আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ -শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন

(এক)
আবরার এবং বুয়েটের ভিসিকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের কথা মনে পড়ল। তাঁর মাত্র দুটি পুত্র সন্তান ছিল। কয়েক বছর আগে তাঁর এক ছেলে আরেক ছেলেকে মেরে ফেলেছে। অবস্থা বুঝুন! আইনের প্রতি শ্রদ্ধায় হোক আর রাগ-দুঃখে-ক্ষোভে হোক, খুনি ছেলেটিকে তিনি পুলিশে দিলেন। সেই ছেলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ফলাফল এটিএম শামসুজ্জামানের এক ছেলে কবরে আরেক ছেলে কারাগারে। বুয়েটের ভিসি সাইফুল ইসলামকে এবার এটিএম শামসুজ্জামানের স্থলে বসিয়ে কল্পনা করুন। ভিক্টিম এবং খুনি উভয়ই তাঁর ছাত্র। তিনি উভয়েরই অভিভাবক। তাঁর এক ছাত্র শুয়ে আছে কবরে, ষোলজন কারাগারে, তিনজন পলাতক। মোটকথা পরিবার, সমাজ, বুয়েট, রাষ্ট্র, দেশ, জাতি বিশজন মেধাবী সন্তান হারাল। সারা দেশ জুড়ে কী ভয়ংকর ঘৃনা, ক্ষোভ! ভিসি সাহেব আবরার ফাহাদের মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, উত্তেজিত জনতা দেখা করতে দেয়নি। কোনো মতে শুধু কবর জিয়ারত করেই চলে আসতে হয়েছে।

(দুই)
ভিন্নমত পোষণ কিংবা প্রচারের জন্য কাউকে কোনোভাবেই নিপীড়ন, নির্যাতন করা যায় না। সে যে মতবাদেই বিশ্বাসী হোক না কেন। ধরে নিলাম, সে ইসলামী ছাত্র শিবির করত, তাতে কি? তাই বলে তাকে হত্যা করতে হবে? কেউ যদি মুক্তমনা হয়, তাই বলে তাকে হত্যা করতে হবে? এটা কোন ধরনের সভ্যতা? কোন ধরনের রাজনীতি?

(তিন)
মেধাবীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত বুয়েটের ছাত্রদের মধ্যে এটা কি ধরনের মেধার পরিচয়? এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, মেধা বলতে আমরা কি বুঝি? ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ যাদের মধ্যে নেই, তারা কেমন মেধাবী? শুধুমাত্র এসএসসি, এইচএসসিতে (মুখস্ত বিদ্যার জোরে) যারা অনেক নম্বর পায়, তারাই মেধাবী? তাহলে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন তো মেধাবী না। তিনি তো খুব খারাপ ছাত্র ছিলেন। মূলকথা আমাদের দেশে সর্বস্তরে নৈতিকতার অভাব, সুবোধ পালিয়ে গেছে, অনেক আগেই। পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, রাস্ট্রে কোথাও নৈতিকতা বলে কিছু নেই। এক ভয়ংকর নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা, অসম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। যার ফলে দেশের সামস্টিক এবং ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অগ্রগতি হলেও সামাজিক অগ্রগতি হয়নি। মানুষের মধ্যে কোনো স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। এক সময় যারা কুঁড়েঘরে স্ত্রী পরিজন নিয়ে নিরাপদে শান্তিতে ঘুমাতে পারত, তারা এখন অপেক্ষাকৃত ভালো ঘরবাড়িতেও থেকে অনিরাপত্তায় ভুগছে।

প্রশ্নের মুখে বুয়েটের ভিসি

(চার)
আবরার হত্যাকাণ্ডে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের জোর দাবি উঠেছে। যারা এই দাবিটি করছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কয়েক সপ্তাহ আগে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিসি তাঁর এক ছাত্রীর সাথে কি আচরন করেছিলেন, মনে আছে? ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে সেই ভিসি রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগ করেছেন। সেখানে কিন্তু ছাত্ররা যদি প্রতিবাদ না করত, তাহলে কি সেই ছাত্রী তাঁর ছাত্রত্ব ফিরে পেত? ভিসিকে পদত্যাগ করতে হতো? হতো না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষক মানিকের কথা মনে আছে? সেই সেঞ্চুরিয়ান মানিক কিন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখেই চিরদিনের জন্য ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং ছাত্র রাজনীতি বলতে আমরা অধিকাংশ সময় যা দেখি, সেটা কি ছাত্র রাজনীতি? না কি আমি যে দুটি উদাহরণ দিলাম, এগুলো ছাত্র রাজনীতি? আগাছার কারনে চাষাবাদ বন্ধের দাবি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

(পাঁচ)
ডাঃ জয়নাল আবেদীন নামক একজন শক্তিশালী ফেইসবুক ইউজার, একটা পোস্ট দিয়েছেন। শক্তিশালী বলছি, কারণ তিনি তার যুক্তিসমূহ অনেককে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন। এমনকি অনেকে বিশ্বাস তো করেছেনই, কোনো বিচার-বিবেচনা না করে নিজেদের ওয়ালে শেয়ারও করেছেন। তার পোস্টটি হুবুহু তুলে দিলামঃ
[ যে কোনো একটা চাঞ্চল্যকর হত্যার পরপরই টিভি সাংবাদিকরা ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছুটে যান ভিক্টিমের বাসা বা বাড়িতে। সেখানকার হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখতে হয় প্রতিবার।
ট্রেন্ডটা বরং এখন বদলে যাক। এবার ক্যামেরার সামনে আনা হোক খুনিকে এবং তার পিতা-মাতাকে।
যে সব নরপশু একেকটা তাজা প্রাণ নিতে পারে অবলীলায় তাদের বাবা মা কে দেখানো হোক টিভিতে।
মাকে প্রশ্ন করা হোক তিনি যে বস্তুটিকে ২৮০ দিন পেটে রেখেছিলেন সেটা এক সময় খুনী হবে ভেবেছেন কখনো?
সর্বশেষ বার যখন ছেলেকে খাবার খাইয়েছেন তখন জানতেন তার ছেলের পক্ষে মানুষ খুন করা সম্ভব?
খুনীর মা হিসেবে অনুভূতিটা কেমন হচ্ছে?
বাবাকে ধরে আনা হোক ক্যামেরার সামনে।
সন্তানটিকে কীভাবে মানুষ থেকে খুনীতে পরিণত হলো তার জবাবদিহি চাওয়া হোক। প্রশ্ন করা হোক, ছেলের কৃতিত্বে তিনি কতটা গর্বিত?
প্রশ্ন করা হোক, ছেলের কী পরিমাণ শাস্তি তিনি চান?

প্রশ্ন করা হোক, ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হলে তিনি মানতে পারবেন কিনা?

প্রশ্ন করা হোক,সন্তানকে মানুষ করার প্রক্রিয়া তিনি ঠিক কোন জায়গায় ব্যর্থ হয়েছিলেন?
সর্বোপরি জানার চেষ্টা করা হোক তার সন্তানটি যখন জেল থেকে বের হয়ে আসবে তখন তিনি তাকে হাসিমুখে বরণ করবেন কিনা? এমন একটি জঘন্য কর্মের জন্য তার ফয়সালা কি হবে?
জানি এমনটা করা হলে বেশিরভাগ জবাব হবে মিথ্যে। কারণ অমানুষ সন্তানের বীজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমানুষ বাবা মায়ের মধ্যেই লুকায়িত থাকে।
তবুও চেহারাগুলো দেখানো হোক। ভিক্টিমের বাবা মাকে দেখিয়ে শোক বর্ষণ করানোর পাশাপাশি আমাদেরকে খানিকটা ঘৃণা বর্ষণের সুযোগ দেয়া হোক।]

এবার আসুন জয়নাল আবেদীন সাহেবের যুক্তিগুলো পর্যালোচনা করা যাকঃ (১) যে বা যিনি ভিক্টিম হন, কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের কাছে টিভি ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যত সহজ, যারা খুন করেছে, তাদের কাছে কি তত সহজে যাওয়া যাবে? ব্যাপারটি কি এমন যে, খুনিরা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার জন্য বসে থাকবে? নাকি পালাবে? নাকি হুমকি দিবে? (২) খুনির মা-বাবা কি কারো সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হবেন? ব্যাপারটি কি এত সহজ? নাকি উচিৎ? অথবা খুনির মা-বাবা কি অন্যায় করেছে? তারা কি খুন করতে বলেছে? তাদেরকে হেনস্তা করা হবে কেন? (৩) আমি, আপনি কিভাবে জানি, উক্ত হত্যাকাণ্ডে কে কতখানি সম্পৃক্ত? একটা হত্যাকাণ্ডে সকলই সমানভাবে সম্পৃক্ত থাকে না। সেকারনে আমরা একটা খুনের ঘটনায় কাউকে ফাঁসি, কাউকে যাবজ্জীবন, কাউকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড (শাস্তি) পেতে দেখি। এখন যদি একটা ঘটনা ঘটার পরপরই টেলিভিশনের সাংবাদিকরা যাকে খুনি মনে করবে, তাকে এবং অথবা তার পরিবারকে জনসম্মুখে হেনস্তা করে, সেটা কি ঠিক কাজ হবে? এমনিতেই আমাদের দেশের সাংবাদিকদের সততা, পেশাদারিত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আর একজন সাংবাদিকের কাজ তো এটা না। এটা পুলিশের কাজ। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে কিন্তু আদালত কতৃক শাস্তিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কারো ছবি, ভিডিও কোনো ধরনের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না। বাংলাদেশে যার যা খুশি সে তাই বলছে, তাই করছে। ক্রসফায়ারে কাউকে হত্যা করা আর একজন অভিযুক্ত অপরাধীর ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা একই কথা। অপরাধ প্রমানিত হবার আগেই শাস্তি প্রদান। গণমাধ্যমে একজন অপরাধীর ছবি প্রকাশ হলে সে শুধু একাই শাস্তি পায় না, একই সাথে শাস্তি পায় তার পরিবারের নিরাপরাধ সদস্যরা। এগুলোকে ক্যামেরা ট্রায়াল বলে। সেটা কি আরেক ধরনের অপরাধ নয়? (৪) জয়নাল আবেদীন লিখেছেন, “অমানুষ সন্তানের বীজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমানুষ বাবা মায়ের মধ্যেই লুকায়িত থাকে।” এটা কি ধরনের কথা? কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের জাজমেন্ট কি গ্রহনযোগ্য? এগুলো কি আদিম যুগের চিন্তা-ভাবনা নয়? পাকিস্তানে এবং আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় এখনো কেউ যদি কাউকে ধর্ষন করে তাহলে সালিশের মাধ্যমে ধর্ষনকারীর বোনকে ধরে এনে একদল পুরুষ মিলে গণধর্ষন করে। এটাকে বলে অনার রেইপিং। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বোনটা কি অন্যায় করেছে? আবরারের প্রতি, তাঁর পরিবারের প্রতি সহানুভুতি, সমবেদনা, সহমর্মিতা আমাদের সবারই আছে; তাই বলে একজন গর্ভধারিনী নিরাপরাধ মাকে হেনস্তা করার কথা মাথায় আসে কিভাবে?

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন: 
একাডেমিক, প্রাবন্ধিক এবং কথাসাহিত্যিক।
www.facebook.com/shakhawat.nayon
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments