আফ্রোদিতির শহরে (পর্ব-১) – শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    

পুরো দুমাস ইউরোপ ঘুরে এলেন লেখক 

 কলামিস্ট শাখাওয়াৎ নয়ন।

প্রশান্তিকার ঈদ আয়োজনে আজ প্রকাশিত হলো তাঁর 

প্রথম ভ্রমণ কাহিনী বোধিভ্রমণ।

এবারের পর্ব আফ্রোদিতির শহরে।

 

 

 

রাত এগারোটা। টেম্পল অফ জিউস এর সামনের রাস্তা, এথেন্স।রাস্তার পাশেই এক অসম্ভব রূপবতী দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে খুব দ্রুত কিছু একটা লিখছে; মুখশ্রী মাশাল্লাহ! স্বর্গের সুন্দরীতম দেবী আফ্রোদিতির সাক্ষাৎ যমজ বোন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম,

: এক্সকিউজ মি…এক্রোপলিস কোন দিকে, বলতে পারো?

মেয়েটি মোবাইল থেকে মুখ তুলে, কেমন করে জানি আমার দিকে তাকালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,

: ডু ইউ ওয়ানা ফাক মি?

ধরণী দ্বিধা হও।এ আমি কী শুনলাম! যা শুনলাম, তা কি ঠিক শুনলাম? আমার চোখের পাওয়ার টেস্ট করা আছে, অপটিক্যালটেস্ট রিপোর্ট ৬/৬। যার মানে সর্বোচ্চ ভালো। কিন্তু হিয়ারিং টেস্ট তো কখনো করানো হয়নি কানের পাওয়ার সম্পর্কে জানি না। তবে আমি গভীরঘুমের মধ্যেও কথা শুনতে পাই।এমন কি পাশের রুমে কেউ যদি ফিসফিস করেও কথা বলে, তাও শুনতে পাই।

ক্যামন পরিষ্কার শুনতে পাই, তা শুনুন।আমাদের গ্রাম দেশে বিয়ের ঠিক পরপর বরের সাথে কনের নতুন জীবন কেমন কাটছে…তা নিয়ে তাঁর মা-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে কৌতুহলের কোনো শেষ থাকে না।নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, রাস্ট্রপতিদের অভিষেকেরপরপর যেমন ‘মিট দ্যা প্রেস’ নামক প্রেস কনফ্রারেন্সে গিয়ে সাংবাদিকদের কৌতুহল মেটাতে হয়; তেমনি আমাদের মাদারীপুরে বিয়ের পর ‘ফিরা নাইওর’ বলে একটা ব্যাপরআছে।এই ফিরা নাইওর হচ্ছে মূলত বিয়ের আড়াই দিন পর নতুন বউকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িনিয়ে যাওয়ার নাম। আড়াই দিনের মাথায় বাপেরবাড়ি যাওয়ার পর শুরু হয় মেয়েটির উপর প্রশ্নবান।মুরুব্বীরা এসে বিভিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং ইনিয়ে বিনিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করেন।মুরুব্বী ধরনের লোকেরা প্রশ্ন করেন এভাবে,

: জামাই ক্যামন?

: ভালো

: শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্যামন

: তোরে খেতে টেতে দেয় তো

: দেয়।

এসব প্রশ্ন হচ্ছে আগডুম-বাগডুম…আসল প্রশ্নের ভুমিকা মাত্র…একটু পরই একটু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,

: জামাই আদর-ঠাদর করে?

মেয়েটি (নতুন বউ) খুব লজ্জা পায়। কিছুই বলে না; শুধু লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।কিন্তু কিছু বিবাহিত বান্ধবী এবং ভাবী থাকে, তারা অভিজ্ঞ, ডায়রেক্ট একশনে বিশ্বাসী।সদ্য বিবাহিত মেয়েটিকে আলাদা একটা রুমে নিয়ে গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করে।মেয়েটি প্রথমে কিছুই বলতে চায়না; কিন্তু এই মধুর আপদ ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তারাও সেই রকম।কোনো কিছুই গোপন রাখতে দিবে না।প্রথমে কি করেছে? পরে কি করেছে? কিভাবে করেছে? কতক্ষণ করেছে? তুই কি করেছিস? সে কি করেছে?কেমন লেগেছে? এমন কি মাপ-ঝোপ পর্যন্ত জেনে নিতে চেষ্টাকরে…আশে-পাশের রুম থেকে আপনি প্রথমে কিছু সময় চাপাহাসি, তারপর খাটের উপর ধুপধাপ গড়াগড়ি এবং অট্টহাসির শব্দ শুনতে পাবেন। ঘটনা যা বোঝার সবাই এ থেকেই বুঝে নেয়।ব্যবস্থাটা খারাপ না, কি বলেন? এক পর্যায়ে কোনো এক মুরুব্বী একটি উচু স্বরে হাক দিয়েবলেন

: তোরা কি খাটটা ভাইঙ্গা ফালাবি নাকি রে?

ধুপধাপ গড়াগড়ি, অট্টহাসির শব্দ হঠাৎ চাপাহাসিতে ফিরে যায়।অদ্ভুতভাবে আমি তাদের সেইসব (বড়দের গল্প) কথা পরিস্কার শুনতে পেতাম এবং মনে করতাম, আমার মতো সবাই শুনতে পায়।

কিন্তু বিয়ের পরে যে মেয়েটি বিদেশে চলে যায়, তাঁর ক্ষেত্রে কি হয়? ফোনে কথা-বার্তা হয়।বিয়ের পরপরই আমরা সিডনিতে চলে আসি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। নীলাবতীর ইন্টারভিউ ফোনেই হয়েছে।দিনের বেলায় নানা ব্যস্ততা এবং বাংলাদেশের সাথে সিডনির সময়ের ব্যবধানথাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফোনগুলো আসতো রাতে।আমি যাতে তাদের কথোপকথনগুলো শুনতে না পাই, তার জন্য বেচারি শীতের রাতে বারান্দায় গিয়ে কথা বলতো। বিশেষ করে রাত দশ-এগারোটার পর আমি যখন ঘুমিয়ে পড়তাম।অনেক দিন পর একদিন কোনো এক প্রসঙ্গেনীলাবতীকে বললাম,

: তুমি অমুককে এই কথাটা …বলেছিলে…এটা ঠিক হয়নি…এসব বলতে হয় না…

: তুমি জানলে কিভাবে?

: আমি জানি।

:কিভাবে জানো? তুমি তো তখন গভীর ঘুমে…আমি বারান্দায় গিয়ে কথা বলেছি…আর আমাদের শোবার ঘর তো বারান্দা থেকে বেশ দূরে…

: আমি ঘুমের মধ্যেও শুনতে পাই…আশে-পাশের রুমের ফিসফিস করে বলা কথাও শুনতে পাই…

নীলাবতী তৎক্ষণাৎ আমার কয়েকটি পরীক্ষা নিল। আমি উত্তীর্ণ হলাম।সে শুধু চমকে গেল না, রীতিমত ভয়ও পেল। তাঁর চোখে-মুখে খুব স্পষ্টভাবে একটি কথা ভেসে উঠেছে, ‘এ আমি কার সাথে বসবাস করছি!? এ কি মানুষ নাকি অন্য কিছু?!’

যাই হোক, এথেন্সে ফিরে যাই।এতদিন পরেও আমার কানের ক্ষমতা একই রকম আছে কি না? তা পরীক্ষা করা দরকার।কারন পৃথিবীর কোনো মেয়েই সম্পুর্ন অপরিচিত একজন পুরুষকে এটা বলতে পারে না।আর এথেন্সের এই হেলেনিক সুন্দরী মেয়েটি তো কোনোভাবেই না।যার গায়ের রং ভূমধ্যসাগরীয়, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত (তিন ইঞ্চি হিলসহ); গড়ন ৩৬-২৬-৩৬।দেখেই মনে হয়- এই মেয়ে এখানে কি করে, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় যায় না কেন? না থাক…ওখানে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প আছে… তাই একটু দম নিয়ে বললাম,

: সরি, আমি এক্রোপলিস যেতে চাই…

: তোমার কথা শুনেছি তো…কিন্তু তুমি কি আমার সাথে বিছানায় যেতে চাও?

: না, আমি এক্রোপলিস যেতে চাই…

: ও ম্যান…ফাকিং ইন্ডিয়ান…যা বলার সরাসরি বলো…লজ্জা পাচ্ছো কেন?

: আমি সরাসরিই বলছি…

:ও মাই গড…প্রত্যেক দিন তোমার মতো এমন কতজন আমাকে ‘এক্রোপলিস কোন দিকে’ এই প্রশ্নটিই করে…জানো? কিন্তু ফাইনালি তারা সবাই আমার সাথে শুতে চায়…

: আমি তাদের মতো না…

: শোনো! ওসব আমার ভালোই জানা আছে…পুরুষ মানুষ …আই হেইট ডাবল স্ট্যান্ডার্ড…I am a street hooker(ভ্রাম্যমাণ বিনোদিনী)…তোমার কাছে যদি আশি ইউরো থাকে…দেন লেটস গো উইথ মি… আদারওয়াইজ ফাক অফফফ…

ওরে মোর খোদা রে…কার পাল্লায় পড়ছি! দ্রুত শটকে পড়লাম। ‘মানির মান আল্লায়ই রাখছে…আমি বাংলাদেশি বুঝতে পারেনি, ইন্ডিয়ানদের কইষ্যা গালি দিছে’ ।এটা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে হোটেলে ফিরে গেলাম। সত্যি বলতে কি…পালালাম।

[চলবে]

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments