
গত শতকের শেষ দশক থেকে শুরু, এখনও ভাবাবেগে হারিয়ে যাই যার গান শুনে তিনি মৌসুমী ভৌমিক। এসেছেন অস্ট্রেলিয়ায়, কবিতা বিকেলে’র আমন্ত্রণে; উপলক্ষ্য বাংলা সংস্কৃতি উৎসব। এই আয়োজনের তিনি যে ছিলেন মধ্যমণি, তা বলবার প্রয়োজন নেই; আয়োজকেরাও সে কথাটি ঘটা করে বলেননি। কিন্তু, সাদামাটা নাম ঘোষণার সাথেসাথে উৎসবস্থলে, গতকাল সন্ধ্যায় প্রথমবারের মত সব উপস্থিতির একযোগে করতালি জানান দেয়, কংক্রিটের কয়েয়কটি ধাপের গ্যালারি আর চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের ‘গালিচা’ মোড়ানো ঢালে আরামে-আয়েসে বসা, মানুষগুলো কার প্রতীক্ষায় সময় গুনেছেন।

ভারত থেকে তিনি এসেছেন একা; ঠিক ছিল দুই জন সহযোগীর যোগান দেয়া হবে—একজনে একতারা, অন্যজনে সম্ভবত: গীটার বাজাবেন সাথে। অবাক হয়ে দেখলাম তিনি যখন মাঝের চেয়ারটায় বসলেন তার আগেই তাকে সঙ্গ দেবার জন্য ডানে-বায়ে পাঁচ জন বসে আছেন; তাদের সবার হাতেই গীটার; আরও মজার বিষয় ওরা প্রত্যেকেই অবাঙালী, পশ্চিমা; তাক লাগানো বিষয় এদের সাথে মৌসুমী ভৌমিকের পরিচিয় ২৪ ঘন্টা আগে মাত্র। এক রাত আগে তাঁর খালি গলার গান শুনেই তরুণ ওই মিউজিশিয়ানরা সিদ্ধান্ত নেয় একরাত পরের উৎসবে মৌসুমী’র গান ও কথার সাথে গীটার বাজোনোর।

মৌসুমি যখন প্রথম গলা ছাড়লেন, গাইলেন অন্য কোনও সময়ে, বুঝতে এতটুকু সময় লাগেনি কেন তিনি একাই চলে এসেছেন, তাঁর গলা স্বনির্ভর- আর কিছু লাগে না ওই গানের কথায় হারিয়ে যেতে। কতক্ষণ একটানা শোনার পর মনে হতেই পারে আর কোনও মিউজিক কি ছিল সাথে; গীটার অমূলক; তবু বাকিরা বাজিয়েছেন মৌসুমীর কন্ঠ, সুরের আহ্বানে আর ব্যক্তিত্বে ব্যাকুল হয়ে।
একে একে গেয়েছেন পাখির ডানায় উড়ে, আমার কিছু কথা ছিল, সং অব দ্য স্কাই – এই যে আকাশ, যারা সুখে আছ, অপরাধী হইলাম আমি, যশোর রোড, বাড়ি কোথায়, ঘুর ঘুর ঘুরছে ঘুড়ি ইত্যাদি গান। এর প্রত্যেকটি অগণিতবার শোনা। সুরের বৈচিত্র্য নেই, হয়ত; ভিন্ন ভিন্ন বীক্ষণে গানের কথায় মনচোখ দেখে নিতে পারে অকৃত্রিম ‘মৌসুমী’ জীবন ও তাঁর নানান পরত।

গানের ফাঁকে কথাও চলেছে, বলেছেন তিনি একাই। বললেন অস্ট্রেলিয়ায় এই তাঁর প্রথম আসা। তাতে কি, দেশটির সাথে তাঁর পরিচয় নতুন নয়, জেনেছেন নানান মুখ কথায়, বইয়ের ও খবরের পাতায়; দেখেছেন মানচিত্রে, দেখে অস্ট্রেলিয়াকে তাঁর মনে হয়েছে টিয়ার ড্রপ—চোখের কোণে জমে থাকা এক বিন্দু জল। ছোট্ট এই উদাহরণ বলে দেয় দেখার চোখ কতটা শক্তিশালী! সেই চোখ দিয়ে যে জীবন তিনি দেখেছেন সে জীবন আমাদের দেখিয়েছেন, দেখাচ্ছেন তার গানের কথার মধ্য দিয়ে। সে কারনে অনেকেই তাঁর গানকে ‘জীবনমুখী’ বলেছেন, সেভাবে সজ্ঞায়িত হতে তাঁর আপত্তি। সাধারণ শ্রোতা হিসেবে সংজ্ঞায় ফেলবার প্রয়োজন আমাদেরও নেই; তবে তাঁর গানে যে বোধের ছাঁচ তৈরি হয়, সে কথা অস্বীকার করি কী করে! যে বোধে তিনি গান বাঁধেন সে বোধের কথা কালও তিনি বলে গেছেন গানের ফাঁকে, আলাপে। বলেছেন আকাশকে শুনতে, পাখিকে শুনতে, পায়ের নিচে মাটিকে শুনতে, চারপাশের সবাইকে শুনতে।
অমায়িক বাচন অথচ কন্ঠে খাদ; তাতে যে গান, যে কথা তা আমাদের যতটা শোনায় তার থেকে অনেক বেশি দেখায়; আমরা দেখেছি ‘মৌসুমী’ জীবন।
শাহরিয়ার পাভেল
লেখক, সংস্কৃতকর্মী, তথ্য প্রযুক্তিবিদ
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।