অপেক্ষার প্রহরগুলো খুব দীর্ঘতর হয়। ঝাপসা চোখে একমনে বাগান করছে পল, পরম যত্নে হেসে উঠছে ফুলগুলো আঙ্গিনা জুড়ে।
প্রকৃতি যেন আগমনীর গান গাইছে আকাশে বাতাসে অস্থির প্রতীক্ষায়।
কয়েক যুগ একসাথে পাশাপাশি হাত ধরে পার করে, জীবন সায়াহ্নে এসে অনিশ্চয়তায় ছিটকে পড়েছে পল আর পামেলা দুই প্রান্তে। কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীতে
অতিক্রম করছে এক ক্রান্তিকাল আর সবার মতোই।
দুই-একদিনের মধ্যে ফেরত আসবে এই ভেবে মেয়ের কাছে গিয়েছিল পামেলা। এরই মাঝে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়াতে সীমানা গুলো অতিক্রম করতে পারায় আসে কঠিন প্রতিবন্ধকতা। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে একটা জরুরী অপারেশনও করতে হয় পামেলার। এসব শুনে দূর থেকে ছটফট করছিল পল। অধীর আগ্রহে দিন গুনছিল কবে আবার দেখা পাবে পামেলার। তখন কিছু জরুরী কাজ, বাসাটা খালি রেখে, অনেকগুলো পোষা পাখি, বিড়াল- এদের ফেলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি একসাথে। এখন যেন কষ্টে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। ফোনে খুব বেশি কথা বলা হয়ে ওঠেনা পামেলার দুর্বল শরীরে। আবেগেও যেন গলা ধরে আসে।

নিঃসঙ্গতায় আরো প্রগাঢ় ভাবে অনুভব করছিল ভালোবাসাকে। বিবাহিত জীবনে প্রায় ৫৮ বছর একসাথে কাটানোর সুবাদে, তরুণী থেকে চুলে সাদা সোনালী রঙের আভায় পামেলাকে আবিষ্কার করেছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে একই রকম ভালোবাসায়। বরং প্রতিদিন আরও তীব্রতর হয়েছে এই অন্যরকম অনুভূতি। সংসারের ডালপালা ছড়িয়ে, ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে নিজেদের কার্যক্ষেত্রে ডুবে গেছে ব্যস্ততায় যার যার ভুবনে।
আবারো শুধু তুমি আর আমি পথ চলা…
করোনায় বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না খুব জরুরী কাজ ছাড়া। প্রিয় সঙ্গিনী কাছে নেই! বন্ধু-বান্ধব কারো সাথে কথা বলতেও যেন মন লাগে না। ঘুম ভেঙে সকালের চায়ে পাশের চেয়ারটা বড় বেশি শূন্য দেখায়! মমতার পরশ বাড়িময়! পুরনো অ্যালবাম ওলট পালট করে কেটে যায় সারাবেলা। আর বাড়ির চারপাশে ফুলে ফুলে ভরিয়ে তুলছে বরণ উৎসবের তরে… সোনা ঝরা এক সন্ধ্যায় আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম ওই বাড়ির পাশ দিয়েই। নজর কাড়ে বাগানের সৌন্দর্য। অবাক হয়ে দেখি এক কোণে টলমল চোখে একা বসে খুব ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একজন মানুষ! বার্ধক্যে পৌঁছে গেল এখনও সুদর্শন। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাই, “ তুমি ভালো আছো? ”
খুব মিষ্টি হেসে, কেমন যেন এক আনন্দময় দৃষ্টিতে একটু মাথা নেড়ে বলল, অপেক্ষায় আছি… খুব ধীরে ধীরে আপন জনের মত বলতে শুরু করল অনেক কথা। এই মিষ্টি প্রেমের গল্প আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
অদেখায় যেন তাদের ভালবাসার তীব্র আকর্ষণ, আবেদন আরও বেড়ে চলেছে। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “মায়ার খেলা”।
সখী, সে গেল কোথায়,
তারে ডেকে নিয়ে আয়।
দাঁড়াব ঘিরে তারে তরুতলায়।
আজি এ মধুর সাঁঝে, কাননে ফুলের মাঝে,
হেসে হেসে বেড়াবে সে, দেখিব তায়।
আকাশের তারা ফুটেছে, দখিনে বাতাস ছুটেছে,
পাখিটি ঘুমঘোরে গেয়ে উঠেছে।
আয় লো আনন্দময়ী, মধুর বসন্ত লয়ে,
লাবণ্য ফুটাবি লো তরুতলায়!
সাকিনা আক্তার
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
