
প্রথম পর্বের পর:
এর মধ্যেই আবার ফোনের ঝড় বয়ে যায় মূনিরের কাছে। অনেকে প্রকাশ্যে কান্না করে কি করবে এই অবস্থায় তা জানতে। আমি নিজে তাদের টেক্সট দেই যে হাই কমিশনে ইমেল করে যেতে যে এই রকম একটা অবস্থায় তাদের সময় দিতে হবে কারণ বেশ কিছু জায়গা লকডাউনের আওতায়ও ছিল। কেউ কেউ ঢাকার বাইরে ছিল। কয়েকজন ইমেইলের উত্তর পেয়ে আবার আমাকে জানায় যে হাইকমিশন বলে দিয়েছে তাদের কিছু করার নেই। আমি বলি আবার ইমেইল দিতে বার বার ইমেইল করতে এবং খুশীর কথা যে এত এত ইমেল পেয়ে তাদের সময় প্রদান করা হয়েছে আর তারা টাকা জমা দিতে পেরেছে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পরেও।
আমি নিজেও দুবার ইমেল করেছি সবার জন্য যেন তাদের সময় দেয়া হয় টাকা জমা দেবার, তারা সত্যি ফিরে যেতে উন্মুখ এবং ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা খুব অস্থির আছে।
যাই হোক বহু বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২৯০ জন টাকা জমা দিতে সক্ষম হয় হাইকমিশন সময় বাড়িয়ে দিলে।তারপর এলো সেই দিন ১৬ এপ্রিল। আমাদের বলা হয়েছে ৫ ঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। গাড়ীর জন্য পাস প্রদান করা হয়েছে যাতে যাত্রীদের নামিয়ে যাবার সময় ড্রাইভারদের বা আত্মীয়দের কোন সমস্যা না হয়।
আমাদের জন্য মূনিরের বন্ধু বাবু ভায়ের গাড়ী তৈরি ছিল কিন্তু এর মধ্যে আমার খুব ভাল বন্ধু আদিত্য নজরুল ফোন করে খবর নিতে যে , এয়ারপোর্টে কি ভাবে যাচ্ছি, সে তার দফতরের গাড়ী নিয়ে যেতে বলল কারন টেলিভিশনের গাড়ীতে হয়ত তেমন কোন সমস্যা হবে না যা প্রাইভেট গাড়ীতে হতেও পারে।
আমরা সময় মতই এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। বিশাল লম্বা লাইনের বহর পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশের পর চেক ইন কাউন্টার থেকে জানায় আমাদের জমজম পানির প্যাকেট নেয়া যাবেনা!
মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হয় কারণ পবিত্র পানির দুটো বোতল নিয়ে এসেছি ওমরাহ করে আসার সময় যার একটার (৫ লিটার) পুরোটাই দেশে আত্মীয় আর বন্ধুদের দিয়েছি আর একটা বোতল নিয়ে যেতে চেয়েছি আমার বাচ্চাদের জন্য সেটাও নিতে দেবেনা!
ভাগ্য ভাল হলে যা হয় আদিত্যর জি টিভির গাড়ীর ড্রাইভার লিটন আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলেছে সে অপেক্ষা করবে যদি কিছু লাগে বা সমস্যা হয়। সাথে সাথে লিটনকে ফোন দেই সে বলে কোন সমস্যা নাই সে আছে কার পার্কে কি এক স্বস্তির হাল্কা নিশ্বাস বুকের ভেতরে বয়ে যায় কারণ লিটন না থাকলে আমাকে এই পানি ফেলে দিয়ে যেতে হোত আর তা হলে নিজের ভেতরে কেমন এক অপরাধবোধ আর অনুশোচনা কুরে কুরে খেয়ে ফেলত আমায় বাকি জীবনটা কারণ কত জন পায়না এই পানি, কত জন খোঁজে কই পাওয়া যায় জম জমের পানি, আর আমি নিজে আল্লাহর ঘর থেকে নিয়ে এসেও ফেলে দিয়ে যেতে বাধ্য হবো! আল্লাহ সত্যি মহান এবং তিনি আমার সাথে আছেন।
ঢাকা এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গেল ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার এর সাথে তিনি ক্যানবেরিয়ান মূনির কে দেখে খুব খুশি হয়েছেন মূনির কে চেনেন আগে থেকেই। কতটা দায়িত্ববান হলে মানুষ এই রকম সময়ে এই পদক্ষেপ নিতে পারে ভাবলাই মন ভরে যায় শ্রদ্ধায় ভালবাসায়। আমার জমজমের পানি অধ্যায়ের জন্যও হাইকিমশনার খুব আফসোস করলো আর বলল তুমি ভাগ্যবান ড্রাইভার আছে তার হাতে দিয়ে দাও। আমি যখন পানির বাক্সটা ড্রাইভারের কাছে দিতে গেলাম তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।আমাদের দেশে কি কোনদিন এমন বোধ সম্পন্ন মানুষ হবে- আদৌ কোন দিন!
দেখা হয়েছে পররাস্ট্র সচিব মাসুদ মোমেন ভায়ের সাথে তিনিও অনুপ্রাণিত হয়েছেন হাই কমিশনারের দ্বারাই কারণ মোমেন ভাই নিজেই বললেন যে তিনি তো ঘরেই বসে থাকতেন কিন্তু যখন জেনেছেন হাইকমিশনার আসছেন তিনিও এসেছেন। স্যালুট মোমেন ভাইকে আমাদের যে এই রকম হাজারো মোমেন ভাই খুব দরকার। খুব আন্তরিক একজন মানুষ মোমেন ভাই আর আমার ভাই আকবর হায়দার কিরনের খুব কাছের ছিলেন নিউইয়র্কে থাকার সময়ে।
মোমেন ভাই মোবাইলে কিরন ভায়ের ছবি দেখালেন সম্প্রতি কিরন ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল গেলে সেই ছবিও দেখালেন। খুব ভাল লাগল। মোমেন ভায়ের জন্য এত্ত শুভকামনা।
শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্স আমাদের নিয়ে যথা সময়ে উড়ে চলল। মাঝে কলম্বোতে একঘন্টার বিরতিতে তারা ক্রু বদলায়, বিমানের ফুয়েল ভরে নেয় আর খাবার নিয়ে নেয়।
পুরো বিমান একেবারে ভর্তি ছিল। প্রচুর বাচ্চা থাকায় তাদের অস্থির কান্নার শব্দ কানে ঝংকার তুলেছে সারাটা সময়ই। অবাক হয়ে শুনেছি আর বুঝেছি কান্নার ধরন আর শব্দ কতটা আলাদা বাচ্চা ভেদে। এক এক জনের কান্না এক এক রকম। এক এক শব্দের এবং সুরের।

দীর্ঘ প্রায় ১২/১৩ ঘন্টা পর মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে নামতেই আমাদের বলা হোল সোশ্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখতে, খুব হাসি পেয়ে গেলে তাদের বলেই বসলাম, দেখ এই আমরা প্রায় ১৩ ঘন্টা এইই বিমানে গাদাগাদি করে বসে এসেছি কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত সবাই এক সাথেই ছিলাম।
এয়ারপোর্ট অফিসারদের মাঝেও হাসির হিল্লোল বয়ে গেল তারাও বলল সত্যি তাই, কিন্তু এখন তো তোমরা বিমানের বাইরে এখন থেকে এটা মেনে চলতে হবে তোমাদের সবার ভালর জন্যই।
সত্যি তাই আমাদের ভালর জন্য এই দেশ এই জাতি কি অমানবিক পরিশ্রম করে যাচ্ছে তা যারা দেখবে না বা জানবে না তাদের বুঝার বাইরে।
সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সেরে কাগজ পত্রের যাবতীয় যথাযথ পূরণের পর আমাদের নেয়া হয়েছে বিমানবন্দরের পেছেনের গেট দিয়ে একেবারে রানওয়ের কাছে অপেক্ষারত বাসের কাছে আর এক এক বাসে ১৫/১৮ জন করে নিয়ে রওনা দিলাম আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হোটেলের দিকে।
সেই মুহূর্তে আল্লাহকে মনে মনে হাজার হাজার ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ ভিজে একাকার হলেও মনে হয়েছে বুঝি রাণীর গাড়ীর বহর চলেছে বাসের আদলে কারণ আগে পিছে পুলিশের সিকিউরিটির গাড়ীর পাহারায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হোটেলে।
১৪ দিন আমাদের কোরান্টাইন দিন। ১৪ দিন এইখানে থাকতে হবে। ঘরের বাইরেও সিকিউরিটির পাহারা বাইরে বেরুলেই বিশাল অংকের ফাইন দিতে হবে। আমাদের দুজনের যাবতীয় ওষুধ আমাদের হোটেলের ঘরে পৌঁছে যায় আগে থেকে আমাদের কাছে জেনে নিয়ে।
১৪ দিনের আগে দেখা হবেনা কারোরই স্বজনদের সাথে। তবুও কি এক শান্তির ঝর্ণা তিরতির বয়ে যায় চোখের ভেতরে আর বুকের গভীরে। এক জীবনে দুই জীবনের স্বাদ সত্যি অভূতপূর্ব এবং অলৌকিক হিরণ্ময় আলোতে মোড়ানো।
শেষ।
আইভি রহমান
নভোটেল হোটেল, সাউথ ওয়ারফ মেলবোর্ন।
২৩ এপ্রিল ২০২০।