আব্বার রঙিন পেন্সিল । ইলোরা ইয়াসমিন মুমু

  
    

[ আজ রোববার অস্ট্রেলিয়ায় বাবা দিবস। বাবা- মা কিংবা প্রিয় মানুষ ও স্বজনের জন্য কোন দিবসের প্রয়োজন হয়না। বছরের প্রতিটি দিনই তাদের ভালোবাসায়, স্নেহে বা পরম মমতায় আপ্লুত হওয়ার দিন। তবুও মানুষ আলাদা করে প্রিয় মানুষের জন্য দিবস পালন করতে চায়। বাবা দিবসকে মনে রেখে সিডনি প্রবাসী ইলোরা ইয়াসমিন মুমু লিখেছেন তাঁর বাবাকে নিয়ে।]

ইলোরা ইয়াসমিন মুমু

আমার আব্বা অফিস থেকে ফিরবার পথে প্রতিদিন এক রকমের রঙিন পেন্সিল নিয়ে আসতো আমাদের জন্য। আমরা সেই পেন্সিলগুলির নাম দিয়েছিলাম লাল নীল পেন্সিল। এই পেন্সিলের বিশেষত্ব ছিল এই যে, এর অর্ধেক অংশ হতো লাল আর অর্ধেক অংশ হতো নীল। এই লাল নীল পেন্সিলের জন্য আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে রীতিমত মারামারি লেগে যেত। কারণ আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক আর আমার আব্বার আনা পেন্সিলের সংখ্যা ছিল প্রতিদিন মাত্র একটা, যা কিনা আমাদের ভাই বোনদের সংখ্যার চেয়ে অনেক কম।

জানিনা কেন এই লালনীল পেন্সিলের জন্য আমার মধ্যে খুব আকর্ষণ কাজ করত। আমি আব্বাকে গোপনে, খুব করে বলে রাখতাম পরেরদিন আব্বা যে পেন্সিলটা আনবে সেটা যেন আমার হয়। আব্বার অফিস থেকে আসার সময় ঘনিয়ে আসলেই আমি রাস্তার ধারে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন আব্বা আসে।
আমি ভাবতে ভালোবাসতাম, আব্বা নিশ্চয়ই আজ শুধু আমার জন্য পেন্সিল আনবে এবং সবাইকে লুকিয়ে পেন্সিলটা আমার হাতেই দেবে। কিন্তু আমার আব্বা কিছুতেই রাস্তায় পেন্সিল বের করতোনা। বাসায় এসে ঐ একটা পেন্সিল সবার সামনে ধরত আর আমরা সবাই মিলে সেই একটা পেন্সিল নিয়ে হুড়োহুড়ি করতাম। আমাদের ছোট ছোট ভাইবোনদের এসব কাণ্ড দেখে আব্বা তখন মিটিমিটি হাসত আর বলতো ‘দাঁড়া কি করা যায় দেখি’, তারপর বসে যেত পেন্সিল ভাগ করতে। একটা বড় ছুঁড়ি এনে পেন্সিলটা দুই ভাগ করে ফেলত। এরপর লাল অংশ দিত একজনকে আর নীল অংশ দিত আরেকজনকে। এভাবে আব্বা আজ দুইজনকে এবং পরেরবার দুইজনকে একটা পেন্সিল ভাগাভাগি করে দিয়ে অনেক ছোটবেলায়ই আমাদের মধ্যে শেয়ারিং বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছিল! এভাবে সমস্যার সমাধান করত বলে পুরো একটা আস্ত পেন্সিল পাওয়া হয়নি আমার কখনো।

আমি সবার ব্যবহার করা সেই টুকরো পেন্সিলগুলো জমাতাম। কারো লাল অংশ আর কারো নীল অংশ জমিয়ে জমিয়ে আমার ছোট্ট ব্যাগ ভরে ফেলতাম। আর আমার আশেপাশে যেসব ছবি বর্ণহীন অসুন্দর লাগত সবকিছুতে লালনীল রঙ ঘষতাম। ঘষে ঘষে রঙিন করে ছবিগুলোর দিকে চেয়ে থাকতাম অবাক দৃষ্টিতে। ভাবতাম সামান্য রঙ কত দ্রুত অসুন্দরকে সুন্দর করতে পারে ….আমি তখন আস্ত পেন্সিলের দুঃখ ভুলে যেতাম।

আজ সেই টুকরো টুকরো লাল নীল পেন্সিলগুলো সব জোড়া লেগে হাজার হাজার আস্ত আস্ত লাল নীল পেন্সিলে ভরে আছে আমার সারা ঘর। কিন্তু অনেক রঙ ঘষেও এখন আর রঙিন করতে পারিনা কিছুই ! বাবা হারানোর সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছি যেন রঙ্গিন সেই পৃথিবী।

বাবাবিহীন সাদাকালো পৃথিবীটা বড় অসুন্দর!
আর অসুন্দরকে সুন্দর করা খুব কঠিন মনে হয় আজকাল।
অনেকদিন তোমাকে ডাকিনা।
আব্বা, আব্বা আব্বা ..
আব্বা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
কোনদিন বলা হলোনা …

ইলোরা ইয়াসমিন মুমু
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments