আমার ঈদ আমার উৎসব । অজয় দাশগুপ্ত

  
    

জন্মসূত্রে বাঙালি। বাংলাদেশের সন্তান আমি। ঈদ আমার ও পার্বন। আমাদের শৈশব কৈশোরের বাংলাদেশ আর আজকের দেশটিতে অনেক তফাৎ। ইটের দেয়াল থাকলেও বলতে গেলে একই বাড়ীতে বসবাস করতো হিন্দু মুসলমান। এখনোও করে বৈকি। কিন্তু কেন জানি আজ আর সেই মাধুর্য আর সম্প্রীতি এখন আর নেই। বিশ্বাস অবিশ্বাস সন্দেহ আর সংস্কারের নামে এমন সব বৈরিতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যার জের টানছে বাংলাদেশ । কেমন ছিল আমাদের সময়কাল ? এই যে আজ ঈদের এই লেখাটি লিখছি তখন মনে ভীড় করে আছে অতীতের মধুময় দিনগুলি ।
আমি জন্মেছি চট্টগ্রাম শহরের এনায়েত বাজারের গোয়ালটুলি লেইনে । বাড়ী থকে বেরুলেই এনায়েত. দেলোয়ারদের মুখ দেখি। স্কুলের বন্ধু নূর আহমদ। প্রদীপ আর পিন্টূ জন্মসূত্রে হিন্দু পূজার সময় তাদের সাথে ঘুরিফিরি বটে কিন্তু কোথায় যেন একটা ফারাক ছিল । নূর আহমদ জাকির এরা ছিল আত্মার সাথে জড়িয়ে । মারামারি থেকে আনন্দের দিন সবকিছুতে এরাই ছিল সাথে। ঈদের দিন সবার আগে এদের সাথে খাওয়া দাওয়া করে তারপর ঘুরতে যাওয়া । সে সময়কালে আমরা বুঝতেই শিখি নি কে কোন ধর্মের মানুষ ।
সমাজ আর পরিবেশ কি ধর্ম মানে? না ধর্মের দাস? একটু বড় হতে হতেই আত্মার সাথে নিবিড় হয়ে গেছিল সুফিবাদ। সে ধারা এখনো হৃদয়ে প্রবহমান । চট্টগ্রাম পীর আউলিয়ার শহর। আমরা যেখানে আড্ডা দিয়ে বড় হয়েছি লেখালেখি শিখেছি সে জায়গাটির নাম চেরাগী পাহাড় । ছোট্ট এই টিলাটি এখন সুদৃশ্য মনোরম এক দর্শণীয় স্হান । বলা হয় বদর শাহ আউলিয়া (র:) জ্বীন ভূতের আছর থেকে শহর ও মানুষফের বাঁচাতে এখানে বসেই প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন । সে সময় থকে আজ পর্যন্ত বিশ্বাসী মানুষ এর পাদদেশে ছোট বড় প্রদীপ রেখে যান । সিডনি থেকে গিয়ে ওখানে যাইনি বা শ্রদ্ধা জানিয়ে আসিনি এমনটি হয়নি, ইহা হবেও না। এভাবে বড় হতে হতে আমানত শাহ(র:) মাজার শরীফে যাওয়াটা হয়ে গেছিল প্রার্থনার অঙ্গ। তখন চুটিয়ে লেখালেখি করি। নামটাম মোটামুটি সবার জানা। জাতীয় পুরষ্কারও জুটে গেছিল। লেখক ছড়াকারদের অনেকেই এ নিয়ে কানাঘুষা করতো। তাদের মনে সন্দেহ প্রগতিশীল হলেও দরগাহ মাজারে ঘোরে কেন? কেন যায় রামকৃষ্ণ মিশনে ? অনেক বড় হয়ে সে যাতায়াত কিছুটা শ্লথ হয়ে গেলেও প্রভাব বা শ্রদ্ধার জায়গাটা কখনো টাল খায়নি। আজও না।
সেখানে যখন মিলাদ মাহফিল হতো বা যে কোন মিলাদের লাইনে দাঁড়ালেই একটু পর চোখ বেয়ে পানির ধারা নামতো আমার। সুরেলা কন্ঠের জাদু আর প্রার্থনা মিলে ভালোবাসা নুয়ে পড়তো লতার মতো। এভাবেই আমি নবীজীর প্রেমে পড়ে গেছিলাম। আমার এখনো বিশ্বাস তাঁর কাছে বিশ্বাসীর পরিচয় একটাই। আর সে মানুষটি কখনো তাঁর দোয়া থেকে বাইরে থাকতে পারেন না । সে কারণেই সিডনি বসবাসের এক পর্যায়ে আবারো অলৌকিক শক্তির স্পর্শ পেয়েছিলাম । তখন সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। পরিবেশ ও সময় বিনষ্ট করার দানবদের তখনো চিহ্নিত করতে শিখি নি। বুঝতে পারি নি ঈর্ষা আর হিংসার আগুন কতোটা ভয়ংকর হতে পারে । মন খারাপের সে সময়কালে বইমেলার প্রতিষ্ঠাতা নেহাল নেয়ামূল বারী আমাকে মহানবীর জীবনী দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। রোজ ট্রেনে চেপে ব্যাংকে যাবার সময় পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে নিজের ভেতরে একধরণের শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছিলাম আমি। সত্যি কথা বলতে কি গোলাম মুস্তফার লেখা এই জীবনী গ্রন্থটি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে উপেক্ষা করার শক্তি। সে থেকে আমি আরো একটি বিষয় জেনেছি দুনিয়ার কোন মহামানব ও ঈর্ষা বা হিংসা থেকে মুক্তি পাননি। সেখানে আমরা তো নিতান্তই শিশু।
জীবনের নানা অনুষঙ্গে ঈদও ছিল এবং এখনো একটি অনিবার্য বিষয় হিসেবেই আছে। করোনার সময় যখন কোথাও যাওয়া যায়নি, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়ে গেছিল অবরুদ্ধ । সে সময়কালে আমরা নিজেরাই পালন করেছি উৎসব। এই উৎসব কে সংকীর্ন করে দেখার সুযোগ রাখেনি সংস্কৃতি। শিল্প সাহিত্য আর ঈদ যখন থেকে একাকার হয়ে উঠতে শুরু করলো তখন থেকেই ঈদের সর্বজনীনতা বেড়েছে । বেড়েছে তার বিস্তৃতি। আপনি এমন কোন ঈদ পাবেন বা দেখবেন যে ঈদের সময় নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থাকে না ? এবারের ঈদে নি:সন্দেহে গান গেয়ে মাত করবে অনিমেষ । ধর্ম সম্প্রদায় এব ভেদাভেদের ওপরে উঠে গেছে ঈদ বিনোদন । এমন কি সমাজেও এর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যত ওজর আপত্তি আর বিধিনিষেধ চলছে অন্দর মহলে। চলছে দেশে বিদেশে বাঙালির আড্ডাখানায় ।
আমি শৈশব কৈশোর যৌবনে যে অসাম্প্রদায়িকতা যে ভালোবাসার বন্ধনে বড় হয়েছি তাই বহন করবো আজীবন । কে পরিবর্তিত হলো কার মনে কি চিন্তা এলো কে বা কা’রা ঈদ নিজেদের মনে করে ভাগ দিতে চাইলো না তাতে আমার কী আসে যায়? আমি সংশয়বাদী মানুষ। কিন্তু এটা বিশ্বাস করি সৃষ্টি ও সৃজনের কোন এক অদৃশ্য কারিগরের খেলার পুতুল আমরা। তিনি বা সে শক্তিই আমায় বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে। কথা বলতে দিয়েছে বাংলা ভাষায় । বন্ধু বান্ধব আত্মীয় ও অধিকাংশ স্বজন দিয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের। এই আমার অতীত আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত ।
ঈদ উৎসব শুভ হোক। মহামারী মুক্ত হোক অমৃতের সন্তানেরা। মানবজীবনে শান্তি ফিরে আসুক।
অজয় দাশগুপ্ত
কলামিস্ট, লেখক
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। 
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments