একটা সময় পর, পড়ালেখা ছাড়া অনেক কিছুই করতে চেয়েছি।
একদম ছোটবেলায় অল্প কিছু দিন নাচ/গান, করেছি আবৃত্তির চেষ্টা এবং আরো যত শিল্পকলা আছে সব কিছুই টানতো অল্প বিস্তর আমায় অদ্ভুতভাবে।
এরপর কিছু দিন শুধুই পড়ালেখা, টানা ৩/৪ বছর।
লম্বা বিরতি নিয়ে আবার ফিরলাম অভিনয় নিয়ে কলেজ জীবনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, নুতন করে শুরু করলাম বিতর্ক, কোরাস গান, আবৃত্তি, নাটক এবং একদিন মনে হলো সব বাদ এবার সাংবাদিক হবো বা লেখালিখি শুরু করবো।
তখন ”ভোরের কাগজের” রমরমা অবস্থা। সকল আধুনিক অগ্রসর পাঠকের কাগজ। রোকেয়া হলে রুমে রুমে আমরা এই পত্রিকাটাই পড়ি। ভোরের কাগজের বিনোদনমূলক সাপ্তাহিক আয়োজন ছিল ”মেলা”। বেশ ভালো লাগা নিয়ে পড়তাম, পড়তে পড়তেই একদিন মনে হলো আমি নিজে কেন লিখিনা।
ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়, মধুতে তাই নিয়মিত যাতায়াত, সেই সুবাদে সাংবাদিক তরুণ সরকারের সাথে পরিচয়। বিশিষ্ট ভদ্রলোক, ভোরের কাগজে কাজ করেন, বললাম আমার ইচ্ছের কথা। তরুণ দা নিয়ে গেলেন ভোরের কাগজ অফিসে একদিন।
জীবনের প্রথম এসাইনমেন্ট দিলেন অন্যপক্ষ সম্পাদক সুমনা শারমীন, সেটাতেই ফেল মারলাম। ঠিক সময়ে না হলো শেষ, না নূতন কিছু। অতীব শরমিন্দা হয়ে সুমনা আপাকে সেটা জানাতে গেলাম ভোরের কাগজের অফিসে, সেদিন আপার সাথেই দেখা হলোনা।
দেখা হলো লেখক আনিসুল হকের সাথে উনি আমাকে পাঠালেন মেলা সম্পাদক ”সঞ্জীব চৌধুরীর” কাছে। প্রথম দিনই দেখলাম তাঁর সব কাজের পাশাপাশি মূল যে কাজ সেটা হচ্ছে পুরো অফিসকে ‘হাস্য রসে’ ভরপুর রাখা।
সঞ্জীবদার টেবিলের কাছে ধারেই সেই সময়ের সব তারকা বিভাগীয় সম্পাদক, রিপোর্টার কবির বকুল, দন্তস্য রওশন, সুমন পাটোয়ারী, নবনীতা, তাজিন আহমেদ, জয়া আহসান/কান্তা আহসানও আসতো মাঝে মাঝেই বোধ হয়, নাদিরা কিরণ আপু, শামিম শাহেদ সহ আরো অনেক জনপ্রিয় মুখ। এমন সবাইকে দেখেছি একটু কাছে থেকে বা দূরে বসে সেই ভোরের কাগজ অফিসেই। আমি ভীষণ জড়সড় হয়ে শুনতাম তাদের রঙ্গ তামাশার বিষয়াদি, আহা কী প্রাণময় এক মানুষ সঞ্জীব দা।
সঞ্জীবদার গান, রাজনৈতিক আদর্শ এই বিষয়ে জানা ছিল। ৯০ এ টিএসসিতে বসে গান করে প্রতিবাদ জানানো সঞ্জীবদার গল্প তখন সবার মুখে মুখে। আমিও অনেকবার শুনেছি টুকরো কিছু গল্প মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এবং এর কিছু সময় পরই আমাদের হাতে প্রথম আসে ‘দলছুটের’ ক্যাসেট। ‘সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে’ শুনে আমি ও আমার রুমমেটগণ প্রায় আউলা হয়ে গেয়েছিলাম।
সঞ্জীবদাকে সেই কথা জানালামও একদিন তাঁর অফিসে, উনি হাসেন, অমায়িক হাসি, সরল এবং বিনয়ী হাসি।
ও আচ্ছা আমার শুরুর গল্পটা বলি আবার। প্রথম দিনই আমাকে বললেন আমি যা নিয়ে ইচ্ছে যেন লিখে নিয়ে আসি। সেই আমার লেখালিখির শুরু পত্রিকাতে। খুব সাধারণ লেখা, সাধারণ ভাবে করা কারো ইন্টারভিউ শুধু সঞ্জীব দা’র হাতে পড়ে যে কি অসাধারণ হয়ে উঠতো। আমি আজকাল ফেসবুক এবং অন্য কিছু অনলাইন মিডিয়াতে টুকিটাকি যাই লিখি, অনেকের অনেক বেশি প্রশংসা পেয়েছি, পাচ্ছি।
তবে আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমার লেখা যদি কারো এতটুকু ভালো লাগে তার অনেকখানি যিনি আমাকে শিখিয়ে গেছেন তিনি ”সঞ্জীব দা”।
যদিও লেখালিখি ধরে রাখিনি, ২০০০ থেকে ২০০৫ আবার সব বাদ, ২০০৬ এর পর বোধ হয় প্রথম আলো অফিসে যাব যাব করতে করতেই একদিন ‘যায় যায় দিন’ অফিসে চলে যাই এক বন্ধুর আমন্ত্রণে। পরিচিত অনেকগুলো মানুষের সাথে দেখা হয় আবার। সেখানে নুরুল ইসলাম ছোটন উনি আমাকে যার সাথে দেখা করতে পাঠালেন লেখালিখি আবার শুরু করার জন্যে, তার রুমে ঢুকে আবার বিস্ময়ের পালা। জানা ছিলোনা আমার কে আছেন সেই দায়িত্বে।
আবার পেলাম সঞ্জীবদাকে, আমাকে অল্প একটু সময়েই অনেক উত্সাহিত করলেন, নব উদ্যমে শুরু করতে বললেন, তাঁকে কথাও দিলাম, লিখবো!
কিন্তু তখন ৯টা ৬টার কাজটাই জীবনের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ালো, আর হলোনা আমাকে দিয়ে। ২০০৯, দেশ ছাড়ার বছর খানিক আগে সঞ্জীব দা চলে গেলেন না ফেরার দেশে, ‘ আর তো হলনা দেখা’। আজও কিছু লিখতে গেলেই কেন যেন সঞ্জীবদাকে আমার খুব মনে পড়ে, খুব।
কোনদিন বলা হয়নি, আজ বলি লেখালিখিতে আমি আপনাকেই ”গুরু” মেনেছিলাম দাদা। ভালো থাকবেন যেখানেই আছেন! শান্তির ঘুম হোক আপনার।
আমি জানি পোড়া এই সময়ে আপনি থাকলে অনেক কিছু নিয়ে বলতেন, লিখতেন, গান বাঁধতেন… অনেকেই আপনাকে খুব বেশী মিস করে, খুব আমিও তাদের একজন।
ভালোবাসা, শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নাদেরা সুলতানা নদী
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়া
১৯ নভেম্বর ২০২০।