আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবসঃ সাহায্য নিতে দ্বিধা নয় । শিল্পী রহমান

  
    

রুমানার আজকাল কিছু ভালো লাগে না। পাশের বাসার ভাবির সাথে আগে অনেক কিছু শেয়ার করতো কিন্তু এখন উনি কেমন যেন হয়ে গেছেন। উনার কাছে কিছু বলতে ভালো লাগে না। রুমানার হাসবেন্ডও কিছু বোঝে না। অনেকবার ভেবেছে একজন থেরাপিস্টের সাথে কথা বলবে কিন্তু ভয় পায় অস্ট্রেলিয়ান থেরাপিস্ট ওর কোন কষ্টই বুঝবে না। নিজের ধর্ম, নিজের কালচারের কেউ না হলে ওর মানসিক অশান্তির কি করে বুঝবে ? কিন্তু বাঙালি কারো কাছে যেতেও সাহস হয় না, যদি থেরাপিস্ট কারো সাথে তার ব্যক্তিগত কথাগুলো বলে দেয় তাহলে ও কিভাবে এই সমাজে বসবাস করবে ! কিভাবে মুখ দেখাবে সবার সামনে?

এইসব নানা চিন্তায় রুমানা দিনে দিনে কেমন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন সাহায্য নিতে পারছে না। রান্না করতে ভালো লাগে না, অফিসের কাজে মন বসেনা বলে ভুল কাজ করে ফেলে, উইকেন্ডে কোন দাওয়াতে যাওয়ার কথা মনে হলে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে ওঠে। অস্থির লাগে, ছেলেমেয়েদের আহ্লাদ আব্দার শুনতে ইচ্ছে করেনা। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে খুব। আগে রুমানা কখনোই এমন ছিল না। খুব হাশিখুসি উচ্ছল রুমানা কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে।

হাসানের বাসায় ফিরতে ভালো লাগে না। বাসায় ফিরলেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। হাসানের ভুল ধরবার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। এটা করেনি, সেটা বোঝে না, আলসে, ঘরের কোন কাজ করে না ইত্যাদি ইত্যাদি। হাসান সাহায্য করতে চায় এমিলিকে কিন্তু এমিলি ওর কোন কিছুই পছন্দ করে না। হাসানের মনে হয় ওকে দেখলেই বোধহয় এমিলির এলার্জি হয় আজকাল। অফিসে যতই পারদর্শী হোক না কেন বাসায় নিজেকে একটা অপদার্থ মনে হয়। বন্ধুদের কাছে দুয়েকবার বলতে চেয়েও খুব একটা কাজ হয়নি। কেউ কিছু শোনার আগেই ওকে অন্য কথা বলতে শুরু করে, যেন ওর কষ্টের কোন মূল্যই নেই ওদের কাছে। তাহলে কাকে বলবে ও এই হতাশার কথা? মাঝে মাঝে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেটাও করতে পারেনা। ওকে নাকি “ ম্যান আপ” হতে হবে। ছেলেদের কান্না কাটি করা মহাপাপ। থেরাপিস্টের কাছে যাবে? লোকে জানলে কি বলবে? সবাই জেনে গেলে একটা কেলেংকারি হবে। তাছাড়া এমিলি জানলে তো ওকে ছেড়েই চলে যাবে।

লোলিতার টিন এজ মেয়েটা কোন কথা শোনে না। মেয়েটাকে যেমন করে মানুষ করতে চেয়েছিল, মেয়েটা তার উল্টো হচ্ছে। কিছু ভালো লাগে না। ওর হাসবেন্ড সবকিছুর জন্য ওকেই দায়ী করে। একদিকে অবুঝ মেয়ে অন্য দিকে অবুঝ হাসবেন্ড। লোলিতা দুজনের মাঝখানে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। ওর কথাটা কেউ ভাবছে না, সবকিছু ওকেই সামাল দিতে হয়, মনে হয় মাথাটা কখন ফেটে যাবে। নিতে পারছে না আর লোলিতা। কার সাথে নিজের মেয়ে হাসবেন্ডের কথা বলবে? কে বুঝবে? কেউ তার মেয়ে বা হাসবেন্ডকে খারাপ ভাবুক সেটাও চায় না লোলিতা। কেউ শুধু ওর কথাগুলো শুনলেও মনে হয় বুকটা হাল্কা হবে। কিন্তু কে ? থেরাপিস্টের কাছে যাবে? লোকে জানলে কি বলবে? সবাই জেনে গেলে একটা কেলেংকারি হবে ।

এখানে ২টা বিষয়, একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টকে ট্রেইনিং দেবার – প্রথম শর্তই হলো , ১০০% গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে
দ্বিতীয় শর্ত হল, ১০০% ননজাজমেন্টাল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা শোনা হবে।
বাকিগুলো এখানে না বললেও চলবে, শুধু মনে রাখবেন রুমানা, লোলিতা এবং হাসানকে তো জাজ করা হবেই না, রুমানা যদি তার বান্ধবী রুবানা সম্মন্ধ্যে কোন অভিযোগ করে, বা লোলিতা তার মেয়ে বা হাসবেন্ডকে নিয়ে অভিযোগ করে, হাসান তার স্ত্রী এমিলিকে নিয়ে হতাশার কথা বলে, তাহলে একজন থেরাপিস্ট সেই রুবানা, এমিলি, মেয়ে বা হাসবেন্ডকেও জাজ করবে না। এই ক্ষেত্রে সবাই নিরাপদে থাকবে। তাই নিশ্চিন্তমনে যেকোনো মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টগুলো শেয়ার করা যেতে পারে।

গোপনীয়তা রক্ষা না করবার ভয়ে এবং ননজাজমেন্টাল দৃষ্টিভঙ্গি না থাকতে পারে সেই ভয়ে যদি কেউ কাউসেলিং বা থেরাপিস্টের কাছে না যেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে খুব জোর গলায় বলবো, যান। আপনারা নিশ্চিন্তে সাহায্য নিতে পারেন। থেরাপিতে গেলে আপনার উপকার ছাড়া অপকার হবে না। কয়েকটি সেশন নিয়ে দেখুন কেমন লাগে। একজন কাউন্সেলরের সাথে ক্লিক না করলে আরেকজনের কাছে যাবেন ঠিক যেমন করে ডাক্তারের কাছে যাবার সময় করেন, তেমন।
মানসিকভাবে সুস্থ থাকবার সম্পূর্ণ অধিকার আপনার আছে, অন্যান্য সব দায়িত্বের মধ্যে নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব সবার ওপরে। সারাবিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কেউ না কেউ আত্মহত্যা করে প্রাণ হারায়। আত্মহত্যা করার জন্য দায়ী মূলত মানসিক স্বাস্থ্য, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সে কখনোই আত্মহত্যার দিকে প্রবাহিত হবে না ।আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য আত্মহত্যার সময় একজন মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগে। সাধারণত, সেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলেই যথাযথ চিকিৎসা করা হয় না । মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের ফলে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব।

সারাবিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১০ই অক্টোবর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয় । একজন মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটা তার শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকা দরকার ঠিক ততটাই তার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা দরকার ।
বিশ্ব ফেডারেল মানসিক স্বাস্থ্যের প্রেসিডেন্ট ডঃ ইংগ্রিড ড্যানিয়েলস বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২১ এর শ্লোগান ঘোষণা করেছেন ‘একটি অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। অর্থাৎ Mental Health in an Unequal World,
বিশ্ব ফেডারেল মানসিক স্বাস্থ্য সদস্য, স্টেকহোল্ডার এবং সমর্থকদের সহ ভোট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল এই ভাবনা, কারণ পৃথিবীতে যারা ধনী তারা ধনী হয়ে উঠছে, এবং দারিদ্র্য বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক বেশি।

২০২০ সালে জাতি, জাতিগত, যৌন অভিমুখ, লিঙ্গ পরিচয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার সাথে বসবাসকারী মানুষ সহ, অনেক দেশে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবের কারণে যে অসমতা দেখা যায় সেটাই তুলে ধরবার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বছরের শ্লোগানে। কারন এই ধরনের অসমতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর অনেক প্রভাব ফেলে।
আজ আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস, সবাই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন, ভালো থাকবেন, প্রয়োজন হলে সাহায্য নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবেন না। শুভকামনা।

শিল্পী রহমান
গল্পকার, কবি, সংস্কৃতিকর্মী, কাউন্সেলর ও গবেষক। স্থায়ী নিবাস ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়ায়। 
প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ: ধর্ষণ ধর্ষক ও প্রতিকার; উৎকণ্ঠাহীন নতুন জীবন; মনের ওজন; সম্ভাবনার প্রতিচ্ছায়ায়; যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের গল্প; পথের অপেক্ষা; পাহাড় হবো ইত্যাদি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments