আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে । সাকিনা আক্তার

  
    
           সাকিনা আক্তার

ছোট্ট একটা দূরন্ত প্রজাপতি হঠাৎ গা ছুঁয়ে উড়ে গেলে যেমন লাগে, তেমনি অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হল। আমি আমার সন্তানের প্রথম অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পৃথিবীর আর কোন ছোঁয়া এত স্বর্গীয় সুন্দর হতে পারে বলে আমার জানা নেই। দু’চোখ জলে ভরে গেল। অজান্তেই হাত দুটো পেটে আলতো চেপে বললাম ভালোবাসি।

কয়েক মাসের ছোট্ট আমি বয়ে বেড়াচ্ছি আমারি ভিতর। মাতৃত্ব এক সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা। জানি না অন্য কারো কেমন লাগে। যে কোন কারনেই হোক, এই সময়টা আমি ছিলাম সম্পূর্ণ একা। অনাগত সন্তানের পিতার সাথে একটা শীতল খোলস এর সম্পর্ক। অফিস, বাসা ছাড়া আমার আর কোন জগৎ নেই। ইচ্ছে হলে কথা বলতে পারিনা পরিবারের কেউ বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। কয়েকবার লুকিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, তাতে ঘরে যে অশান্তি হতো, বেছে নিয়েছি নিঃসঙ্গতা, স্বেচ্ছা নির্বাসন।

হয়তো এই জন্য ছোট আমির সাথে সব কথা হতো মনে মনে। একদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরছি ট্রেনে করে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। আমি বানান করে বলছিলাম দেখ দেখ এটা বৃষ্টি। ভেতর থেকেও সারা পেলাম অস্থির ভালোলাগার। এমন হাজারো কথা হতো আমাদের।

যখন একটু একটু করে বড় হতে লাগলো, বেস স্পষ্ট টের পেতাম হাত পা ছুড়ছে।

একদিন গোসল করতে করতে খুব খেলা করতে ইচ্ছে হলো। খুব শীত ছিল তখন। গায়ে ঠান্ডা পানি ছাড়তেই মনে হল হাত-পাগুলো কুঁচকে গুটিয়ে নিল বাচ্চাটা আমার। খুব হাসছিলাম অনুভব করে। ওরে আমার লক্ষ্নী সোনা বলে হালকা কুসুম গরম পানি ছেড়ে দিলাম। কি আশ্চর্য! ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো। জগতে এর চাইতে রহস্যময় বোধহয় আর কিছুই হয় না।

অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম, আমার ছোট্ট প্রাণ আমার কোল জুড়ে আসবে। দশটা মাস পার হতে চলেছে চিন্তা বাড়ছে। একা একা থাকতে থাকতে নানা মানসিক যন্ত্রণায় প্রায়ই আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। অনুভূতি শক্তি হারিয়ে ফেলতাম। এমনই মনে হচ্ছিল এক দিন, ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলাম। ঠিক যেন সিনেমার মতো ডাক্তার আমাকে বললেন সরি অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি এর মানে কি? মাথা নিচু করা ডাক্তারের ভেজা চোখ দেখে মনে হল আমি হারিয়েছি সব।

এক অমানুষিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে দীর্ঘ সময় পার করার পর দেখলাম পাশে শোয়ানো আমার প্রাণহীন স্বপ্ন।

পেইন্টিং: সাফিনা জামান

আমার প্রথম মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নার্সকে বললাম আমি একটু বাথরুমে যাচ্ছি, আমার বাচ্চাটার পাশে থাকো পড়ে না যায়! নার্স একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে, আসলেই তো ওর নড়ার কথা নয়! চোখ মেলে চাইল না, ছোট হাত দুটো ধরা হলো না, তার আগেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেল না জানি কি অভিমানে।

একটা সময় আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেল, কবর দেবার আগে বলল আমি কি কোলে নিতে চাই?

আমি এখনো সেই হৃদস্পন্দন অনুভব করি, বাচ্চাটাকে কোলে জড়িয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি অন্য কোন ভূবনে।

হঠাৎ দেখি আমার এক অফিসের কলিগ এসেছে ওইদিনই, কিছু সময় পরে যার সাথে আমার কয়েক ঘন্টা আগেই কথা হয়েছিল। আজকে ওর প্রথম মেয়ের জন্ম হয়েছে, এই সংবাদ দিতে ফোন করেছিল। ও জানতো না আমি হাসপাতালে, জানতো না আমি নিজেই হারিয়েছি আমার সত্তা। আমি ওকে কংগ্রাচুলেশনস বলেছিলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করে বলল, তুমি এমন কেন? আমার সুখের সময়টুকু যাতে উপভোগ করতে পারি, সেজন্য নিজের দুঃখ লুকিয়েছ? নিজের কথা ভাবো, একবার হলেও।

বাড়ি ফিরে এলাম শূন্য হাতে। হঠাৎ হঠাৎ করে মন কোথাও উধাও হয়ে যায়। ভীষণ একা হয়ে গেলাম এই বিশাল পৃথিবীতে। এখনো মনে পড়ে একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছি খালি হাতে। কতদূর হেঁটেছি মনে নেই। হঠাৎ একটা বাস এসে পাশে থামল, বলল তুমি খুব বিপদজনক জায়গায় একা হাঁটছো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে সময়টাও ভালো নয়। তুমি কোথায় যাবে? তুমি ঠিক আছো? আমি বাসার ঠিকানা বললাম। অবাক করে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে বলল তুমি বাসে ওঠো, নামিয়ে দিচ্ছি। ভাবলাম পৃথিবীতে ভালো মানুষ এখনো আছে।

একাকীত্ব সইতে না পেরে আবার অফিস শুরু করলাম। প্রায়ই আমার এক কলিগ আলতো করে ঘাড়ে হাত থেকে বলতো খুব টায়ার্ড লাগছে কফি খেতে যাবে? আমি বুঝতাম আসলে আমাকে একটু সামলে নিতে সময় দিচ্ছে। আমি কাজ করতে পারতাম না, অশ্রু ঝরা দুই নয়নে তাকিয়ে থাকতাম অদৃশ্যে।

একদিন বাসায় ফিরছি তুমুল বৃষ্টি। মনে হচ্ছে আকাশ যেন ভেঙে পড়বে। বজ্রপাত হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ট্রেনের ভেতর থেকেও কেমন আতঙ্ক হচ্ছিল।

আচ্ছা আমার বাচ্চাটা কি ভয় পাচ্ছে কবরের ভিতর? আহারে ভিজে যাচ্ছে একেবারে। অনেক কিছু ভেবে আমার মন চিৎকার করে কাঁদছিল ওই বর্ষণের চাইতেও প্রবলবেগে। হঠাৎ কেন জানি না মনে হলো আরে, বৃষ্টি তো ও জানে! আমি তো ওকে বলেছি! কত বৃষ্টির গান শুনেছি! আবার মনে মনে কথা বলে উঠলাম দু’জন।

থেমে গেল মনের ঝড়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments