আমাদের সময় বর্ষার একমাত্র বাহন ছিল আবহমান বাংলার চির ঐতিহ্যবাহী নৌকা। এমন কী এপাড়া থেকে ওপাড়ায় যেতেও নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। তাই বর্ষায় ঘরে ঘরে ছিল নৌকার কদর। নানা আকৃতির নৌকা নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে এলাকাভিত্তিক নৌকার ধরন এবং আকৃতিগত পার্থক্যও ছিল। সাধারণত অধিকাংশ এলাকায় নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো কোষা নৌকা। হাট-বাজার, গৃহস্থালি নানাকাজে কোষা নৌকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আকারে বড় কোষা বা ডিঙ্গি নৌকায় ছই লাগানো হতো। এ ধরনের নৌকার ভেতরের পুরোটা থাকত পাটাতন করা। তাতে বিছানো থাকত হোগলা বা চাটাই বা শীতল পাটি। এগুলোকে বলা হতো কেরায়া নৌকা। মূলত এগুলো ভাড়ায় ব্যবহৃত হতো। বর্ষায় অবসরে কেরায়া বেয়ে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার সংসার চালাতো।

বর্ষায় আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নির্ভরযোগ্য বাহন ছিল কেরায়া নৌকা। বিয়ের বরযাত্রী, বনভোজন ইত্যাদি কাজেও কেরায়া নৌকার ব্যবহৃত হতো। মূলত বউ-ঝিদের নাইওর আনা নেওয়াতে এই ছইওয়ালা নায়ের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। বউ-ঝিদের পর্দা সুরক্ষায় এর জুড়ি ছিল না। কখনো মাঝির দিকের ছইয়ের ওপরে নীচে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। কারণ, বউঝিরা স্বাচ্ছন্দ্যে নৌকায় ভেতরে শোয়াবসা করতে পারত। পুরুষ যাত্রীরা অনেকেই আবার ছইয়ের ওপরে বসত। প্রয়োজনে রোদে একখান ছাতাও মাথায় রাখত। মজার বিষয়, বাতাস অনুকুলে থাকলে নৌকায় লাগানো হতো পাল বা বাদাম। পালে বাতাস লাগলে নৌকা তরতরিয়ে এগিয়ে চলত। দারুণ মজা হতো! পালের পতপত আওয়াজটা আরো চমকপ্রদ! মাঝি একহাতে নৌকার হাল অন্যহাতে পালের লাগাম টেনে ধরত। এতে মাঝির কষ্টটা অনেকাংশে কমে যেত। আহা রে! এলাকাজুড়ে খোলামেলা সবুজাভ ধান-পাট ক্ষেত। সে কী ঝিরঝির নির্মল বাতাস! আর ভরাবর্ষার টলটলে পানির শীতল আমেজ। মাঝি মনের আনন্দে লোকসংগীত, ভাটিয়ালি, মারফতি গান ধরতো। গানের সুরের মূর্ছনায় নৌকায় বিরহী বধুর পরাণটা আনচান করত। তখনকার সময় প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী প্রয়াত আবদলু আলীমের গানই সমাদৃত ছিল। সেই চির আবেদনীয় গান মাঝিরা গলা ছেড়ে গাইত।
বন্ধুর নায়ে ওড়ে নীল বাদাম।
আমি গাঙের ঘাটে যাইতে না রী, ঘরে আছে নানান কাম।
বন্ধুর নায়ে উড়ে নীল বাদাম।
বন্ধু আমার প্রাণ কালিয়া, যায় রে নীল বাদাম উড়াইয়া গো।
বন্ধু নিত যদি নায়ে তুলিয়া, পোড়া দেহ জুড়াইতাম।
বন্ধুর নায়ে উড়ে নীল বাদাম।
এ গানেও বিরহী বধূ তার বন্ধুর কথা মনে হলে হস্তে কাম না ওঠার আকুলতাও প্রকাশ করে এ গানে।
এমনি বর্ষায় মাঝিমাল্লার গান শুনে কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে বিরহী বধুরা থমকে যেতো! আর আকুল করা সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হতো। তারা ভুলে যেতো শ্বাশুড়ির সময় বেঁধে দেওয়ার কথা। ভুলে যেতো শ্বাশুড়ির ভেংচী মেরে মুখ ঝামটা খাওয়ার কথা। এগুলোকে ছাপিয়ে বিরহী বধুর উথালপাতাল মন ছুটে যেতো দূর অজানায়!
তাছাড়া আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্ব ও ভাবতত্বের বিষাদগম্ভীর গানও তাদের কণ্ঠে ভেসে আসত।
যেমনঃ
মাঝি ভাইয়া যাওরে অকুল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙা নাও ও রে মাঝি বাইয়া যাও রে!
এ গানের কথায় মূলত স্নিগ্ধ শোভামণ্ডিত পৃথিবীকে অকুল দরিয়া ভাবত। আর বার্ধক্যে, জরায় জীর্ণ-শীর্ণ দেহটাকে ভাঙা নৌকার সাথে তুলনা করতেন। তাই তো শিল্পীর কণ্ঠে বেজে উঠত আকুল করা দেহতত্ত্বের সে বিয়োগ বিষাদিত গান।
এই যে আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্বের মারফতি, ফকিরি আরো কত রকমারী গান গেয়ে মাঝিরা পাল তোলা নৌকায় হাল ধরে বসে মনের খোরাক মেটাত। কিংবা মনের দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করত। যা এখনো স্মৃতিরোমন্থনে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয় ওঠে।
এখন আর নেই বর্ষায় নদীর শোভাময়ী সেই রংবেরঙের পাল তোলা নৌকা। সেই ছইওয়ালা কেরায়া নৌকায়ও বউ নাইওর আনা-নেওয়া আর হয় না। বধুদের বিরহেও যেন এখন সে আবেগের প্রাবল্য নেই। শ্বশুর বাড়িতে নির্যাতিত বোনটির কষ্টের খবরও মাঝির কাছে আর কেঁদে বলতে হয় না। এখন আধুনিক প্রযুক্তি মোবাইলেই সবকিছু চলছে। ফলে আবহমান বাংলার চির ঐতিহ্যবাহী নৌকার প্রচলন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর মূল কারণ, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতকরণ করা হয়েছে। রাস্তাঘাট পাকা করাতে অটো, সি এন জি চলছে দেদারছে। মানুষ এখন হাঁটতেও ভুলে গেছে। আর প্রমথ চৌধুরীর সে “বর্ষা” প্রবন্ধের চিরায়ত রূপও আর নেই। তাই তো দেহতত্ত্বের মারফতি, ফকিরি গানের সে সুরের মূর্ছনা আর মাঝিদের কণ্ঠে শোনা যায় না। সবকিছুই এখন ইউটিউবে। তবে আবহমান ঐতিহ্যকে এখনো অস্বীকার করতে পারছেনা। ফলে সে নৌকা এখনো খুঁজে পাই অর্ধ বাস্তবে। গানের সাথে ছবির সংযোজনে।
আসলে, জীবনের শেষ সায়াহ্নে মানুষ নিজের অক্ষম, অথর্ব দেহটার বোঝা বইতে পারে না। তখনি এ সব দেহতত্ত্বের গান বৃদ্ধরা শুনে হা পিত্যিস করে। হারানো জীবন ক্ষয়ের দুঃখটাকে আরো বেশি করে স্মরণ করে কেঁদে বুক ভাসায়।
ব্যবহার্য নৌকায় মাঝেমধ্যে মিস্ত্রী দিয়ে নতুন কাঠ লাগিয়ে ছিদ্রপথ বন্ধ করে। গাবের রস, আলকাতরা দিয়ে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। একটা সময় আসে এটাকে মিস্ত্রী দিয়ে ঠিক করলেও কোনক্রমেই আর ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায় না। ঠিক করতে গেলেই আরো ঝুরঝুরা হয়ে খুলে যায়।
জীবন নদীতে আমাদের দেহটাও এমনি। একটা সময় আসে দেহতন্ত্রও কোন ওষুধে আর কাজ করে না। বিভিন্ন রোগ স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।
প্রকৃতিতে প্রতি বৎসরই বর্ষা আসে। আর এর শুরুতেই পানির তোড়ের গতিবেগ থাকে গতানুগতিক ধারায়। এর কোন হেরফের নেই। কিন্তু জীবনের বর্ষার তোড় একবারই আসে। মানে যৌবন জীবনমাত্রই একবার। আর যৌবনের ভাটায় সে গতি,সে তোড় আর থাকে না। জীবন বহতা নদীর মতো হলেও এটি আবহমান নয়, এর শেষ আছে। ঠিক যেন নৌকার মতোই!
পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ।