ষড় ঋতুর লীলাভূমি আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। ঋুতুবৈচিত্রের সাথে সাথে প্রকৃতিও বদলায়। তবে একেক ঋতুতে একেক রকম। প্রতিটি ঋতু রঙে-ঢংয়ে, বৈচিত্র্যে- বিন্যাসে ,বর্ণাঢ্য-বর্ণিল সেজে জানান দেয় তার আগমনী বার্তা। তার মধ্যে বর্ষা অন্যতম। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু জ্যৈষ্ঠমাসের অর্ধেক থেকে বর্ষার পানি আসা শুরু হয়। আর বর্ষার পানি থাকে শরতের শেষ অবধি। তাই বর্ষা আর শরৎকালীন সময়ে মূলত গ্রামে গৃহস্থালি কোন কাজই থাকে না। অতীতে আষাঢ়-শ্রাবণ ছিল পাটের নিবিড় মওশুম। তখন অর্থ কড়ি ফসল হিসেবে পাটের ছিল ধারণাতীত কদর। পাট বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জিত হতো বলে পাটকে সোনালী আঁশ বলা হতো।
পাটকাটা,পাট জাগ দেওয়া তখন গৃহস্থরা এবং কামলারা ব্যস্ত থাকত হর-হামেশা।পাট থেকে আঁশ আলাদা করা, পাট ধোয়া, শুকানো সব কাজই শ্রাবণের শুরুতেই প্রায় শেষ হয়ে যেত। তাই বর্ষার শুরুতেই গরুর ঘাস কাটা ছাড়া তেমন কোন কাজই থাকত না।
তাই গৃহবধূরা শীতের ব্যবহার্য কাঁথা ধুইত বর্ষার নতুন পানিতে। তারপর কাঁথা সেলাই করা চলত বর্ষা-শরত মওশুমে। আবার সৌখিন গৃহবধূরা কেউ কেউ নতুন পাটের আঁশ দিয়ে নকশি শিকা তৈরি করত। বিড়ালের উপদ্রব থেকে রান্না করা তরকারি নিরাপদ রাখার একমাত্র উপায় ছিল ঝুলন্ত শিকা। তাছাড়া পাটের ওপর নানা রঙ মিশিয়ে শিকার শোভাবর্ধন করা হতো। সৌখিন পরিবারে রঙ করা কারুকাজ করা শিকায় ঝুলিয়ে রাখা হতো শখের হাঁড়ি। ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে এর জুড়ি ছিল না। তাছাড়া গ্রামীণ সভ্যতায় লেপ-কাঁথা রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো গাইঞ্জা। শিকার মতোই বড় সাইজের কারুকাজ করা গাইঞ্জা তৈরি করত পাটের আঁশ দিয়ে। এটা মূলত গৃহস্থজীবন ও গ্রাম্য-সংস্কৃতির একটা ঐতিহ্য।
আরো ছিল চিরআবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা। নতুন মেয়েজামাই এলে নকশী কাঁথা দিয়ে জামাইকে আতিথেয়তায় মুগ্ধ করত। কিশোরী এবং তরুণীরা সূ্ঁই দিয়ে রংবেরঙের সূতোয় বুনত হাত পাখা। বিভিন্ন নাম ছিল হাতপাখার। পুকুরকাটা, শঙ্খলতা। তাছাড়া কাপড় দিয়ে তৈরি পাখায় ফুল পাখির সূতোর কাজও দারুণ শোভা পেত। এই সব পাখায়ও সূতো বনুনে লেখা হতো, “হায়রে হাতপাখা! শীতে নাই দেখা, গ্রীষ্মে প্রাণের সখা।” শখের বশে অনেকেই বেতের কুলা-ডুলা,ডালা ধামা-পুড়া বানাত। তাছাড়া কুসিকাঁটা দিয়ে গেঞ্জি, টুপি তৈরি করত। এক রঙের কাপড় দিয়ে টেবিল ক্লথ, বেড কভার আর বালিশের কভারেও নানা রঙা সূতোয় রকামারী ফুল তোলা হতো। আর রুমালে তোলা হতো রঙিন সূতোর বুননে ফুল পাখি। সাথে লেখায় ফুটিয়ে তুলত, “ভুলনা আমায়” কিংবা “মনে রেখো”। অথবা “ভালোবাসি তোমায়”। আরো লেখা থাকত,” যাও পাখি বল তারে সে যেন ভুলে না মোরে।” কখনো রুমালে সূতোর বুননে ফুটিয়ে তোলা হতো নিজের নামের প্রথম অক্ষর + প্রেমিকের নামের প্রথম অক্ষর। আর এগুলো উপহার দিত মনের মানুষটিকে। আর ভালোবাসার মানুষটি পরম যতনে প্রিয়ার দেওয়া রুমালটি বুক পকেট রেখে দিত। প্রেমিকার কোমল হাতের স্পর্শ লেগে থাকা রুমাল বলে কথা! আহা রে! প্রেমিক তা অনুভূবে পুলকিত হতো। নাকে-মুখে-ঠোঁটে ছুঁয়াত। প্রেমিকার স্পর্শানুরণনে রোমঞ্চিত হতো। আহা! সে কী এক আনন্দঘন মুহূর্ত! উপভোগের শিরায় শিরায় স্পন্দিত হতো। কখনো অবসরে প্রেমিক-প্রেমিকরা বিভিন্ন রংবেরঙের প্যাডে চিঠি লিখত। সে প্যাডেও লেখা থাকত “ভুলনা আমায়” বা “মনে রেখো” ইত্যাদি।
তারপর রঙিন খামে ভরে পাঠাত প্রিয়তমের কাছে চিঠি। ভালোবাসার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। রঙিন খামে মোড়া চিঠি। দিন ক্ষণ মুহূর্ত কাটত সে চিঠির অপেক্ষায়। এখন আধুনিক প্রযুক্তি মোবাইলে চলে হৃদয় ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার।
শারদীয় জোছনার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। উজ্জ্বল ও ফকফকা শারদ-জোছনায় উঠোনের বালুর কণা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যেত। তাই তো কিশোরীরা চোখবাঁধা, হাতাভাঙ্গা বা লুকোচুরি খেলায় মেতে থাকত। লুডু খেলাও ছিল তখনকার সময়ে একচেটিয়া খেলা। কিশোরী বা শিশুরা দরজীর দোকান থেকে সংগ্রহ করতে টুকরোটুকরো রংবেরঙের কাপড়। আর তা দিয়ে সুইসূতো দিয়ে বানাত পুতুল। তাছাড়া,পাহাড়ি মাটি দিয়েও বানাত জামাই-বউ পুতুল। আহা রে” এই পুতুল বিয়েবিয়ে খেলা খেলে শিশু-কিশোরীদের কাটাত আনন্দময় শৈশব।
আর যুবকরাও বসে নেই। বর্ষাকালীন অবসরে তারা নানাধরনের খেলায় মেতে থাকত। হাডুডু খেলা ছিল বর্ষার অন্যতম আকর্ষণ। পতিত বাড়ির উঠোনে হতো খেলা। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত। কিংবা পাড়ায়-পাড়ায়। কখনো বা সংগঠন বনাম সংগঠন। দারুণ জমত এই খেলা। চারপাশ ঘিরে থাকত নানা বয়সী মানুষ। কিশোরী -তরুণীও বাদ যেতনা। প্রিয় মানুষটিকে হাততালি দিয়ে উৎসাহ জোগাত। আর আড়েআড়ে চেয়ে থাকত খেলোয়াড় প্রেমিকটি। ভলিবল খেলার প্রতিযোগিতাও হতো এই শরতের অবসরে। যুবকরা এই ধরনের খেলায় পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখত।
কখনোকখনো মাটিতে দাগ করে ছয়গুটির খেলা চলত। আর তাস? এটাও তখন শখের খেলা হিসাবে গাছ-গাছালীর ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে খেলত। এমনই গ্রামীণ-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য আনন্দ-উৎসবে কেটে যেত বর্ষা বা শরতের অবসর বিনোদন।
তাছাড়া একনাগাড়ে বৃষ্টিতে প্রেমিক যুগলরা পড়ত মহাফাঁফরে। ঘর থেকে বের হতে পারত না কিশোরীরা। কিশোর প্রেমিক বৃষ্টিস্নাত হয়ে পাতার বাঁশি বাজাত ঠোটে। কিংবা শিশ দিত। পাগলপারা কিশোরীর মন আর ঘরে থাকেনি। গোসল করার ওসিলায় বের হয়ে যেত ঘর থেকে। প্রিয় মানুষটির মুখদর্শন ছিল তার লক্ষ্য। প্রবাদ আছে, “যার সাথে যার ভাব, ছায়া দেখলেও বেজায় লাভ।” লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা করার কিশোর প্রেমের ব্যাঞ্জনার স্বাদই ছিল আলাদা। প্রেমিকদের প্রেমেজর্জর মনে এখন আর সেই দর্শনও নেই। এখন মোবাইলে ভিডিওতে চলে আলাপচারিতা। দেখা- সাক্ষাতের সময়ও স্থান নির্ধারিত মোবাইলে।
গাছ লাটিম খেলা ছিল আরো একটি চমকপ্রদ আকর্ষণ। কমপক্ষে তিন-চারজন লোক লাগত এই গাছলাটিম চালাতে। বোম করে আওয়াজ হতো গাছ লাটিমের। বর্ষায় অবসর বিনোদনে এই খেলা ছিল উপভোগ্য। বহু মানুষ উপভোগ করত গাছ লাটিম খেলা। ঘুড়ি প্রেমিকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নেশা ছিল আরো একটি সৌখিন খেলা। বোমা ঘুড়ি ওড়ানো। ভর দুপুর কিংবা সকালে বাদ যেতনা তা ওড়াতে। নীল আকাশে ছিল তার অবাধ বিচরণ। প্রেমিকবর মানুষ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে। ঘাড় ব্যথা হলেও চেয়ে থাকত। যে ওড়াত তার খাওয়া-দাওয়া চলত সেখানেই। সব সময় তটস্থ থাকত কোন সময় জানি ঘুড়ি টালমাটাল করে। তবে স্বাভাবিক বাতাসে ধীর-স্থির হয় ওড়ত বোমা ঘুড়ি। এটারও একটা মিহি সুরের আওয়াজ হতো। যা ঘুড়ি প্রেমিক মানুষকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখত সারাক্ষণ।
আরো আকর্ষণীয় ছিল শিশু-কিশোরদের সাধারণ লাটিম খেলা। এতে হেরে যাওয়া খেলোয়াড় কখনো লাটিমের ঘা খাওয়ার ছিদ্র দেখে কেঁদে ফেলত। আর তর্কাতর্কি, খুনসুটিই তো ছিল লাটিম খেলার আসল মজা। এখন কালেভদ্রে লাটিম খেলার প্রচলন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিকে আছে। বর্ষা-শরত মওশুমে আবহমান বাংলায় সুস্থ-বিনোদনে মাতিয়ে রাখত এমনই করে। এই আবেদনীয় খেলাগুলো আর কুটিরশিল্প নানা স্বাদে নানা আমেজে বাংলার মানুষকে মুখর রাখত ।
আজ আর নেই হাতে বোনা হাত পাখা। বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয় চার্জার ফ্যান। কিংবা সূতোয় কারুকাজ করা রুমালও আর চোখে পড়েনা। এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় টিস্যু পেপার। শিকা আর গাইঞ্জার ব্যবহার এখন বিলুপ্ত প্রায়। বোমা ঘুড়ি, গাছ লাটিমের মতো সৌখিন খেলা এখন আর চোখে পড়ে না। কালেভদ্রে কিশোরদের লাটিম খেলা চলে। তবে আগের মতো নয়। বেতের কুলা-ডুলা-ডালা, ধামা-পুড়ার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে। পুড়ায় করে চালভাজা, ছোলাভাজা আর মুড়ি খাওয়ার স্মৃতি এখনো আমাদের আবেগ তাড়িত করে। প্লাস্টিকের প্রচলনের সাথে-সাথে এগুলো গ্রামীণ-সংস্কৃতি থেকে প্রায় উধাও। পুতুলবউ আর জামাই পুতুলের বিয়েবিয়ে খেলায় কিশোরীরা এখন আর সময় ব্যয় করে না।
আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে শিশু-কিশোর হাতের কাছে না চাইতে পেয়ে যায় অনেককিছু। তাই গ্রামীণ-সংস্কৃতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাই এখন গ্রামে গেলে নিখাদ গ্রামকে আর খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না আমাদের সে আনন্দঘন জ্যোতির্ময় কৈশোরকে। বর্ষা-শরৎ আসে যায়। কিন্তু সেই স্বাদে-ব্যাঞ্জনায় বর্ষা-শরতের অবসর বিনোদন আর জমে ওঠে না। এমনকি বর্ষা শরতের পার্থক্যও মানুষের অনুভূতিতে সাড়া দেয়না। পেঁজা তুলোর মতো শরতের সাদামেঘের ভেলা! দারুণ! মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখত মন। এখন যান্ত্রিক সভ্যতায় চিত্তকে আগের মতো ব্যকুল করে তুলে না। এমনি বর্ষার মেঘমেদুর বর্ষণও মানুষকে আর আনমনা করে তুলে না। উদাসী মনে স্মৃতিচারণা এসে ভরও করে না। যেমনটি করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তাই তো তার কবিতায় কবি বলেছিলেন,
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
বর্ষার বর্ষণে তারে, কি বলা যায় রবীন্দ্রনাথও বলে যেতে পারেন নি। আমরাই বা বলি কি করে? থাক না আজ না বলা কথা! তাই তো বর্ষার বর্ষণে নীরবে চেয়ে থাকা। আর নীরবতাই অ-নে-ক কথা বলে, কথা বলার চেয়েও বেশি।
০৩/০৯/ ২০২০ , নারায়ণগঞ্জ ।
পিয়ারা বেগম : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।