
‘মরিতে চাহিনা আমি এ সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এ দুটো লাইনে এই অনিন্দ্য সুন্দর ভূবনে কবির বেঁচে থাকার তীব্র আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে। স্রষ্টার এমন অপার দান এ দুনিয়ার মায়া ছেড়ে কে-ই- বা হারিয়ে যেতে চায়। বেঁচে থাকা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই তো বাঁচার জন্য মানুষ কী প্রাণান্তকর চেষ্টাটাই না করে যাচ্ছেন। তবে করোনায় এই চেষ্টার অন্তর্গত আঁকুতিটা একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বা যিনি শারীরিক সুস্থতা চায় না। কারণ, শরীরী জীবের পক্ষে শারীরিক সুস্থতা অপেক্ষা সুখকর বিষয় আর নেই। আর এই চরম সত্যটা আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি করোনা মহামারীর রোষানলে পড়ে। কারণ, করোনা আমাদের স্বাভাবিক সুস্থতা থাকার বিষয়ে বিরাট একটা অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এক দুর্বিষহ অস্বস্তিকর অবস্থার ভেতর দিয়ে সময় পার করতে হচ্ছে আমাদের। যার নাম করোনা মহামারী আতঙ্ক।
একটা মাত্রই তো জীবন আমাদের! তাই নিজে বেঁচে থাকাটা হতে হবে আমাদের প্রথম চাওয়া। তবে দেশকে করোনামুক্ত রাখাটাও আমাদেরই দায়িত্ব। আর এই দুর্নিবার লক্ষ্যে আমাদের দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। তাই স্বাস্থ্যবিধি পালনে অধিকতর মনোযোগী হওয়াটা অত্যাবশ্যক। কারণ, এই মুহূর্তে প্রতিরোধই নিজেকে করোনামুক্ত রাখার একমাত্র উপায়।
আমরা জানি, জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য হচ্ছে খাবার। তাই দমচর্চার পরে এবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাবারে সাবধানতা
সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করছি। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য যে, আমি যা লিখছি মূলত এগুলো সাধারণত অনেকেরই জানা কথা। আসলে আমরা অনেকেই অনেক কিছুই জানি তবে মেনে চলি না। আর আমি লিখছি এই জানা কথাগুলোই আবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ব্যাটারি রিচার্জিংয়ের মতো। এতে কথাগুলো কারো কারো মনে হয় তো দাগ কেটেও যেতে পারে। তাছাড়া তথ্য বা কথাও একটা শক্তি। তাই তথ্য বা কথা দিয়েও মানুষকে প্রভাবিত করা যায়। এতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় গুরুত্বের প্রতি গুরুত্ব বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিসের একটা চমকপ্রদ কথা এ মুহূর্তে সবার ক্ষেত্রেই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “তোমার খাবারই তোমার ওষুধ, আর তেমনি তোমার ওষুধই তোমার খাবার।” তার সাথে প্রাচীন প্রবাদ যোগ করছি, “জিহ্বা যার সংযত স্বাস্থ্য তার সুসংহত।” দুটোরই গূঢ়ার্থ হচ্ছে, শারীরিক সুস্থতার আসল কেন্দ্রবিন্দু হলো আহারে সাবধানতা। এই জন্যেই হেকিম লোকমান বলেছিলেন, “নামাজে মন সামলাও, মজলিসে বাক্য সামলাও, ক্রোধে হাত সামলাও আর আহারে পেট সামলাও।”

মূলত সুস্বাস্থ্যের প্রথম ভিত্তি হচ্ছে সঠিক খাদ্যাভ্যাস। আসলে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অভ্যাসটাই মূলত আমাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। কথায় আছে, “খাওয়ার জন্যে বেঁচে থাকা নয়, বেঁচে থাকার জন্য খাবার গ্রহণ করতে হবে।”
তাহলে আমরা কী খাব? হ্যাঁ, তা নির্ভর করে মূলত বয়স, শারীরিক সুস্থতা, রুচি এবং নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস সর্বোপরি পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। পরিবেশ পরিস্থিতি বলছি এই কারণে যে, বিশেষজ্ঞগণ করোনায় খাবারে বিশেষ কিছু সাবধানতা এবং খাদ্য তালিকায় বাড়তি কিছু সংযোজন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
আর কতটুকু খাবেন এর উত্তরে প্রাচীন প্রবাদঃ “উনো ভাতে দুনো বল অতি ভাতে রসাতল।” অর্থাৎ সব সময় পরিমিত খাওয়া উচিত। মুরুব্বিরা বলতেন, কিছুটা খিদে রেখে খাওয়া শেষ করা ভালো। বুঝাতে চাচ্ছি, পেটের চারকোনা পূর্ণ করে খাওয়া ঠিক নয়। এ বিষয়ে আমাদের নবীজী ( সঃ) বলেছেন, পাকস্থলীর এক তৃতীয়াংশ খাবার, এক তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা পূর্ণ করুন আর বাকী এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখুন। খাবার বিষয়ে ডায়েট বিশেষজ্ঞ ডা.পল রোয়েনের পরামর্শ হলো, “সকাল বেলা ভরপেটে নাস্তা করুন, দুপুরে তৃপ্তির সাথে খান আর রাতে হালকা খাবার গ্রহণ করুন।”
কারণ, ডায়েট বিশেষজ্ঞ ডা.পল রোয়েন ৩০ বছর গবেষণার পর বলেছেন,”রাতে ভূরিভোজ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং হঠাৎ মৃত্যুর জন্যে এক আদর্শ ব্যবস্থা।” আগে বলেছি, “আপনার স্বাস্থ্য আপনারই হাতে” এ কথাটি এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা আপনি কী কী শারীরিক সমস্যা বা জটিলতায় কষ্ট পাচ্ছেন? আর কী কী রোগে ভূগছেন? এটা আপনার শরীর, আপনিই ভালো জানার কথা। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অবশ্যই আপনাকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকবেন। তাই কী খাবেন? কোন খাবারে আপনার বাছ-বিচার বা বিধি-নিষেধ আছে। এটাতো কেবল আপনারই মনে রাখার বিষয়। তাই কী খাবেন তা যেমন আপনি ঠিক করবেন। ঠিক তেমনি কখন খাবেন, তাও আপনাকেই নির্দিষ্ট করতে হবে। আর কতটুকু খাবেন তাও আপনাকেই জানতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একই পরিমাণ খাবার সকালে খেলে ওজন কমবে। সে পরিমাণ খাবারই রাতে খেলে ওজন বাড়বে।এটারও কারণ আছে, অর্থাৎ খাওয়ার পঞ্চম থেকে সপ্তম ঘন্টায় হজম প্রক্রিয়া তুঙ্গে পৌঁছায়। রাতে ভূরিভোজ করলে খাবার হজম হয়ে উৎপাদিত শক্তি রক্তে এসে পৌঁছার সময় আমরা থাকি ঘুমিয়ে। তখন কায়িক শ্রম না থাকায় সে শক্তি খরচ না হয়ে তা চর্বিতে রূপান্তরিত হয়ে জমে থাকে শরীরে। সুতরাং এটা জানা থাকাটা অতীব জরুরী।
আরো একটি কথা। ৩৫ বছরের পর আমাদের সতর্ক থাকা উচিত যে, কোন ধরনের খাবার আমাদের সহ্য হবে না। তাই তা বুঝে সে সব ধরনের খাদ্য আমাদের এড়িয়ে চলা দরকার। মোট কথা, যার যেটা সহ্য না হয় সেটা খাওয়া থেকে তার বিরত থাকাই উত্তম। তবে করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের আহারে সতর্কতাও আরো জরুরী। অতিরিক্ত মশলা, তেল, ঝাল ও ভাজাপোড়া বর্জন করা উচিত। আসলে, প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মাছ, গোস্ত ও ডিম রান্না করে পুরো সিদ্ধ করে খাওয়া উচিত। গবেষকরা বলেছেন, করোনাকালীন সময় কাঁচা সবজী বা সালাদ বা ফল খেতে হলে ভালো করে ধুয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে খাওয়া ভাল। পানি পান করার ক্ষেত্রেও চিকিৎসক বা গবেষকদের পরামর্শ গুরুত্বের সাথে অনুসরণ করা উচিত। করোনায় কুসুমকুসুম গরম পানি পান করা ভালো। খাওয়ার পর লবন-গরম পানির গার্গল করা খুবই উপকারী। আধা ঘন্টা পরপর পানি পান করা করোনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন সি এবং জিংক সমৃদ্ধ খাবার করোনা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী। মূলত শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এ ধরনের খাবারের প্রতি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। লবঙ্গ, তেজপাতা এলাচী দিয়ে গরম চা পানের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ। তবে, আমরা অনেকেই কোন না রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত। সেক্ষেত্রে বলব, আপনার রোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কারো প্ররোচনায় কোন খাবার বা ওষুধ খাবেন না বা ব্যবহার করবেন না। হিপোক্রেটিসের সে বাণী প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করবেন। “তোমার খাবারই তোমার ওষুধ আর তেমনি তোমার ওষুধই তোমার খাবার।” খাবার এবং ওষুধ এ দুটোতেই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত বলে আমি মনে করছি। করোনাকালীন কেন, খাবারের ব্যাপারে বিশ্বের সচেতন মানুষেরা এখন প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরা এখন টিনজাত, প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাবারে আগ্রহ কম। পক্ষান্তরে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে চিকিৎসকরা চিনি না খাওয়ার বিষয়েও সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, সব ধরনের বিপাকজনিত রোগ যেমন, উচ্চ রক্তচাপ,কোলেস্টেরলের আধিক্য, ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস, মেদস্থূলতা ও বার্ধক্য প্রক্রিয়া তরান্বিত হওয়ার সাথে চিনির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ সব কারণেই বিশ্বজুড়ে এখন চিনির আরেক নাম “হোয়াইট পয়জন।” তাছাড়া চিনি এলকোহলের মতোই বিপদজনক আর আসক্তি সৃষ্টি করে। চিনি যত খাওয়া হয়, তত এটি মস্তিষ্ককে উদীপ্ত করে আরো খাওয়ার জন্য। যা মস্তিষ্কে ক্ষুধার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয় এবং আমরা অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠি।
করোনায় যেহেতু উল্লেখিত রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঝু্ঁকিপূর্ণ তাই চিনি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করার ওপর গুরত্ব আরোপ করেছেন। তাই রসনাকে তুষ্ট করতে কিংবা স্বাদ ভোগে লোভাতুর হয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে কষ্ট করার চেয়ে, না খেয়ে সুস্থ থাকা ঢের আরামদায়ক। সেক্ষেত্রে বলব, জিহ্বাকে সংযত করুন। অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকবেন। আরামদায়ক মুহূর্ত উপভোগ করতে পারবেন। আরো একটি কথা। খাবার সুস্বাদু হয় চিনি, তেল চর্বি ও লবনের কারণে। যা সুস্বাদু তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। স্বাস্থ্যটা আপনার। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ক্ষতিকর খাবার পরিহার করাটার সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। সুতরাং করোনায় শুধু নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবারে সাবধানতা সব সময়ই গুরুত্ববহ তো বটেই এবং তা অবশ্যই পালনীয়।
অপ্রিয় হলেও সত্য এই যে, রসনাবিলাসী ভোজনপটু বাঙালী মাত্রই আহারে সাবধানতা পালনে মানসিকভাবে দুর্বল। বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক ডায়াবেটিস রোগীকে বলতে শুনেছি, দূর যা হবার হবেই। প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াব। তবুও তৃপ্তি মিটিয়ে খাব। ডায়াবেটিসে খাবার নিয়ন্ত্রণই মূখ্য এটা রোগীও জানে। কিন্তু যখন টেবিলে উপাদেয় খাবার দেখে তখন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেন না অনেকেই। কেননা, মানুষ নিজের অবদমিত বাসনাকে ততোক্ষণই ধরে রাখতে পারে, যতক্ষণ না সেই বাসনার মূর্তিমান রূপ তার চোখের সামনে এসে না দাঁড়ায়। কারণ, মানুষ হচ্ছে সে জীব, যে অবস্থা বিপাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, আবার অবস্থা বিপাকে অক্ষম। তাই বলছি, এখন থেকে আর ভোজন রসিক হওয়া যাবে না। কেবল খিদে লাগলেই খাবেন। তবে পরিমিত এবং নির্দিষ্ট ছেদে। আসুন, এবার না হয় জীবনরসিক হই। জীবনকে ভালোবাসি। জীবনের চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। তাই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করে দীর্ঘজীবন লাভ করি। উপভোগ করি জীবনের প্রতিটি অসম্ভব অলোকসামান্য মুহূর্তগুলোকে।
দয়স্তয়ভস্কি বলেছেন, “মানুষের কাছে তার জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। এই জীবন সে একবারেই পায়।” আর সে জন্য
সক্রেটিসের সেই বাণী, “তোমার খাবারই তোমার ওষুধ, আর তেমন তোমার ওষুধই তোমার খাবার।” এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হই। শেষমেশ বলছি, খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে, “সকালে রাজার মতো, দুপুরে রাজপুত্রের মতো এবং রাতে ভিখারীর মতো খাবার গ্রহণ করুন। প্রবাদ আছে, “সবচেয়ে বড় ডাক্তার হচ্ছে “কম খাওয়া।” আসুন আশাবাদী হই। আর সুস্থতা নামক স্রষ্টার যে সেরা নেয়ামত তা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করি এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্রষ্টার প্রতি শুকরিয়া আদায় করি।
পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ।