
রবীন্দ্রভারতী থেকে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে শিক্ষাপ্রাপ্ত আমার বাবা আজাদ রহমানের ওয়েস্টার্ন মিউজিক আর বাদ্যযন্ত্রের এর প্রতি ছিল ভীষণ রকম আকর্ষণ। সারাক্ষণ পিয়ানোতে বিভিন্ন রাগ বাজাতেন। আমাদের বাসায় একদিকে যেমন চলত উস্তাদ বড়ৈ গুলাম আলীর কণ্ঠের আলাপ, সেইসাথেই শুনতাম বেটোফেন আর মোজার্টের সিম্ফনি। আব্বু আমাদের কখনো শিশু পার্ক বা চিড়িয়াখানাতে ঘুরাতে নিয়ে যাননি। আমরা যেতাম বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে, কাইট ফেস্টিভ্যাল আর ইকেবানা ওয়ার্কশপে, রেকর্ডার আর পিয়ানো শিখতে। আমাদের ছোট বেলার খেলাড় আঙ্গিনা ছিল শিল্পকলা একাডেমীর চত্বর, দেখতাম নাটক, নকশি কাঁথার মাঠের নৃত্যনাট্য, উপভোগ করতাম দরবারি নৃত্যের রাজকীয় ভঙ্গিমা, মনিপুরী সংস্কৃতি কিংবা সাপের খেলা – তাও গুণী শিল্পীদের নৃত্যের তালে তালে। আব্বুর হাতে গড়া মুভিটোন স্টুডিও দেশের সবচাইতে পুরানো সাউন্ড স্টুডিও গুলোর মধ্যে একটি। আমাদের অলস সময় কাটতো গান তৈরির এই কারখানাতে। একসাথে অনেক যন্ত্রী বাজাতেন আর সেই সাথে গায়ক গায়িকা গান করছেন, পুরোটা এক টেইকে, কোন ভুল নেই, নেই আবেদনের কমতি। কতো ছোট ছিলাম, কিন্তু নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি যে এরকম আরেঞ্জমেন্ট দেখেছি।
গত তিন সপ্তাহ আব্বুকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ পড়লাম। অনেক গুণী মানুষ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে তাঁর বিভিন্ন অবদান নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু ওনার তৈরি ছোটদের গান নিয়ে কোথাও কোন লেখা পেলামনা, বা হয়তো কেউ লিখেছেন, আমার চোখে পড়েনি। আমার বাবা আজাদ রহমান নানা প্রজন্মের জন্য যে বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডার রেখে গেছেন, তার অনন্য উদাহারন এই ‘ছোটদের জন্য গান’। আজ তাঁর অল্প কিছু গান নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করলো।

১। যখন আমি খুব ছোট, বয়স তিন বা চার, মনে আছে শিশু সংগঠন (বর্তমান শিশু একাডেমী) এর অনুষ্ঠানে গান করবার কথা। আব্বুর পরিচালনায় সেসব অনুষ্ঠানে এক ঝাঁক শিশু কিশোরীরদের মাঝে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। আমার জীবনের স্টেইজে গান করবার সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি মনে হয় এইটাই। খাদির শালওয়ার কামিজ পরে এক কাতারে সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গাইতাম,
আমরা জাতির ভবিষ্যৎ,
আমরা দেশের ভবিষ্যৎ,
আমরা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।
সততা দিয়ে, মমতা দিয়ে আমাদের গড়ে তোল
নাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।।
মোরা নিয়ম মানতে চাই, মোরা জীবন জানতে চাই।
শিক্ষা দিয়ে, সাধনা দিয়ে আমাদের গড়ে তোল
তাহলে পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, ‘শিক্ষা’ আর ‘সাধনা’ এই দুটি শব্দ আব্বু আমাদের জীবনে গেঁড়ে দিয়েছিলেন সেই ছোট থেকেই। যেমন বলিষ্ঠ কথা, তেমনি আধুনিক সুর। এই গানটি যতবার গাই, শিউরে উঠি! কই, এরকম গানতো আর পাই নি!
২। আব্বু যখন রেডিও তে কাজ করছেন, তখন মিউজিক ডাইরেক্টর দের একটা কনফারেন্সে এ যোগ দিতে রাশিয়া সফরে গেলেন। আমাদের জন্য নিয়ে আসলেন রাশিয়ান পুতুল। অবিকল মানুষের মত। আর আনলেন গল্পের ঝুড়ি। রাশিয়ান ব্যালেড তখন বিশ্ববিখ্যাত। আব্বু সেবার মস্কোতে শিশু কিশোরীদের পরিবেশনায় একটা নৃত্যনাট্য দেখেছিলেন। সে গল্প অনেক শুনেছি। একটা বড় গাছ, ডালপালা ছড়িয়ে সূর্যের সব আলো শুষে নিচ্ছে। আর তাঁর আসে পাশের ছোট গাছগুলো (আব্বুর মতে টম্যাটো গাছ)কোন আলো পাচ্ছিলনা। তাই ছোট গাছগুলো মিলে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে।
আব্বু তৈরী করে ফেললেন সমঅধিকারের গান, আমরাও হারমোনাইজ করে গাওয়া শুরু করলাম,
‘অন্ধকারে থাকবোনা, বন্ধঘরে থাকবোনা
যাব আলোর দেশে।
সূর্যের সব আলো কেড়ে নিয়ে
সারা দুনিয়ায় সে আলো দেবো ছড়িয়ে।
কোন বাধা মানবোনা, কোন কথা শুনবোনা
মিথ্যের আশ্বাসে করবোনা সন্ধি
ছোট বড় রাজা প্রজা সকলের অধিকার
পৃথিবীর সম্পদ একা কারো নয়
আলো কেন কারো ঘরে হবে বন্দী?
বন্দীশালার তালা ভেঙ্গে দিয়ে
সারা দুনিয়ায় সে আলো, সারা দুনিয়ায় দেবো ছড়িয়ে।।
কি অসামান্য সৃষ্টি! শিশু বয়সে স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি, সুন্দর মননশীলতা তৈরী করবার জন্য যথেষ্ট নয় কি? সাম্রাজ্য ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, কিন্তু কিছু আদর্শ, কিছু নীতিকথা ঠিকই রয়ে যায়।
৩। নতুন কুঁড়ি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রচারিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। আজকের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী নতুন কুঁড়ি’র মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছেন এবং আমাদের সাংস্কৃতিক জগত আলোকিত করেছেন। নতুন কুঁড়ি’র ‘টাইটেল সং’ টা মনে আছে? ‘আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে’? কি দারুণ অরকাস্ট্রেশন! সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মুস্তাফা’র অপূর্ব কবিতায় আব্বুর কম্পোজিশন। আব্বু খুব সাবলীল ভাবে ইস্টার্ন আর ওয়েস্টার্ন ধারাকে একসাথে উপস্থাপন করতে পারতেন। তারই অসাধারণ নিদর্শন এই গানটি।
৪। সাউন্ড অফ মিউজিক ছিল আব্বুর সবচাইতে প্রিয় সিনেমা। ওনার খুব ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে এই বিখ্যাত গল্প অবলম্বনে একটা সিনেমা হবে। আব্বু তখন এসো গান শিখির জন্য গান তৈরি করছেন। লিখে ফেললেন;
সা সা সা সা সাত স্বরের রাজা
রে রে রে রে রেল গাড়িতে চড়ে
গা গা গা গা গানের দেশে যাবে
মা মা মা মা মা কে সাথে করে
পা ধা নি এলো হেসে হেসে
তারা ও যাবে যে সে দেশে
সবে মিলে একসাথে কত দিনে কত রাতে
তেপান্তরের মাঠ পেড়িয়ে, ডাইনী বুড়ির চোখ এড়িয়ে
হাজার বছর ধরে অনেক কষ্ট করে
অবশেষে এলো তারা গানের রাজ্যে।
সারেগামা মহাখুশি, গলাগলি হাসাহাসি।
শ্রদ্ধেয় ফেরদৌসি রহমান ফুপু কি যত্ন সহকারে আর মমতায় ছোটদের শেখালেন ‘সাত স্বরের রাজা’, ‘মানুষের মত দেখতে হলেই মানুষ হয়না শিক্ষা ছাড়া মানুষকে কেউ মানুষ কয়না’, ‘সোনালি ধানের দেশ রুপালী মাছের দেশ আমাদেরই দেশ বাংলাদেশ’। শ্রদ্ধেয় জেবুন্নেসা জামাল ফুপুর লেখা আর আব্বুর সুরে ‘জাদুর পেন্সিল আহা জাদুর পেন্সিল’, ‘তোমরা বল সন্ধ্যে হলে যদি ভো ভো করে মশা’।
৪। একটু বড় হলে বিটিভির ‘অঙ্কুর’ অনুষ্ঠানের জন্য শিখলাম আরও কিছু গান।
এই জীবন অমূল্য ধন
জীবন কে সুন্দর করতে হবে
প্রতিটি মুহূর্ত একান্ত নিষ্ঠায়
শিক্ষায়, সাধনায়, কর্মের সততায়
নিজেকে নিজেই গড়তে হবে।।
আরেকটি গান ছিল-
এই বিশ্ববাসী একই সুতোয় গাঁথা, বিচ্ছিন্ন কেউ নয়
তাইতো একের দুঃখ বোঝা অপরকে বইতে হয়।
এক দেশের বৃষ্টিতে অন্য দেশ ভাসে
রোগজীবাণু বয়ে নিয়ে অকাল বন্যা আসে
শান্তি সুখের সর্গ ভাঙ্গে জীবনে আসে প্রলয়।।
আমার বাবার এই গানগুলো তাঁর সন্তানদের জীবন প্রতিনিয়ত গড়তে সাহায্য করছে।
আমরা তিন বোন কেউই হয়ত সঙ্গীতকে জীবনধারণের জন্য পেশা হিসেবে নেইনি অথবা নিতে পারিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সঙ্গীতকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করাটা জরুরী, আর সে জন্য প্রচুর সময় দিতে হয়, যুগ যুগ সাধনা করতে হয়। এর সাথে কোনরকম ছলচাতুরী চলেনা। এটাও আমাদের শিক্ষা। তাই সঙ্গীত আজও আমাদের জন্য ভালবাসার জায়গা, মনের খোঁড়াক। আমি সাধুবাদ জানাতে চাই আমাদের দেশের সকল গুণী শিল্পীদের উত্তরসুরীদের, যারা সব বাঁধা পেড়িয়ে পরম যত্নে আর সাধনায় আগলে রেখেছেন তাঁদের বাবা মা’র শিক্ষা, গান আর পরিচিতি।
আব্বু বলতেন, ‘সঙ্গীত শুধু বিনোদন নয়, সঙ্গীত বিদ্যার বিষয়’। সঙ্গীত শিক্ষা শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশে কিংবা সুন্দর মননশীলতা গড়তে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে। আমার বাবা সেই উপলব্ধি থেকেই শিশুদের উপযোগী গান তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন। কিশোর কিশোরীদের ওয়েস্টার্ন কয়ার এর আদলে গান শেখাতে পছন্দ করতেন। ওনার সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীরা এখনো বলেন, তাঁদেরকে তিনি কত যত্ন করে গান তুলে দিতেন, যে সব গান এখনো তাঁরা ভুলতে পারেননি।
আজাদ রহমান এর ছোটদের জন্য এই গান গুলো দেশের মূল্যবান সম্পদ। শিশুদের সঙ্গীতের মাধ্যমে জীবনবোধ শেখাবার হাতিয়ার। তাই এসকল গান সংরক্ষণে যত্নবান হতে হবে।
৭ জুন ২০২০।
রোজানা আজাদ
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।