আমাদের রূপকথা ! । ফারিনা মাহমুদ

  
    
……..আপনাদের কি সেই ছেলেটার কথা মনে আছে ? যার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর, বামঘেঁষা বিপ্লবী আবেগপ্রবণ আর নিজের আত্মরক্ষার প্রতি একেবারেই উদাসীন সেই ছেলেটা ! ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ছেলেটা মহানন্দা নদী পার হয়ে গেলো। একটি একটি করে শত্রু অবস্থানের দখল নিতে নিতে। জয়ের খুব কাছাকছি পৌঁছে ঘটলো বিপত্তি। বাঁধের উপর থেকে শুরু হলো পাকিস্তান বাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষন। খ্যাপাটে ছেলেটা সহযোদ্ধাদের রেখে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে একাই গেলো সামনে । তারপর, কপালে একটা বুলেটের আঘাত !  ছেলেটা মৃত্যুকে আলিঙ্গল করে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো সতীর্থদের ! পাঠক, মনে না থাকলে জেনে নিন তিনিই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।
২৮ শে অক্টোবর ১৯৭১, ভোর চারটা। শ্রীমঙ্গলের ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি দখল হবে আজ। অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে তখন তিন প্লাটুন মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক । কাছাকাছি আসতেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ, সামনে অগ্রসর হওয়ার কোনো উপায়ই নেই । ঠিক হলো, পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলা করা হবে । গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হলো ১৮ বছর বয়সী এক কিশোরকে। পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে ভর করে একটা একটা করে গ্রেনেডের পিন মুখ দিয়ে খুলে সেই গ্রেনেড ছুঁড়ে হামলা চালায় সেই কিশোর। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই শত্রুর গুলি লাগে সেই কিশোরের দেহে । গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই দুইজন পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করে সে। এক সময় মেশিনগান পোস্টটি অকার্যকর হয় । এই সুযোগে সহযোদ্ধারা সীমানা ফাঁড়িটি দখল করে নেয় আর সবুজ ঘাসের বুকে পড়ে থাকে অকুতোভয় সেই কিশোরের নিথর দেহ ! সূর্যোদয়ের প্রহরে প্রিয় জন্মভূমি বুকে টেনে নেয় আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে !
চলুন এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এন্ডারসন খালের পাড়ে। যেখানে যুদ্ধের সময়  মুক্তিবাহিনী তিনটি ঘাঁটি গড়ে তোলে । পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে এগুতে থাকে। ১৭ই এপ্রিল ভোরবেলা তারা মুক্তিবাহিনীর উপর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে । খানিক্ষন পর সরাসরি আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে । কয়েক জন শহীদ হন। এরই মাঝে একজন অকুতোভয় সৈনিক মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। সতীর্থদের সরে যাবার সুযোগ মেলে তাতে ।  তাঁর ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। এক সময় গুলি শেষ হয়ে গেলে, শত্রুর আঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।  প্রিয় পাঠক, বলছিলাম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল এর কথা । বাংলাদেশীদের জয়ের এক স্তম্ভ হয়ে বেঁচে আছেন এই বীর সন্তান ।
১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১, খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রবেশ করেছে মুক্তিবাহিনীর তিনটি গানবোট। এমন সময় অনেক উচুঁ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে নিচে নেমে এসে তিনটি পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে।‘একটি গানবোটের এর ইঞ্জিন বিধ্বস্ত হয়ে যায় । হতাহত হয় অনেক নাবিক । অধিনায়ক নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। খেপে ওঠে একজন । জীবন বাজি রেখে গুলি ছুঁড়তে থাকে আকাশ পানে। যখন বুঝতে পারে, এ খেলা বড় বেশি অসম, তখন গানবোটের ধ্বংশাবশেষ পেছনে রেখেই রূপসা নদীতে ঝাঁপ দিতে হয় । পাঠক, বলছি বীরশ্রেষ্ঠ  মোহাম্মদ রুহুল আমিনের কথা । প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ যোদ্ধা একসময় পাড়েও এসে পৌছান। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে রাজাকারের দল অপেক্ষা করছে তার জন্য। আহত এই বীর সন্তানকে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে । স্বাক্ষী হয়ে রয় রূপসা নদীর জল ।
১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার, করাচির মাশরুর বিমান ঘাঁটি । আজ শিক্ষানবীশ পাইলট  রশিদ মিনহাজ  প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ জেট ট্রেইনার নিয়ে আকাশে উড়বেন । সব ঠিকঠাক, এমন সময়ে রানওয়ে থেকে হঠাৎ হাতের ইশারায় তাকে বিমানটি থামাতে বলেন সেফটি অফিসার। মিনহাজ বিমান থামিয়ে জানতে চাইলেন কেন তাকে থামতে বলা হলো । সেই সুযোগে সেফটি অফিসার লাফিয়ে ককপিটে উঠে ক্লোরোফর্ম দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে বিমানের দখল নিলেন । কিন্তু অজ্ঞান হবার আগে শেষ মুহূর্তে মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ার কে বলে বসে একটি লাইন – আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড। অজ্ঞান মিনহাজ কে পাশে বসিয়েই বিমান নিয়ে রাডার ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ছুটে চলেন সেই সেফটি অফিসার । মাঝপথে জ্ঞান ফেরে মিনহাজের। আকাশেই চলে হাতাহাতি ! এক পর্যায়ে মিনহাজ ইজেক্ট সুইচ চাপলে বিমান থেকে ছিটকে পড়েন সেই সেফটি অফিসার । কিছুদূর গিয়ে ভারতীয় সীমান্তে বিদ্ধস্ত হয় বিমানটি।  পাঠক, নিশ্চই বুঝে গেছেন, বলছি বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এর কথা । এই ঘটনায় মিনহাজকেও পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব দান করে। একই ঘটনায় দুই বিপরীত ভূমিকার জন্য দুইজনকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব প্রদানের এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল ।
সাত বীরশ্রেষ্ঠ।
যে রাঙামাটির রঙে আমাদের চোখ জুড়ায় মন ভরে ওঠে, পাঠক চলুন এবার সেই রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথে ।  ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাতটি স্পীড বোট এবং দুটি লঞ্চে করে বুড়িঘাট দখলের জন্য মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায় । গোলাবৃষ্টির তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী তখন পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলা মায়ের কোনো এক দামাল ছেলে  রুখে দাঁড়ায় । একদম একাই নিজ বাঙ্কার থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে সে। এই পাল্টা আক্রমণের ফলে শত্রুদের স্পীড বোট গুলো ডুবে যায়। পেছনের দুটো লঞ্চ দ্রুত নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নেয়। তারপর রণকৌশল পাল্টে  সেখান থেকে শুরু করে দুরপাল্লার ভারী গোলাবর্ষণ। মর্টারের ভারী গোলা এসে পরে বাংলা মায়ের সেই দামাল ছেলেটির বুকে। লুটিয়ে পড়ে এই বীরের দেহ, নীরব হয়ে যায় তাঁর মেশিনগান। ততক্ষণে নিরাপদ দূরুত্বে সরে গেছে সঙ্গীরা। পাঠক, বলছি শহীদ ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের কথা।
অল্প বয়সে বাবা মা হারানো ডানপিটে ছেলেটা সপ্তম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করেনি। একসময় সে যোগ দেয় ইপিআর-এ । যশোহর জেলার সুতিপুরে একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোলের অধিনায়ক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় ছেলেটি । ১৯৭১- এর ৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার পেট্রোলটিকে তিনদিকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে । একজন সিপাহী গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ছেলেটি তাকে কাঁধে তুলে নেয় । এরপর আরেক হাত দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে সে । এমন সময় একটি গুলি এসে কাঁধে লাগে । আহত সৈনিক কে আরেকজনের কাছে দিয়ে ছেলেটি গুলি চালাতে থাকে, সুযোগ করে দেয় সতীর্থদের নিরাপদে সরে যাবার।  অন্য সঙ্গীরা বারবার অনুরোধ করলেও তাদের সাথে যায়নি সে । কারণ তাঁকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বে । এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ – মনে পড়ে কি আপনাদের ?
১৪ বছরের কিশোরীটি যুদ্ধের সময় কচুর মুখী তুলছিলো । এমন সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাকে প্রস্তাব দেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ভাত রান্না করে দেবার । কিশোরীটি ভাত রান্না করেই ক্ষান্ত হলো না, সুযোগের সদ্বব্যবহার করলো অস্ত্র চালনা শিখে । তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধই শুধু নয়, পাগলীর বেশে গুপ্তচরবৃত্তিও করেছে সে ! জি পাঠক, বলছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরপ্রতীক  তারামন বিবির কথা । ২০১৮ সালে রংপুরের কুড়িগ্রামে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । এ মাটির বুকেই চির ঠাঁই হয়েছে এই বীর মুক্তিসেনার ।
আমার বন্ধু ছুটি ১৬ বছর বয়সে জীবনে প্রথম বার প্রেমে পড়েছিলো একজন মায়ের মুখে তার ছেলের গল্প শুনে । উথাল পাথাল প্রেম । সেই ছেলেটির চলাফেরা, বন্ধু, প্রিয় খাবার, প্রিয় গান সব তথ্য জোগাড় করা শেষে শুরু হলো তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করা । একদিন সুযোগ মতো বাসায় ঢুকতে গিয়েও আমার বন্ধুটি ঢুকলো না, তীব্র কান্না চেপে ছুটে বের হয়ে এসেছিলো সে, কারণ মানুষটি যে অনেক আগেই চলে গেছে না ফেরার দেশে । যাবার আগে বলে গেছে – যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাবো না!  পাঠক, কার প্রেমেই বা এভাবে পড়া সম্ভব বলেন তো ?  জ্বি বলছি পাকিস্তান বাহিনীর ত্রাস সেই গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন এর এক সদস্যের কথা । আর আমার বন্ধুর সেই একতরফা প্রেম হয়ে গিয়েছিলো এই দলেরই মেধাবী সুদর্শন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমীর সাথে । ৭১ এর ৩০ সে আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা আসলে অবধারিত ভাবেই চলে আসে অস্ট্রেলিয়ার কথা । পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডই বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়, ২৬শে জানুয়ারী ১৯৭২ সালে। তার আগে, স্বাধীনতা ঘোষনার প্রাক্কালে, ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় এবিসি’র আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া’ ছিল প্রথম বিদেশী মিডিয়া যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচারিত হয় এবং তার ফলে সারা বিশ্ব সেটা জানতে পারে।  মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদান রাখেন তৎকালীন বাটা সু কোম্পানীর সি ই ও অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক উইলিয়াম এ এস আউডারল্যান্ড । তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন কমান্ডো । সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি ঢাকার বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশনে ভূমিকা রাখেন । ২৫ সে মার্চের গণহত্যার ছবি তিনি পাঠান বেশ কিছু মিডিয়ায় । পাকিস্তানী জেনারেলদের সাথে কৌশলে বন্ধুত্ব করে পুরোটা সময় তিনি তথ্য দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তিনি  আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক ।
যুদ্ধের নানা বীরগাঁথায় অনেক সময়ই হারিয়ে যায় আমাদের বীরাঙ্গনাদের কথা । অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিস যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে ছুটে বেড়িয়েছেন বীরাঙ্গনাদের সহায়তায়। ক্যাম্পে বন্দী অগুনিত  বীরাঙ্গনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেছেন তিনি । ওনার সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অকাট্যি দলিল । ওনার ভাষ্যমতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে শুধু ঢাকা শহরেই গড়ে ১৫০ জনের গর্ভপাত করাতেন তিনি  প্রতিদিন। আজ আমরা আমাদের বীরাঙ্গনাদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেইসাথে  শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ড’ ডেভিস কে । (বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন : https://sovyota.com/?p=4886
শহরের ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে তার জন্ম । কিন্তু সেই ঘর ছেড়ে সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে আসেন তার মা ।  খুব আগলে রেখে বড় করেছিলেন তাকে।  ঢাকা বিশ্বদিব্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সুদর্শন তুখোড় ছেলের দিকে তাকিয়ে মা বুঝি ভেবেছিলেন, তার কষ্টের দিন শেষ হলো বলে ! লাল টুকটুকে একটা বৌ ঘরে এনে মা’র বুঝি মিলবে একটু অবসর!  না পাঠক, অবসর মেলেনি শহীদ  মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ এর মা সাফিয়া বেগম এর । ৭১ এর ৩০ সে আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুন এর অন্যান্য যোদ্ধাদের সাথে আজাদকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী । ছেলের খোঁজে পাগলপ্রায় মা ছুটে  যান জেলে । ছেলে একটু ভাত খেতে চেয়েছিলো । সেই ভাত নিয়ে গিয়ে পরদিন আর আজাদকে খুঁজে পান নি । জীবনের পরবর্তী ১৪ টি বছর ভাত না খেয়ে কাটিয়েছেন বাংলার এই মা !
১৯ সে আগস্ট  ১৯৭১,  সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্র্যাকপ্লাটুনের সদস্যরা । নৌকায় যাত্রা করার পর বেশ কিছুদূর গিয়ে একেবারে মুখোমুখি গুলি বিনিময় হলো পাকিস্তান বাহিনীর সাথে । দলের সদস্য তুখোড় ক্রিকেটার জুয়েল হঠাৎ অন্ধকার থেকে বলে উঠলেন, “ওই আমার হাতে যেন কী হইছে!” টর্চের আলোয়  দেখা গেল, পাক হানাদারদের ছোঁড়া গুলি জুয়েলের আঙুল ভেদ করে চলে গেছে। সেই অবস্থাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ডা.  এর চেম্বারে। যাওয়ার পথে সহযোদ্ধা আজাদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “জুয়েল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না?” মুখে একচিলতে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে জুয়েল বলেছিলেন, “নাহ, হেভি আরাম লাগতেছে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়াও হইলো, আবার জানটাও বাঁচলো।” অভিজ্ঞ ডাক্তার আজুয়েলের হাতের অবস্থা দেখে সেদিন চমকে উঠেছিলেন। আঙুলের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিলো না কোনোমতেই।  জুয়েল দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলছিলেন, “প্লিজ স্যার, আমার আঙুল তিনটা রাইখেন। দেশ স্বাধীন হলে আমি ওপেনিং নামবো, স্বাধীন বাংলার ক্যাপ্টেন হবো।” না জুয়েলের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি । সহযোদ্ধাদের সাথে তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৩০ সে আগস্ট ।
….. গল্প কাহিনীতে শুনেছি , অপঘাতে মৃত বা আত্মহত্যা করা মানুষের আত্মার নাকি সদগতি হয়না । সেই আত্মা বারবার ফিরে আসে প্রিয়জনদের কাছে । সেই ফিরে আসার স্মৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভয়াল রূপ নেয় এবং আচার অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে সেই প্রেতাত্মাকে তৃপ্ত করে ফিরিয়ে দিতে হয় ।
এই প্রেতাত্মাগুলো কেন ফিরে আসে ? আসে কোনো একটা ভুলকে শুদ্ধ করতে । কোনো একটা অনিয়ম অনাচারের বিহীত করতে । সেই অন্যায়কে ন্যায় এ রূপ দিতে তারা দ্বারে দ্বারে ঘোরে … মিনতি করে, কখনো হিংস্র হয় কখনো তার শত্রুকে শিক্ষা দেয় আজীবনের মতো । স্বর্গ বা মর্তলোক তাদের গ্রহণ করে না .. তারা এর মাঝামাঝি জায়গায় বিচরণ করতে থাকে একটি অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে … হয়ার ডু আই বিলং ? ?
গোটা মর্তলোকে প্রেতাত্মার কষ্ট যদি কেউ খানিকটা বুঝতে পারে, তো তারা হলো সেই জনগোষ্ঠী যারা অস্তিত্বের জন্য, পরিচয়ের জন্য, স্বীকৃতির জন্য, ভূখন্ডের জন্য লড়াই করে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম, একটি মাত্র প্রশ্নকে সামনে রেখে
– হয়ার ডু আই বিলং ?
এবং একটি মাত্র উত্তর কে প্রতিষ্ঠা করতে – দিস ইস মাই ন্যাশনালিটি ..!
মাওয়াবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগার কিংবা গাজার যুদ্ধ এলাকায় জন্ম নেয়া শিশুরা বুলেটের খোসা দিয়ে খেলা করে, এ কে ৪৭ এর বাঁট দিয়ে গরুর পিঠে বাড়ি দেয় । বাবা, দাদা, পরদাদার মতো সেও ভোগে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে .. সেও লেগো খেলার বয়সে বুঝে যায় রাজনীতি … শিখে যায় সারভাইব্যাল ব্যাসিক । সে জেনে যায়, তার জন্ম হয়েছে দাবার গুটি হিসেবে, প্রাণপণে সংগ্রাম করে চলে সে গুটি থেকে খেলোয়াড় হয়ে ওঠার। আবার তাকিয়ে দেখুন রোহিঙ্গা মুসলমানদের দিকে ……নদী সাগর পাহাড় সীমান্তরক্ষীর চোখ কতকিছু পেরিয়ে জীবন বাজি রেখে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে একটি পাসপোর্ট এর আশায় কেননা তার জন্ম ভূখন্ড তার কোনো দায় দায়িত্ব নিতে নারাজ । এথনিক ক্লিঞ্জিং এর শিকার হয় নিজ জন্মভূমে।  আমরা গাল দেই, ফিরিয়ে দেই … কখনো ঠাই দেই মানবেতর কোনো শরণার্থী শিবিরে …. তবুও তারা আসতে থাকে … ভাসতে থাকে … পরিচয়ের আশায় … শুধুমাত্র একটি প্রশ্নকে সামনে রেখে
– হয়ার ডু আই বিলং ?
এবং একটি মাত্র উত্তর কে প্রতিষ্ঠা করতে – দিস ইস মাই ন্যাশনালিটি ..!
রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ের ভিডিওতে মাঝে মাঝে ছেয়ে যায় ফেসবুক। প্রতিটা মানুষের চোখে ভয় আতঙ্ক অস্থিরতা বিষাদ অনুনয় সব কাটিয়ে আমার চোখে যেটা সবার আগে ধরা পড়ে, তা হচ্ছে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস! একবার সি এন এন এর একটা রিপোর্টে বলা হচ্ছিলো রোহিঙ্গা, আ ডিনাইড এথনিসিটি – হু ডাস নট এক্সিস্ট!
মাঝে মাঝে আমি আমার গাঢ় সবুজ রঙের বাংলাদেশী পাসপোর্ট টার  দিকে অপলক থাকিয়ে থাকি।  এই ছোট্ট সবুজ বইটি ছিল বলেই আমার সামনে অস্তিত্বের সংকটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত সেই প্রশ্নটি ছিলোনা – হয়ার ডু আই বিলং ? পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে আমাকে স্বীকৃতি দিতে, আমাকে চিনিয়ে দিতে এই ছোট্ট বইটিই যথেষ্ট । আর এ বইটি আমার হাতে এসেছে আক্ষরিক অর্থে এক নদী রক্ত পেরিয়ে!
তিরিশ লক্ষ মানুষ একজনের উপর আরেকজন দাড়ালেমাউন্ট এভারেস্ট তৈরী হয় …
তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত বইলে তৈরী হয় অতলান্তিক বা প্রশান্তের চেয়ে বড় কোনো জলাধার .. ২ লক্ষ মা বোনের সুতীব্র চিত্কার জগতের সবচেয়ে বড় মহাকাশযানের উড়ে যাওয়ার শব্দের চেয়েও বিভীষণ … !
প্রিয় পাঠক,  রূপকথা শুধু ডিজনিল্যান্ডেই থাকে না । সুপার হিরোরা শুধুই বিগ বাজেটের মুভি ক্যারেক্টার না ! এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড বা ক্যাপ্টেন আমেরিকার গল্পের পাশাপাশি এই গল্পগুলোও বলুন আপনার সন্তানকে । দেশের প্রতি ভালোবাসা এভাবেই আসে , এভাবেই আসবে !
ফারিনা মাহমুদ
প্রদায়ক সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। 
বিজ্ঞাপন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments