা সন্তানদের মানসিক সুস্থতার সম্ভাবনা কম, কখনো দেখাগেছে একটি ৭/৮ বছরের শিশু পরিবারের শান্তি রক্ষার্থে সবার মনরক্ষা করে চলতে শিখে গেছে– আপাত দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্মী বা স্মার্টমনে হলেও এই কাজটা করতে তার কচি মনে অনেক চাপ পড়ে যাআমরা লক্ষ্যই করিনা। আর সেটা ভবিষ্যতে আরও বড় আকার ধারন করতে পারে।
কেন মানসিক সুস্থতা নিয়ে কথা বলছি?
কারণ মানসিক সুস্থতাই পৃথিবীতে সুখী মানুষের সংখ্যা বাড়াবে– প্রচুরটাকা, খ্যাতি কিংবা বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়। মানসিক সুস্থতায় ক্রাইমকমে যাবে, কম সংসার ভাঙবে, কম হতাশা এবং উৎকণ্ঠা মানুষেরজীবনের মান উন্নত করবে এবং আমরা তখনই সুনাগরিক তৈরিকরতে সক্ষম হবো।
সারাবিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর১০ই অক্টোবর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়।বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান, কনফারেন্স, সেমিনার, এবং লেখালেখি,কিন্তু তবুও তা যথেষ্ট নয় । আরও প্রচার চাই, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থারআরও উন্নতি চাই আকার প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেইসীমিত।
একজন মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটা তার শারীরিকস্বাস্থ্য ঠিক থাকা দরকার ঠিক ততটাই তার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাপ্রয়োজন। সমস্যা হল আমাদের দেশে ‘মানসিক অসুস্থতা’ শুনলেমানুষ অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিংবা বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করে যাঅত্যন্ত অমানবিক এবং নিষ্ঠুর। যে ব্যক্তি মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেতার জন্য এমন ব্যাবহার গ্রহন করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে, তখনতারা নীরবে দূরে সরে যেতে থাকেন। নিজেদের অসুস্থতাকে লুকিয়েরাখতে চেষ্টা করেন এবং কেউ তাকে পাগল ভাবতে পারে এই ভয়েকোনরকম চিকিৎসা নেবার কথা ভাবতেও পারেন না। নিজে নালুকালেও, পরিবারের মানুষ লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করে অথবাচিকিৎসার জায়গায়, বেদনা চেপে রাখবার পরামর্শ দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কেউ না কেউ আত্মহত্যাকরে । আত্মহত্যা করার জন্য দায়ী মূলত মানসিক স্বাস্থ্য, একজনমানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সে কখনোই আত্মহত্যার দিকেধাবিত হবে না । আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশইপ্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু কেন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না? মানসিকসমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলেই তার যথাযথ চিকিৎসা করা হয়না । মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের সাথে সাথে আত্মহত্যার হার কমিয়েআনা সম্ভব । মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলে গন্য করা হয়না, তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি মানুষ সহমর্মিতা দেখাতেপারেনা। মায়ার বদলে তাদের মেলে তিরস্কার আর ভর্ৎসনা, কিংবাঅবহেলা।
আমরা নিজের অজান্তেই অনেক কথা বলে ফেলি বা আশেপাশেএকটা আবহ তৈরি করি, তাতে আমাদের সন্তান বা কাছের মানুষেরামানসিক অসুস্থতাকে দুর্বলতা মনে করে বেড়ে ওঠে। তারা শেখেসবকিছুতেই তাদের ‘বেষ্ট’ হতে হবে। আচার ব্যাবহার, পড়াশুনা, চাকরী, বিয়ে এবং পরবর্তীতে তাদের সন্তান – কোনো কিছুতেই পিছিয়েযাওয়া চলবে না। দুঃখজনকভাবে বেষ্টের কম হলেই তা লজ্জার বিষয়,লুকিয়ে রাখবার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । এটাই আমরা শেখাচ্ছি ওদের, এবং এই ভাবনাই তাদের তাড়িত করছে , উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে, অসুস্থকরে দিচ্ছে। হতাশার বিষয় হল, এটা অনেক বড় এবং শিক্ষিতহওয়ার পরেও পরিবর্তন হয়না।
বিশ্বে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। আমাদেরদেশে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের মানসিকসমস্যায় ভুগছে। তাদের মধ্যে গড়ে ৯৩ শতাংশ মানুষ চিকিৎসানিচ্ছেন না । এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, রয়েছে গাফিলতি। সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করতে পারে বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন ।
ডঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন বাংলা রেডিওরএকটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা আনবার জন্যতাদের স্তরে দাঁড়িয়ে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে । একই ভাষাসবাইকে একইভাবে নাড়া দেয়না, তাই যে মানুষ যে ভাষা বোঝে, তাকেসেভাবেই বোঝাতে হবে। গণমাধ্যমের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, শুধু বিজ্ঞাপনে তেমন কাজ হবে না। তার চেয়ে নাটক বা ছায়াছবিরমাধ্যমে দ্রুত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা।
দেশে মানসিক সমস্যায় ভুগছে এমন শিশুদের মধ্যে ৯৪ দশমিক ৫শতাংশ এবং বড়দের মধ্যে ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ চিকিৎসাসেবাথেকে বিরত থাকে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ মানসিকস্বাস্থ্য চিকিৎসায় বরাদ্দ, তার থেকে ৬০ শতাংশ খরচ হয় মানসিকহাসপাতালগুলোতে। পাথমিক চিকিৎসা বা থেরাপিতেই অনেক মানুষসুস্থ হয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে হাসপাতাল পর্যন্ত হয়তো যেতেই হবেনা। অনেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসারকোনো ব্যবস্থা নেই। দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও অনেক সংকটআছে। তবে আশার কথা হল, ডঃ হেলাল বলেছেন, ২০৩০ এর মধ্যেদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের সুচিকিৎসা বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।
আসুন মানসিক অসুস্থতার স্টিগমা থেকে বেরিয়ে আসি। নিজেদেরকথোপকথনের দিকে মনোযোগ দেই কারণ শিশু বয়সের শিক্ষার সাথেভবিষ্যতের মূল্যবোধের বিরোধ লাগলে বয়ঃসন্ধির সময় তারাউভয়সংকটে পড়তে পারে। আমাদের সন্তানেরা সুস্থ মানসিকতা নিয়েবেড়ে উঠুক, কারণ আজকের সুস্থ মনের শিশুই, ভবিষ্যতেরআলোকিত মানুষ।
শিল্পী রহমান : লেখক, কাউন্সেলর । ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া ।