১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবির প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আজ আমরা জানবো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড সম্পর্কে। অস্ট্রেলিয়ায় এই বীর যোদ্ধার জীবদ্দশায় কথা বলেছিলেন লেখক ও কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত।
অজয় দাশগুপ্ত: ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে অভিবাসন নিয়ে সিডনি আসি। পরের একবছর ছিলো থিতু হওয়ার বছর। ‘৯৮ সালে তাঁর ফোন নাম্বার খুঁজে যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করি। তিনি তখন রোগশয্যায়, জীবনের শেষ প্রান্তে।বারবার ফোন করায় বিরক্ত স্ত্রী আমাকে সাফ সাফ জানিয়েছিলেন এই সময় তাঁর উত্তেজিত হওয়া বারণ। বিনয়ের সাথে বললাম, আমি কেন উত্তেজিত করবো? শুধু শ্রদ্ধা জানাবো আর তাঁর সাথে কথা বলার স্মৃতি আজীবন বুকের কৌটায় বয়ে বেড়াবো। তাঁর স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ভদ্রলোক বাংলাদেশের নাম শুনলেই উত্তেজিত ও স্পর্শকাতর হয়ে পড়েন।
পরে কি করে যেন স্ত্রীর মন গলেছিল। সুযোগ পেয়েছিলাম কথা বলার। এখন আফসোস হয় কেন তখন তাঁকে গিয়ে দেখে আসলাম না। সিডনি থেকে পার্থ প্রায় সিঙ্গাপুর যাত্রা। তাই পারিনি সে সময়।
যারা মুক্তিযুদ্ধকে হালকা ভাবে দেখেন, ইতিহাস নিয়ে ঝগড়া করেন ইনি একাই তাঁদের উত্তর। একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক। যিনি নিজে বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন। সে কৌশল শিখাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এমনকি জানবাজী রেখে সমুখ সমরেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
আজ ৬ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। বাটা কোম্পানীতে চাকুরী করতে যাওয়া বাংলাদেশের অকুতোভয় এই বীরকে প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই। কে মনে রাখে কে রাখেনা তার অনেক ওপরে এই আকাশের তারা ডাব্লু এস ওডারল্যান্ড।
এক নজরে বীর প্রতীক ওড্যারল্যান্ড
জন্ম: ৬ ডিসেম্বর ১৯১৭, আমস্টার্ডাম, নেদারল্যান্ড। তিনি ১৭ বছর বয়সে পড়ালেখা শেষ করে বাটা কোম্পানিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান: ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের নামে গণহত্যার ভয়াবহতার কিছু ছবি তুলে পাঠান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তৎকালীন বহুজাতিক বাটা সু কোম্পানীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তাঁর অবাধ চলাচল ছিল সর্বত্র। সেই সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করেননি, সম্পর্ক গড়ে তোলেন টিক্কা খান, রাও ফারমান আলী, নিয়াজিদের সাথে। অন্যদিকে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সব তথ্য ফাঁস করে দিতেন।
বাটার শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে টংগীসহ সেক্টর ১ এবং ২ নম্বরে গড়ে তোলা গেরিলা বাহিনীকে নিজ দায়িত্বে প্রশিক্ষণ দেন।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো। তিনি বাঙ্গালী যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। তারপর নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসেন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
স্বীকৃতি: ওডারল্যান্ড একমাত্র বিদেশী বাংলাদেশী যিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” খেতাব পান।
মৃত্যু: ২০০১ সালের ১৮ মে অস্ট্রেলিয়ার পার্থের হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।