আদার ব্যাপারী যখন জাহাজের খোঁজে – এস এম আলী আকবর

  
    

প্রথম পর্ব

(প্রথম পর্বের পর)

 

নিরীহ ও মূর্খ রোহিঙ্গাদের গ্রাস হতে ১২/১৪ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র রাখাইন ভুমি কেড়ে নিয়ে, বর্বর বার্মিজ ও তাঁর দোসর পরাশক্তিদের কোন স্বার্থ উদ্ধার হচ্ছে, বুঝে আসছেনা! তাইতো মনে প্রশ্ন-

১) আন্তর্জাতিক কুটনীতির কোন নর্মে বিশ্ব প্রভুরা, জনচাপে পিষ্ট এক ভুমি-কাঙ্গাল সার্বভৌম রাষ্ট্রে, অপর এক জনবিরল রাষ্ট্র হতে কারণ বিহীন জবরদস্তি মানব-পুশিংকে নির্লিপ্ত সম্মতি দিয়ে যাচ্ছে?
২) মিয়ানমারের একতরফা আগ্রাসনকে, চীন কোন যুক্তিতে দ্বিপাক্ষিকভাবে মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছে? এখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের দোষটা কি?
৩) কোন ধরণের বন্ধুত্বের বলে ভারত, তাঁর দেশে ঢুকে পড়া মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদেরকে সরাসরি মিয়ানমারে ফেরত না দিয়ে, বাংলাদেশেই ঢুকিয়ে দিচ্ছে? এ লজ্জা কার?
৪) আকিয়াব বন্দর সংশ্লিষ্ট রাখাইন অংশটুকু ব্যতিত হিংসুটে বার্মিজ ও তার দোসরদের শ্রাদ্ধ যদি নাই সারা যায়, সেক্ষেত্রে অগাধ ভুমির বার্মারই কোনো পতিত অঞ্চলে ‘রোহিঙ্গা প্রাণী!’ গুলোকে ইউএনকে বলে কয়ে ফেলে না ৫) বর্বর বার্মিজ! যেখানে ক’দিন আগেও ৪০ ডলার, কিছু চাল আর কেরোসিনের বিনিময়ে সেনা বাহিনীতে শিশু নিয়োগ করা হত, যেখানকার নাগরিকত্বও আবার ৩ শ্রেনীতে বিভক্ত! বিশ্বব্যাপী ওদের কত বড় বড় বন্ধু! অথচ সাম্য, শান্তি ও গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের কোনো শুভাকাঙ্খির দেখা নেই!
৬) দুঃখজনক! রোহিঙ্গাসহ দেশীয় জনচাপে পিষ্ট জাতির পোটল তোলা অবস্থার বর্ণনা না দিয়ে, বাংলাদেশী বোদ্ধাগণ যখন, রাখাইন ভুমি বিহনে চীনের ক্ষতি, ভারতের স্বার্থহানী আর রাশিয়ার কষ্টের ফিরিস্তি টক-শো গুলোতে বর্ণনা করেন, তখন একদলা থুতু ফেলা ছাড়া আর কি করার থাকে?
৭) পদদলিত মানবতার কৃত্রিম এই রোহিঙ্গা-নাটকে বিশ্ব নিশ্চুপ কেন? দেশের কুটনীতিবিদবর্গ কি ভাবছেন?

তদুপরি যদি শোনা যায়, অভিশপ্ত এ দেশটিতেই পুশিং এর জন্য ভারতের আসাম রাজ্যে আরো ৪০ লক্ষ নিরীহ মুসলমানকে প্রস্তত করা হচ্ছে! বুঝতে পারছিনা, ১৯৭১ এর পর এতগুলো বাঙ্গালী মুসলমান কোন কারণে ভিন্ন রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সাজতে কবে, কখন, কিভাবে সজ্ঞানে আসাম চলে গেল? বিশ্বব্যাপী এসব কি হচ্ছে, ‘আল্লাহর গজব’ কি সত্যি আসন্ন?

মনে হচ্ছে, সভ্যতা বিনাশী হালাকু-চেঙ্গিসীয় নিবর্তন ধারা পূণঃপ্রবর্তনের পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে, হায়েনার দল নিরীহ ও মূর্খ রোহিঙ্গাদের সাথে জনচাপে ক্লিষ্ট ‘দুর্বল!’ বাংলাদেশকেও টার্গেট করেছে! শত অবিচার স্বত্বেও, কারো প্রতি দোষারোপ না করা, জীবনযুদ্ধে শ্রান্ত দেশটিকেই পা-চেপে, ধাক্কা মারা হচ্ছে! ‘ডাঙ্গায় কুমির আক্রান্ত’ দেশটির দিকে তাকানোর কি কেউ নেই ? তাহলেতো প্রাপ্য অধিকারেই বলতে হয়-

১) বিনা কারণ বিনা উষ্কানীতে ১১ লক্ষ নিজ নাগরীককে, ভুমি ও কর্ম কাঙ্গাল অন্য একটি রাষ্ট্রে পুশিং এর দায়ে মিয়ানমারকে বিশ্ববিবেকের চাপেই আন্তর্জাতিক কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে!
২) বাংলাদেশের অনুপাতে ৩ গুণ বেশী ভুমি লাভ করা মহাত্মাজীর ভারতের কাছে, পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্বের তুলনায় ৫ গুণ বেশী ভুমি বরাদ্দে নিশ্চুপ থেকে, এতদিন পর বঞ্চিত(বন্ধু!) বাংলাদেশকেই অসমীয় সংখ্যালঘু ইস্যুতে উল্টো উষ্কানী দেয়ার, সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চাইতে হবে!
৩) বাংলাদেশের অনুপাতে ৫ গুণ বেশী ভুমি পাওয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ৭১ এর ক্ষতিপূরণসহ ৪৭ এ পূর্ব পাকিস্তানকে চরম ভুমি বঞ্চনার দায়ে, আন্তর্জাতিক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে হবে!
৪) এককালের প্রভূ বৃটিশ কর্তৃক স্বাধীণতা দানের নামে বাচ-বিচারহীন যাচ্ছতাই সীমানা নির্ধারণের দায়ে, খোদ কমনওয়েলথ এ, বৃটেনের চরম হেলাফেলার প্রতিবিধান চাইতে হবে! অন্যথায়-
৫) মিয়ানমারের মত হিংসুটে প্রতিবেশীসহ একচোখা বিশ্বে টিকে থাকতে, দেশটির সকলকে ‘বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ’ই নিতে হবে! নিরন্তর চাপ-তাপে কয়লার হীরায় রূপান্তর ছাড়া উপায় কি?

ভয় নেই, বাংলাদেশীরা এতটা কান্ডজ্ঞানহীন অবিবেচক নয়! বিষয়গুলো সুখ-নিদ্রায় মগ্ন বিশ্ব নের্তৃবর্গকে শুধু স্মরণ করিয়ে, এখনো তাঁরা মানব ব্যবস্থাপনায় নিষ্পত্তিযোগ্য শান্তির পথেই বিশ্বায়নে ভুমিকা রাখতে চায়!

বিশ্বের যত সমস্যাঃ বিস্ফোরন্মুখ বর্তমান দুনিয়ার বিপর্যয়গুলোর মূলে রয়েছে-

১. সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, রোহিঙ্গাসহ যুদ্ধ-বিগ্রহপূর্ণ অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয়গ্রস্থ ৫/৬ কোটি উদ্বাস্তু,
২. অস্বাভাবিক মানব চাপে পিষ্ট, অভিশপ্ত বাংলাদেশের ৫/৬ কোটি কর্মবঞ্চিত উদ্বৃত্ত মানুষ!
৩. আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সোমালিয়াসহ বিশ্বের খরা, দুর্যোগ ও যুদ্ধ প্রবণ অঞ্চল সমূহে চরম খাদ্যাভাব,
৪. বিশ্ব শক্তিমানদের ভারসাম্যহীন ক্ষমতা, বানিজ্য, ও ধর্ম্মীয় উম্মাদনায় সৃষ্ট দুঃসহ ¯œায়ু যুদ্ধ! যার কুফলে দেশে দেশে চলমান, অহেতুক দুর্বল নিপীড়ন!

সমস্যাবলির ৪র্থ টি জাগতিক দাম্ভিকতার ‘ফেরাউনি’ কালচার, যা মহান ¯্রষ্টার মর্জ্জি হলে যথাসময়েই থেমে যাবে, ইনশাল্লাহ। তবে ১-৩ সমস্যা গুলো, সহজ ব্যবস্থাপনায় সমাধানে হাত বাড়ালে কেমন হয়?

সমাধানের সম্ভাব্য পটভুমিঃ

* দুটি মেরু অঞ্চলের বাইরে, বিশ্বের ৫২ মিলিয়ন বর্গমাইল স্থলভাগের ২২ মিলিয়ন বর্গমাইলই রয়ে গেছে, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ও যুক্তরাষ্ট্রসহ মাত্র ৬ টি দেশের আয়ত্বে। বর্তমান বিশ্বের গড় মানব ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ১৪২ জন, আর ঐ ৬ দেশের গড় মানব ঘনত্ব মাত্র ৩৫ জন! পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মানব ঘনত্ব ‘২৯৫৬ জন!’ অস্বাভাবিক এ পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না!

* গড় ঘনত্ব ১৪২ জনকে ষ্ট্যান্ডার্ড ধরলে, এক অষ্ট্রেলিয়ারই উপকুলীয় বসতিপূর্ণ দেড়-দুই লক্ষ বর্গমাইল ব্যতিত, অভ্যন্তরস্থ অঞ্চলের প্রায় ২৮ লক্ষ বর্গমাইল এলাকাকেই বিরান বলা যায়! একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ লক্ষ, কানাডায় ৩৬ লক্ষ, রাশিয়ায় ৫৬ লক্ষ, ব্রাজিলে ১৮ লক্ষ, এবং আর্জেন্টিনায় ৮ লক্ষ বর্গমাইল মিলিয়ে ঐ ৬ দেশেই মোট পরিত্যক্ত ভুমির পরিমাণ দাড়ায় ১৬১ লক্ষ বর্গমাইল! বরফাচ্ছন্ন দুর্গম ২০-২২ লক্ষ বর্গমাইল অঞ্চলকে হিসেবে না ধরলেও, ৬ দেশের ‘গমনযোগ্য’ বিরান ভুমির পরিমাণই দাড়াবে প্রায় ১৪০ লক্ষ বর্গমাইল!

* একই ষ্ট্যান্ডার্ড গড়ে, ১৬.৫০ কোটি বাংলাদেশীর ভাগে থাকার কথা ১১ লক্ষ ৫৮ হাজার বর্গমাইল। অথচ আছে শুধুমাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল! এই অস্বাভাবিক ভুমি ঘাটতির শ্রেনীগত কোনো সংজ্ঞা আছে কি?

* অবশিষ্ট বিশ্বে বিদ্যমান বিরানভুমির পরিমাণ, ৬ দেশের বিরান অঞ্চলের অর্ধেকও যদি ধরা হয়, সেক্ষেত্রে পতিত ভুমির মোট পরিমাণ দাড়াবে প্রায় ২১০ লক্ষ বা ২১ মিলিয়ন বর্গমাইল! আসলে, পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের অর্ধেকের বেশী অংশই যে এখনো বিরান পড়ে আছে তা সুস্পষ্ট!

* লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, মাত্র ১০% ভাগ্যবান মোট স্থলভাগের ৪১% অংশ জুড়ে বাস করছে। অপরদিকে হতভাগ্য বাংলাদেশী ২.২৫% নরাধমদের ভাগে ২% দুরের কথা ১% ও নেই, আছে মাত্র ০.১০% বা এক- সহস্রাংশ ভুমি! পৃথিবীর অর্ধেকাংশ কথিত মালিকানায় পতিত ফেলে রেখে, ক্ষুদ্রতম একটি অংশে ১৬৫ মিলিয়ন হতভাগাকে ‘বাধ্যগত’ নিষ্পেষিত করা হচ্ছে! কোন দোষে?

* ৭৩৫ কোটি বিশ্ববাসীর ন্যুনতম স্পেস বঞ্চিত মাত্র ১০/১৫ কোটি হতভাগার মূল্যবান শ্রম শক্তি, অনাহার আর অর্ধাহারে নষ্ট হচ্ছে! অন্যদিকে অফুরন্ত পরিত্যক্ত ভুমিতে, বণ্য প্রাণীকুলের সেই একঘেয়ে নারকীয় জীবন চক্র ‘Built for the kill’ সহ নানা শিরোনামে, Discovery, Animal planet, National Geographic ইত্যাদি চ্যানেল সমূহের বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানাদির যোগান চলছেই!

* সুখ-সাগরে মগ্ন ভাগ্যবান সখা-সখিরা আজকাল সখ করে কথিত চঝজ পরিমাপের ছলে, গভীর অরন্যে ‘আদিম আদিম!’ (Nacked And Afraid!) খেলাও খেলছেন! খেলে যান, তবে একইভাবে ভুমি-কর্মহীন কৃষক আর উদ্বাস্তু গুলোকে ধরে নিয়ে, চাষ উপযোগী বিরান অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে, ‘ভয়ে ভয়ে কৃষি!’ (Agri And Afraid!) নামে, পরিবেশ বান্ধব ‘শষ্যদানা উৎপাদন’ এর স্বনির্ভর খেলাটা কি শুরু করা যায় না?

* মুষ্টিমেয় বিপর্যয়গ্রস্থের অভিশাপ আর আর্তনাদ, নিরন্তরভাবে অনন্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে! অথচ দুনিয়ার সকল দন্ড-মুন্ড অব্যবহৃত আগলে রাখা, বিশ্ব মালিক-নেতৃবর্গের ‘সুখ-নিদ্রা’ ভাঙ্গছেইনা!

উত্তরণের ভাবনা

জাগতিক সব সমস্যা সমাধানে, নানা পক্ষ-বিপক্ষের অন্তহীন বিতর্ক-বিশ্লেষণের কোনো শেষ নেই। কথিত দারিদ্র বিমোচনের নামে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করে দুনিয়াব্যাপী সেমিনার সিম্পোজিয়ামসহ নানামূখী এনজিও কার্যক্রম চলমান স্বত্বেও, পৃথিবীতে অনাহারে মৃত্যু আর যুদ্ধ-উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে! যেখানে যুগোপযোগী ‘ব্যবস্থাপনা’ সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগের লক্ষণই নেই! তাইতো মনে জাগে-

যদি এমন হতোঃ

১) কোনো প্রকার ‘দয়া-ভিক্ষা-ব্যয়’ বিহীন, কেবল সাহসী ব্যবস্থাপনায় বলবানদের অতি-ক্ষুধা’য় আরো যোগানসহ বিশ্ব চাহিদার ষোলকলা পূরণ করেই, সকল মানবিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হল!

২) বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, ও পরিবেশে কোনো প্রকার উত্তাপতো নয়ই, বরং স্বনির্ভর উন্নয়ন আর অর্জনের জোয়ারেই বিশ্বের যাবতীয় মানকিব অনাচার ভেসে গেল!

৩) সংশ্লিষ্ট বিশ্ব সংস্থার (FAO, WFP!) নজরদারীতে কর্মহীন বাংলাদেশীসহ সকল উদ্বাস্তুদের কর্মযজ্ঞে, ঘাটতি জনিত বিশ্ব-হানাহানি চিরতরে নির্মূল হলো!

** স্বগতোক্তিঃ ‘‘বিশ্ব নেতৃবর্গের জাগ্রত ঘুম ভাংলে, যদি নয় বাস্তবেই সম্ভব ইনশাল্লাহ্।”
(আদার ব্যাপারী-২ দ্রষ্টব্য।)

চলবে

এস এম আলী আকবর
লেখক ও প্রকৌশলী
ঢাকা, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments