স্কুল জীবন থেকেই এই কথাগুলোর সাথে গভীরভাবে একাত্ম হয়ে ছিলাম। তখনো অনুভূতিকে স্পর্শ করছিল। কিন্তু আজ লেখালেখির জগতে এসে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, কোন জাতিই নিজের দেশ, ভাষা এবং সংস্কৃতির মূল্যায়ন না করে বড় হতে পারেনা। ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী এবং শাণিত হাতিয়ার। তাই মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা ছাড়া মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেনা। তাই তো কবি বলেছেন-
“নানা দেশের নানা ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা?”
তাই আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি, মহান ভাষা আন্দোলনের সে সব অকুতোভয় মহান শহীদদের। যাঁরা মরণপণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়। যাঁদের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। যাঁদের জীবনের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। তাই, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবময়, ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় একটি দিন।
কারণ, ভাষার জন্য পৃথিবীর কোথাও কোন আন্দোলন হয়নি। এত রক্ত ঝরানোর কোন ইতিহাসও নেই। এটা মূলত পৃথিবীর ইতিহাসে একটা বিরল ঘটনা। তাই তো বাঙালির রক্তঝরা এ দিনটিকে সারাবিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা,বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতি সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হওয়ার ঘোষণা হয়। এই অনন্য বিশ্বস্বীকৃতি অর্জনে বিশ্বের দেশে দেশে আজ আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাঁথা জানতে পারছে। আর দেশে দেশে সগৌরবে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নাম। বাঙালি জাতি নিজের রক্ত দিয়ে সারা বিশ্বকে শিখিয়ে দিয়ে গেল মাতৃভাষাকে ভালোবাসার মন্ত্র। এটা আমাদের জন্য এক অসাধারণ প্রাপ্তি ও গর্বের বিষয়। তাই তো একুশ আমাদের চেতনায়, আমাদের সত্তায়-আত্মায়, আমাদের বিদ্রোহে, জড়িয়ে আছে। একুশে আরো জড়িয়ে আছে বাঙালির গৌরব ও বেদনার ইতিহাস।
সামনের দিকে সবেগে তীর নিক্ষেপ করতে হলে ধনুকে লাগিয়ে তীরকে আবার খানিকটা পেছনে টেনে ধরতে হয়। তেমনি যদি কোন জাতি সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণ করতে চায়, তবে তাকে আপন ইতিহাস ঐতিহ্য পর্যালোচনা করতে হয়। সুতরাং একুশ সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকেও একটু পেছনে বা অতীতে যেতে হচ্ছে।
আমরা জানি, বাঙালি জাতির রয়েছে এক সমৃদ্ধ-সভ্যতার ইতিহাস ও গৌরবময় অতীত। বাঙালি মূলত বীরের জাতি। বাইরের শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে শতাব্দীরর পর শতাব্দী। তারা নিজেদের দেশ ও জাতি রক্ষায় যুদ্ধ করে শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছে অসংখ্য বার।
তাই তো চতুর বৃটিশরা বুঝতে পেরেছিল, ভারতকে আর অবিভক্ত করে রাখা যাবে না। তাদের হাতিয়ার ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান ধর্মীয় বিরোধ হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাত। এই অস্ত্রটাই তখন তারা ব্যবহার করল। এমন জনস্বার্থববিরোধী সাম্প্রদায়িক বিরোধকে জিঁইয়ে রেখে উসকে দিত তারা। ধর্মের ভিত্তিতে যে কোন জাতি গঠিত হতে পারে না। এমন একটি জলজ্যান্ত সত্যকেও ভুলিয়ে দিয়ে তারা মুসলমান সম্প্রদায়কেই মুসলমান জাতি বানিয়ে তাদের হীন স্বার্থ হাসিল করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। মূলত তথাকথিত মুসলমান জাতি ও হিন্দু জাতিকে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্ব নামক এক ‘হাওয়াই’ তত্ত্ব নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই ‘হাওয়াই তত্ত্বের’ ওপর ভর করেই পাকিস্তান নামক এক অপরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। (তথ্যসূত্রঃ যতীন সরকার – স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, সচিত্র বাংলাদেশ, মার্চ ২০১৫) ।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলমান ধর্মের ভিত্তিতে দ্বি-জাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেন ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের ২৭তম অধিবেশনে। আর এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম নিল। চাবির গোছা হাতে পেয়ে তাদের যেন তর সইছিলনা। ছয় মাস যেতে না যেতেই ১৯৪৮ সালে মার্চেই ঘোষনা দিলেন “একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে। কারণ, তারা বাংলা ভাষাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করত। তাই এর আগে লিয়াকত আলী খানও ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখ বলেছিলেন, পাকিস্তান পরিষদে বক্তৃতা করতে হবে উর্দুতে নয় ইংরেজীতে। এর প্রতিবাদ করেছিলেন পরিষদের বাঙালী সদস্য মান্যবর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি এমন একটি বিধানের সংশোধনী এনে বাংলাকেও সরকারী কাজে ব্যবহারে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে লিয়াকত আলী রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলেছিলেন, “পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষাই হওয়া উচিত।”
এতেই বাঙালি বুঝতে পেরেছিল তাদের ভেতরের হীন উদ্দেশ্য। সেদিন থেকে বাঙালি চিত্তে দ্বিজাতিতত্ত্ব বিরোধী ভাবনার ডালপালা মেলে বিস্তৃতি লাভ করে। এক সময় এই ভাবনা মহীরুহে পরিণত হয়। আর এটার বাস্তব এবং অগ্নিগর্ভ প্রতিফলন ঘটে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। মূলত সেদিন থেকেই বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আপন মাতৃভূমিকে অপরাষ্ট্র পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা ঘটালো।
মাতৃভাষার বায়ান্নর রক্তাক্ত সেই ফেব্রুয়ারি চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতেই একাত্তরের দুনিয়া কাঁপানো সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাঙালি পাকিস্তানের খাঁচা ভেঙ্গে ফেলল, প্রতিষ্ঠা করল স্বাধীন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।’
তাই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বাংলার অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন — “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা আন্দোলনেরই সূদুরপ্রসারী প্রতিশ্রুতি।” ( তথ্যসূত্রঃ এম আর মাহবুব — বাংলা কী করে রাষ্ট্রভাষা হলো?)
সবশেষে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যাঁরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বের দরবারে অমরত্ব লাভ করে গেছেন, শহীদ রফিক, সফিক, সালাম, বরকত ও জব্বার প্রমুখদের। তাঁদের আত্মার চিরশান্তি কামনায় বেহেস্ত নসীব প্রার্থনা করছি। পরিশেষে, গেয়ে চলেছি খ্যাতিমান সাংবাদিক এবং বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং শহীদ সুরকার আলতাফ হোসেন সুরারোপিত সেই রক্তস্রোতে শিহরণ জাগানো কালজয়ী গান —
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?
পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ।