আমরা সবাই জয়ী হতে চাই, তবে…। পিয়ারা বেগম

  
    

জীবন একটি প্রতিযোগিতা। আমাদের জন্মের ইতিহাসও কিন্তু তা-ই বলে। মাতৃগর্ভ থেকে একটি ডিম্বানুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য পিতার দেহ থেকে বের হয় ৪০/ ৫০ কোটি শুক্রাণু। এতে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে কেবল একটিমাত্র শুক্রাণু। আর সে শুক্রাণুটিই ভ্রুণ হওয়ার সুযোগ পায়। আর ৪০/৫০ কোটির সাথে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে বলেই আমরা এ পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। এতে আমরা পেয়েছি এক অলোকসাধারণ, অপূর্ব মানবজীবন! সুতরাং আমাদের ডিএনএতেও রয়েছে এ প্রতিযোগিতার প্রোগ্রামিং- এর ইতিহাস। তাই তো এর প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যেমন ভালো স্কুলে ভর্তির প্রতিযোগিতা, শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতা।পরীক্ষায় পাশ, ভালো রেজাল্ট করা, চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।

তাছাড়া অফিস-আদালতেও চলছে প্রতিযোগিতার জোরসে লড়াই। চাকরিতে বেতন-বোনাস বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা, বড় সাহেবের নেক নজর ও প্রোমশনের তদবীর প্রতিযোগিতা। আরো চলছে চাটুকারিতা ও তোষামোদিতে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা। চাপাবাজীতে জেতার প্রতিযোগিতাও পিছিয়ে নেই! কোথায় নেই এই প্রতিযোগিতা? আসলে আমরা প্রায় প্রতিটি মানুষই কোন না কোন প্রতিযোগিতার নিয়মিত পার্টিসিপেটর। আর আমরা অহর্নিশি লিপ্ত থাকছিও এই প্রতিযোগিতায়। তাই তো এর উত্তপ্ত ঝড়োহাওয়া আমাদের পরিবারেও পড়েছে। ভাইয়ে-বোনে এমন কি স্বামী-স্ত্রীতেও। তাছাড়া শ্রমিক-কর্মচারী, কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, কবি-লেখক, শিক্ষক মূলত সবার মধ্যেই সাজসাজ রবরব প্রতিযোগিতার মহোৎসব চলছে সর্বত্র।

হায় রে দুনিয়া! দু’দিনের এই খেলাঘরে কি যে চলছে জীবন বাজির খেলা! কে খাবে কার ঘাড় মটকে, কে যাবে কাকে টপকে। আরও চলছে    আখের গোছানোর পালা। তাই তো নীচের জনকে টপকিয়ে চলছে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা। প্রয়োজন লাফিয়ে লাফিয়ে একেবারে শীর্ষে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে ! লক্ষ্য একটাই  অন্যকে ধ্বংস করে নিজে আত্মস্থ করা, দখল করা। কিংবা আত্মসাৎ করে একেবারে লুফে নেওয়া। মোদ্দা কথা একদম বড় লোক বনে যাওয়া!

আমরা জানি, জীবনে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন আছে। কারণ, ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মধ্যে না থাকলে জীবনে ভালো কিছু করা যায় না। জীবন মানেই তো গতি। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে জীবনে গতি থাকবে না। স্থবির হয়ে যাবে সকল কর্মতৎপরতা। ফলে সমাজে, রাষ্ট্রেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মানুষ কাজে উদ্যম হারিয়ে ফেলবে। উদ্যোক্তারা ঝিমিয়ে পড়বে। নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে তাদের সীমাবদ্ধতার শক্তি। এতে দুর্বল হয়ে পড়বে তাদের ইতিবাচক আবেগগুলো আর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাব। উদ্যোগীরাও নিরুৎসাহিত হয়ে অলস-আড্ডায় সময় কাটাবে। জীবন মানেই তো কর্মক্ষেত্র। এখানে কাজ করতে হবে। ফলে জীবনে প্রতিটা মানুষই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন মানেই গন্তব্যে এগিয়ে যাবার সূচনার শুরু। আর প্রতিযোগিতা উৎপত্তিও মূলত এখান থেকেই। আর টিকে থাকতে গেলে, জয়ী হতে গেলেই প্রসঙ্গ ওঠে কাজের। সুতরাং জীবনের মূল স্তম্ভই হচ্ছে কাজ। আর কাজে প্রতিযোগিতার মনোভাব না জন্মালে মানুষ কাজে উদ্দীপ্ত হয় না, প্রণোদনা পায় না। তাহলে জীবনে প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তাও মূলত অনস্বীকার্য।

তবে প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে সুস্থ মনোভাব আর সুস্থ মানসিকতা। আর এ দু’য়ের সমম্বয়েই সংঘটিত হয় সুস্থ প্রতিযোগিতা। সুস্থ প্রতিযোগিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা। প্রতিটা মানুষের ভেতরেই অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আছে নিজের মেধা, সামর্থ্য ও শক্তি। প্রতিদিন একটু একটু করে এগুলোকে বাড়াতে হবে। এর জন্য নিরলস পরিশ্রম করতে হবে। তার জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো মানেই সুস্থ প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ একজন মানুষ নিজের সাথে নিজে প্রতিযোগিতা করার অর্থই হচ্ছে,  প্রতিদিন তিনি নিজেকে একটু একটু করে ছাড়িয়ে যাওয়া। মোট কথা গতকালের আমি – এর সাথে আজকের আমি-র প্রতিযোগিতা। এভাবে প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে নিজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতার ঝুড়িটাকে ভরে তুলতে হবে। বাড়াতে হবে কর্মনিষ্ঠার পারঙ্গমতা। আসলে, আমরা ভুলে যাই আমাদের সামর্থ্যের সীমানা যে কতটা বেশী, কতটা অসীম? কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতে হলে  এ অসীম সম্ভাবনাকে সামনে রাখতে হবে। আর এমনি নিরন্তর জয়ী হতে হতেই একদিন সে পুরোমাত্রায় সফলকাম হয়। মূলত সে-ই জীবনের সকল প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে।

আসলে আমরা সবাই জয়ী হতে চাই। চাওয়াটাও দোষের নয়। তবে দোষটা এখানে যে, আমরা সর্বক্ষেত্রে অন্যকে পরাজিত করার পেছনে ছুটি। এটাই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আর এই অসুস্থ মনোভাবের কারণেই আমরা পরস্পর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই।
এবার জেনে নিই এতে আমাদের কী কী ক্ষতি হয়ঃ
এতে আমরা বস্তুগত অর্জনের প্রতি আসক্ত হই। এতে বেড়ে যায় অতৃপ্তবোধ। ফলে মানুষ তার আমিত্বকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। তার নিজস্বতার বিলুপ্তি ঘটে। স্বকীয়তার স্ফুরণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। মেধার চর্চা হয় না। কারণ নিজের প্রতি সে মনোযোগী হতে পারে না। একটা অনীহা ভাব চলে আসে। এতে নিজের অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করার স্পৃহাও হারিয়ে যায়। ফলে বেশী করে অন্যের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতি অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। আর অন্যের অর্জনের প্রতিও আরো মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। পাশাপাশি পরশ্রীকাতরতা ও ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে তার অন্তর্গত চাওয়া। যেমন ‘ও’ পেছনের সারির ছাত্র হয়ে Is ইজ, Is ইজ বানান করে মুখস্থ করতে করতে মুখে থুথু বের হতো। অথচ তার এখন ঢাকায় তিন/ চারটা ফ্লাট! এ ছাড়াও তার ক্ষমতার দাপটে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খায়? তা-হলে অনার্স- মাষ্টার্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে আমি কী করলাম? ব্যস! সে-ও শামিল হয়ে গেল অসুস্থ প্রতিযোগিতায়! আর তাকে ডিঙ্গানোর জন্য ফাস্ট ক্লাস পাওয়া মানুষটিও অসদুপায়ে আকন্ঠ ডুবে গেল। তাতেও কিন্তু নিষ্কৃতি নেই। এর ফলে চরম খেসারত দিতে হচ্ছে তাকেও প্রতি কদমে-কদমে। এই যে ‘ও’ পারছে আর আমি পারছি না’ এটা তার ভেতরে ক্ষোভ জন্মে। আর এটা যদি ঘৃণা-হিংসার পর্যায়ে চলে যায় তখন তা হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। কারণ, যার সাথে প্রতিযোগিতা করা হয় সে হয়ে যায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী! আর প্রতিদ্বন্দ্বী মানে এখন ভাবা হয় শত্রু! তখন সহকর্মীকে বানিয়ে ফেলি প্রতিপক্ষ। সহযোগী হয়ে ওঠে প্রতিযোগী। এই মূলত একে অপরকে ক্রমাগত পেছনে টেনে ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা। পেছনে টেনে ধরা” প্রসঙ্গ আসায় বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এম শমশের আলী স্যারের একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সময় স্যার ব্লাকবোর্ডে একটা সরলরেখা আঁকলেন এবং তিনি ছাত্রদেরকে প্রশ্ন করলেন, এ রেখাটিকে ছোট করতে চাই। কীভাবে এই কাজটা করতে পারি? তখন একজন ছাত্র বলেছিল, স্যার, সরল রেখাটিকে একটু মুছে দিলেই তো হয়ে যায়। তখন তিনি বললেন – দেখ, এটা মুছে দেওয়ার দরকার ছিল না। এর পাশে যদি একটা বড় সরলরেখা টানো, তাহলে তো ওটা এমনিতেই ছোট হয়ে যায়। এটাই হলো সুস্থ প্রতিযোগিতা। যে জোরে দৌড়াতে পারে ওকে পেছন থেকে টেনে ধরব না। ওর পথের মধ্যে এমন কিছু রাখব না, যাতে সে পড়ে যায়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা হবে এমন যে, সে দৌড়াচ্ছে দৌড়াক, আমি ওর চেয়ে বেশি দৌড়াব, তাকে থামানোর দরকার নেই। স্রষ্টা আমার মধ্যে যে গুণ দিয়েছেন, আমি সেটা দিয়ে আরো বড় হওয়ার চেষ্টা করব। এই প্রতিযোগিতাটাই স্রষ্টা পছন্দ করেন। তাই কাউকে কোনদিন মুছে ছোট করতে যেও না। তাকে বরং সাহায্য করো যে, তুমি আরো বড় হও।” মোদ্দা কথা হচ্ছে, কেউ যদি বড় হতে চাও, তবে নিজগুণে বড় হও। নিজের মেধাকে বিকশিত করার পেছনে লেগে থাকো। আর অন্যের মতো হওয়ার প্রবণতা থেকে সরে দাঁড়াও।

তাছাড়া কখনো এমন হয় যে, আমি পারিনি তাই ‘ও’ যাতে না পারে। কিংবা আমি পেরেছি কিন্তু  ‘ও’ যাতে কখনো আমার সমকক্ষ হতে না পারে। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের, এতেও কিন্তু প্রতিনিয়ত আমরা ঈর্ষান্বিত হয়ে যাচ্ছি। এটা থেকে আমরা কিছুতেই বের হতে পারি না। ফলে অন্যের তুলনায় বেশি সুখসম্পদ লাভের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে অহরহ প্রলুব্ধ করছে। আমরা আমৃত্যু মোহাচ্ছন্ন হয় পড়ছি অসুস্থ প্রতিযোগিতার ঘেরাটোপে। এতে আমাদের মানসিক শান্তি এবং স্বস্তির পথে একটি বড় বাঁধা। আমার মতে, এটা একটা কঠিন ব্যাধি। আরো চাই, আরো চাই। আর তা পাওয়ার চিন্তায় পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে ভাবতে থাকি। সারাক্ষণ এমনি করে অস্থিরতা আর হা-হুতাশ করতে করতে হাতের কাছে যা আছে তা-ও আমরা উপভোগ করতে পারি না।
এবার জেনে নিই, এর থেকে বাঁচার উপায় কী?
আমাদের ক্ষতিকর আবেগগুলো যেমন, ঈর্ষা,লোভ, পরশ্রীকাতরতা, নিজের প্রতি নিজের অবিশ্বাস, আলস্য, লজ্জা, ভয়-সংকোচ, আস্থাহীনতা সর্বোপরি দীর্ঘসূত্রিতা। সত্যি বলতে কী, এহেন ক্ষতিকর আবেগগুলোই আমাদের বড় প্রতিযোগী। আমরা এদেরকে প্রতিযোগিতায় হারাতে পারি না। আসলে আমরা প্রথমেই পরাজিত হই  নিজের কাছে। সামান্য বাঁধা পেলেই ভাগ্যের দোহাই দিয়ে থেমে যাই। হতোদ্যম হয়ে ব্যর্থতাকে মেনে নিই। নিজের ভেতরের শক্তিকে, বিশ্বাসকে জাগ্রত করি না। তখনি লোভ, ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতার মতো নিকৃষ্ট ক্ষতিকর নেতিবাচক আবেগগুলোই আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা তাদের দখলে চলে যাই। আসলে এই নেতিবাচক দুষ্টু কীটগুলোকে পরাজিত করতে পারলেই আমাদের “আত্মবিশ্বাস” নামক অস্ত্রটা শাণিত হবে। আসল প্রতিযোগিতা এটাই। নিজের নেতিবাচক আবেগের সাথে প্রতিযোগিতা। আসলে আমাদের নিজেদের প্রবৃত্তি, কিংবা নেতিবাচক আবেগই আমাদের শত্রু।  মূলত এ সকল শত্রুর সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারলেই আমরা কুপ্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে সফলকাম হতে পারব। আর নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখার মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে কুপ্রবৃত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া। তাহলে অসুস্থ প্রতিযোগিতার লাগামহীন মোহ আমাদেরকে আর কাবু করতে পারবে না। জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে এর বিকল্প কিছু নেই। আসুন, অসুস্থ প্রতিযোগিতার লাগামহীন পাগলা ঘোড়াটাকে লাগাম টেনে ধরি। সুস্থভাবে, সুস্থচিত্তে বাঁচার জন্য নিজের দক্ষতার ওপর, নিজের কর্মের ওপর আস্থা রাখি। আর এগিয়ে যাই আত্মবিশ্বাস নামক হাতিয়ারটাকে পুঁজি করে। আর নিজের গুণগুলোকে বিকশিত করার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বলি – আমিও পারি, আমি পারব। আমার মতো আমি হবো। নিজের ভাগ্য নিজে গড়ব। দেশ গড়ায় অবদান রাখব।

পিয়ারা বেগম
কবি কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments