
অনেকের মতো আমার নাটক করার ইচ্ছে হলো। পাড়ার সংগঠনের সাথে নাটক করেছি, স্কুলে পড়ার সময় নিজেরা দল বানিয়ে স্কুলের বেঞ্চ দিয়ে মঞ্চ বানিয়ে নাটক করেছি, কিন্তু মন ভরেনি। সবাই দেখি নাটকের একটি প্রদর্শনী করে। সারা মাস রিহার্সাল করে শুধু একটি শো? আমার কাছে মনে হতো – সবাই তো তাদের জন্মদিন একবার করে না। তাহলে নাটকের শো একটি হবে কেন? বড়ো ভাইয়েরা বলতো, ‘নাটক করা অনেক ঝক্কি ঝামেলা। সবাই তো রিহার্সাল করবে না। দর্শক আসবে না।’
আমি বুঝতাম না। দর্শক কেন আসবে না ? আমিতো ‘রংবাজ’ সিনেমা সাতবার দেখেছি। আমাদের নাটক যদি ভাল হয় তাহলে তো মানুষ বার বার দেখতে আসবে।
আরেক ভাই টিপ্পনী কাটে, ‘তুমি তো আর নায়ক রাজ রাজ্জাক না – যে তোমারে বার বার দেখতে আসবো। ‘
আমি ধরেই নিলাম – সারা মাস রিহার্সাল করে একটি শো করবো। তারপর সারাবছর বন্ধু বান্ধবদের কাছে নাটক করার ‘ফুটানি ‘ দেখাবো।
আর এই ফুটানি শুরু হতো সেই নাটকের দিন থেকে। যেমন নাটকের মেকআপ নিয়ে নাটক শুরুর আগেই একটু বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে দেখা করতাম, মঞ্চের পর্দা ফাঁক করে নিজের চেহারা একটু দেখিয়ে আবার টুপ করে ভিতরে চলে যেতাম, নাটকের বিরতির সময় অযথাই বাইরে এসে বন্ধুদের সাথে কথা বলতাম। এগুলো সবই ছিল ওই ‘নাটক করার ফুটানি। ‘
কিন্তু তারপরও মন ভরলো না।
এবার গ্রুপ থিয়েটার এ যোগ দিলাম। আমার দল হল ‘ঢাকা পদাতিক।’
এখানে এসে আমার ‘নাটক করার ফুটানি ‘ দুদিনেই উড়ে গেল। প্রতিদিন রিহার্সাল, আর ওটা শুরু হবে ঠিক সময় মতো। এক মিনিট আগেই নয়, এক মিনিট পরেও নয়। আরও দেখলাম নাটকের টিকেট কেনার জন্য কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না । পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে আমরা সোজা মহিলা সমিতিতে গিয়ে প্রস্তুত । দর্শক তো লাইন ধরে টিকেট কেটে নাটক দেখত । অনেক নাটক ছিল – যেগুলোর টিকেট শো’র কয়েকদিন আগেই শেষ হয়ে যেত। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার দর্শকদের বেঁধে ফেলেছিলো অসাধারণ কিছু নাটক দিয়ে। আমরা দেখলাম ‘মিলনায়তন পূর্ণ ‘সাইনবোর্ড। মহিলা সমিতির মঞ্চে ওই সাইনটি দেখলে মনে পুলক ছড়িয়ে যেত। আর দর্শক ভরা মঞ্চে অভিনয় করার সময় সবাই টের পেতাম শরীরে যেন ভিন্ন রক্তের উষ্ণতা।
প্রবাসে নাটক করার অনেক ঝক্কি। প্রথম ধাক্কা হচ্ছে – দুরত্ব। এক মাথা থেকে আরেক মাথা উড়ে গিয়ে তবে রিহার্সাল করতে হবে। তারপর সময় নিয়ে তো এক লম্বা হিসাব করতে হয়। স্ক্যাইপ, ফোন যদিও বড় বন্ধু হয়ে সাহায্য করে। কিন্তু দর্শক ধরে আনার উপায় কি? বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের নাটক দেখার কথা বলি। ওরাও আগ্রহ দেখায়। কিন্তু একদিন পরেই বলে, ‘আহা। এবার তো দেখতে পারব না। প্রায়র কমিটমেন্ট’। দর্শকদের কাছ থেকে সময় বের করা তো এক মহা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমি আরো কয়েকজন সংস্কৃতি চর্চ্চার সুহৃদকে জিজ্ঞেস করি। তাদেরও ওই একই অভিজ্ঞতা। আমাকে সেদিন এক পত্রিকার সম্পাদক জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রবাসে নাটক করার সবচেয়ে বড় বাধা কি?’
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার কি মনে হয় ?’
উনি আমাকে লম্বা লিস্টি দিলেন,’নাটকের স্ক্রিপ্ট, অভিনেতা-অভিনেত্রী, রিহার্সাল করার জায়গা, সময় এবং নাটকের খরচ। কি আপনার লিস্টের সাথে মিললো?’
আমি উনাকে হতাশ করে বললাম, ‘না। আমার লিস্টে এগুলোর একটাও নেই। ‘
উনি আড় চোখে তাকালেন, ‘আপনার লিস্টে কয়টা আছে ?’
– একটা।
-মানে ?
– প্রবাসে নাটক করার সবচেয়ে বড় বাঁধা একটি।
– সেটা কি বলেন তো ?
আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘দাওয়াত। কোলেস্টরেল বাড়ানোর দাওয়াত। ‘
সম্পাদক সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘এই কথা আগেও শুনেছি। তবে খারাপ বলেন নি। ‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মাসে আপনার কয়টা দাওয়াত আছে ?’
উনি গুনে বললেন, ‘চার সপ্তাহে নয়টি। লাঞ্চ, ডিনার এবং একটি ব্রেকফাস্ট। ‘
আমি দুষ্টামি করে বলি, ‘তাহলে আপনাকে তো আর আমাদের পরের প্রদর্শনীতে পাচ্ছি না। ‘
উনি একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ না রে ভাই। জন্মদিন আর বিবাহ বার্ষিকীর দাওয়াত। একটাও ক্যানসেল করতে পারবো না। অনেক আগে থেকে বুক। ‘
আমি আলোচনা একটু এগিয়ে নেই, ‘এই জন্মদিন এই বার মিস করলেও আগামী বার তো যেতে পারবেন। কিন্তু আমাদের নাটকটি তো আর আগামী বছর হবে না। একবার চেষ্টা করে দেখবেন – বন্ধুকে শুধু শুভেচ্ছা পাঠিয়ে নাটকে আসতে পারেন কিনা?’
উনি এবার বেশ অপ্রস্তুত হলেন, ‘না ভাই। ভাল দেখায় না। ‘
আমিও এবার হেসে বললাম, ‘দেখলেন তো। আমাদের নাটক তৈরি অথচ আপনাকে পাচ্ছি না। কারণ দাওয়াত আপনাকে আটকে ফেলেছে।’
উনি আবার ও হো হো করে হাসলেন, ‘ভালই জেরা করলেন রে ভাই। কিন্তু একটা কথা বলেন নাই। দাওয়াতে কোলেস্টরেল বাড়ে। আপনার নাটক দেখলে মনে আনন্দ বাড়ে। ‘
আমার এক বন্ধু বলে, ‘চলো মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়া নাটক কইরা দিয়া আসি’।
কিন্তু এর বাইরেও অন্য রকম গল্প আছে।
‘লীভ মি এলোন’ নাটকের কিছু দর্শকের গল্প বলি।
এই নাটকটি আমরা ১৬ বছর আগে করেছিলাম। সিডনি, ক্যানবেরা এবং মেলবোর্ন সহ মোট প্রদর্শনী হয়েছিল ৫ টি। আর নতুন করে তৈরি করার পর এখন পর্যন্ত করেছি ৩টি প্রদর্শনী।
গামা ভাই আমাদের একজন নিবেদিত দর্শক। উনি এই নাটক ছয়বার দেখেছেন। গত শো তে অসুস্থতার কারণে আসতে পারেনি। কিন্তু আমাদের জানিয়েছেন। সুতপা বড়ুয়া, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ষোলো বছর আগে দেখছেন এবং সে সেদিনও আবার দেখে গেলেন। অজয় দাশগুপ্ত খুব ভাল লেখেন। ষোলো বছর আগে কতবার দেখেছিলেন জানি না। কিন্তু এবার এসে দেখে গেছেন। শুধু তাই না। এবার সস্ত্রীক আবারও দেখার প্ল্যান করেছেন।
শাখায়াত নয়ন একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তিনি বললেন, ‘এই নাটকটি যতবার এই মঞ্চে হবে আমি দেখতে আসবো।’ এবার সিমির কথা বলি। উনি বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালিখি করেন। উনি এক মাসের ব্যবধানে নাটকটি দুবার দেখেছেন। হয়তো প্রথমবার দেখে মন ভরেনি।
সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ঘটনা হয়েছিল গত ১৫ই নভেম্বর। সিডনিতে ভীষণ ঝড় হয়েছে। আকাশ মেঘে ভরা। তারপর এক সংলাপ পিয়াসী দম্পতি নাটক দেখার জন্য ওয়ালী পার্কে গিয়েছেন। উনারা এই নাটক ষোলো বছর আগেও দেখেছিলেন। গাড়ি থেকে নামতেই ঝুম বৃষ্টি। উনারা পার্কের মাঝখানে একটি পাবলিক টয়লেট দেখলেন। ভাবলেন ওখানে গিয়ে একটু অপেক্ষা করবে। বৃষ্টি কমলেই দু মিনিটের হাটা পথ। তারপর মূল মিলনায়তন। এই যুগল যখন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিলেন তখন এক প্রচন্ড শব্দে বাঁজ পড়লো ওই টয়লেটের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা গাছে। বেচারি লম্বা গাছ উপড়ে পড়লো সেই টয়লেটের উপর। ভেঙে গেল পিলার।ভিতরে সেই দুজন তখন সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন এই শেষ। তারপর কিছু না ভেবেই সোজা দৌড় দিয়ে গাড়িতে উঠে ভিজা কাপড় নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। বাড়ি ফিরে দুজনেই ভীত এবং আতংকিত সময় কাটালেন। আমাদের ফেসবুকে ঘটনাটি জানালেন। কিন্তু আনন্দের বিষয় হলো উনারা আমাদের পরবর্তী শো কবে সেটা জানতে ভুল করলেন না। কারণ উনারা আবার আসবেন।

লীভ মি এলোন’র দুটি শো ১৯ এবং ২০ জানুয়ারি
এমন আরও অনেকেই আছেন যারা নাটকটি আগে দেখেছেন। তারপরও আবার আসবেন। মঞ্চ নাটক অনেকবার দেখা যায় । কারন মঞ্চ নাটকের প্রতিটি প্রদর্শনী ভিন্ন । সংলাপ, আলো আর মানুষগুলো এক হলেও, অভিনেতাদের মন আর মনন তো প্রতিদিন এক নয়। তাই আবেগ বদলায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে। আমরা শাণিত হয়ে আপনাদের কাছে আসি। নাটকে কোন ভুল চোখে পড়লে আমাদের মনে করিয়ে দিবেন আগামী প্রদর্শনীতে যেন ওগুলো শুধরে নেই । নতুবা আমরা আরও ভাল কাজ করবো কি করে?
দর্শকদের ভালবাসা আমাদের বার বার মঞ্চে ফিরিয়ে আনে। নাট্যকর্মীদের কাছে দর্শক হচ্ছে দেবতা। আর সেই দেবতাকে শ্রেষ্ঠ প্রসাদ দিয়ে তুষ্ট করার সেকি প্রাণপণ চেষ্টা চলে আমাদের ওই মঞ্চের আলো -আঁধারিতে। আমাদের দেবতারা পাশে থাকলে প্রবাসে শুদ্ধ ধারার নাট্যচর্চা সবুজ হয়ে উঠবে।
জন মার্টিন
অভিনেতা, নাট্যকার,
নির্দেশক, মনোবিজ্ঞানী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।