আজ আমাদের পিতৃতূল্য বড় ভাইজানের ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৮৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি, এই দিনে আমাদের বড় ভাইজান আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
ভাই, মাত্র দুটো অক্ষরের একটি শব্দ। অথচ ভাই শব্দটিতে আবহমান বাঙালীর ঐতিহ্যে লালিত আবাল্য স্নেহ-মায়া-মমতার অবিচ্ছেদ্য গভীর বন্ধন জড়িয়ে আছে। আর ভাই-বোন সম্পর্কটা যেন বিশ্বজনীন এক মায়াবী মাধুর্যে ভরা, এক অনিঃশেষ অমোঘ আকর্ষণ! বিশেষ করে বোনের কাছে ভাই একটি বিশাল শক্তি। ভাই গর্ব করার মতো একটি মহামূল্যবান সম্পদ। আজ এই দিনটিতে একজন গর্বিত বোনের ভাই হারানোর দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরছি।
লোক মারফত ভাইজানের অসুস্থার খবর শুনি। সাথে সাথে রওয়ানা হই। বাসার কাছাকাছি এসে দেখি বাসার সামনে মানুষের ভীর।ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠল! উদ্ভ্রান্তের মতো এক দৌড়ে ভেতরে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার প্রাণপ্রিয়, পিতৃতুল্য বড় ভাইজানের নিথর দেহ খাটিয়ায় শোয়ানো। ভাইজানের মৃত লাশ ধরে অপ্রতিরোধ্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে এতটাই দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম যে কাঁদার শক্তিটুকু আমার ছিলনা। এই বয়সে পুত্র শোকে পাগলিনী মা আমার, পুত্রের লাশ ধরে সে কী বুক চাপড়ে কান্না! পুত্র হারা মায়ের করুণ কান্নার প্রতিধ্বনি যেন আজো আমার কানে বাঁজে। এই বিয়োগ ব্যথায় আমার চেতনা বিলুপ্তপ্রায়। হায় রে নিয়তি! যে ডাল ধরছি সে ডালই ভেঙ্গে পড়ছে। কী পোড়া কপাল আমার! বাবাকে হারিয়ে ভাইদেরকে নিয়ে বাবার শোক কিছুটা কাটিয়ে ওঠছিলাম। কিন্তু সে শোকই আমার জীবনের সঙ্গী হল। সেদিনই বাদ আছর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে ভাইজানকে দাফন করা হলো। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ পুত্র, ২ কন্যা রেখে যান।
ভাইজান তাঁর বড় মেয়ে রেহেনা পারভিনকে বিয়ে দিয়ে গেছেন। একমাত্র নাতনি সোমাইয়াকেও তিনি দেখে গেছেন। মেজো মেয়ে নাছরীন কলেজে অধ্যয়নরত। স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট তিন ছেলে রতন, মানিক ও মুক্তা। এই বয়সে বাবার মৃত্যু! ওরা বাকরুদ্ধ! কিছুকিছু মৃত্যু শুধু কাঁদায় না, কখনোকখনো অনুভূতি শূন্য করে তোলে। হ্যাঁ, অনুভূতিহীন পাথরের মতোই ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। এই বয়সে এতটা আঘাত ওদের পক্ষে সহ্য করাটা ছিল কঠিন। আর বড় ভাবী? তিনি তো স্বামী শোকে মূর্ছিতা। সে এক রোজ কেয়ামত!
বটবৃক্ষের ছায়ার মতোই ভাইজান আমাদেরকে আগলে রাখতেন। আমাদের চার ভাইবোনকে সার্বিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ নিরলস নিবেদিত এক প্রাণপুরুষ। পরিবারকে নিয়ে তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল সূদুরপ্রসারী। একটা শিক্ষিত আদর্শ পরিবার গঠন করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তিনি ঠিকই ভাই- বোনদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন কিন্তু নিজের ছেলেমেয়েকে গড়ে তুলতে নিষ্ঠুর নিয়তি সময় দেননি তাঁকে।
আমার বড় ভাইজান প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন আহমেদ এর জন্ম ও শিক্ষা জীবনঃ
প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন আহমেদ এর জন্ম ১৯৪১ ইং সাল, ১ অক্টোবর। কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার (তদানীন্তন বৃহত্তর দাউদকান্দি থানার) ভাওরখোলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা মরহুম মোহাম্মদ আলী শিকদার এবং মাতা মরহুমা জোবেদা খাতুন। মরহুম জালাল উদ্দিন আহমেদ দাউদকান্দি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি এবং মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। পরে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ১৯৫৯ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (পুরকৌশল) বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৩ সালে কৃতিত্বের সাথে বি.এস.সি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। যা ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি প্রয়াত দেশ বরেণ্য প্রকৌশলী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার একই বিভাগে অধ্যয়নরত আমার ভাইজানের সহপাঠী ছিলেন।
ভাইজানের কর্মজীবনঃ তিনি ১৯৬৩ সালে C & B তে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরে ১৯৬৪ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান পানি উন্নয়ন বোর্ডে (EPWAPDA) সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে যোগদান করেন। ১২ বছর Planning & Design সেকশনে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি রাজবাড়িতে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে পদন্নোতি পেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়া জিকে প্রজেক্ট, ফেনী মুহূরী সেচ প্রকল্পে সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ “প্রথম জলসেচ প্রকল্প” মূহুরী সেচ প্রকল্পে (Muhuri Irrigation project) – এ তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে (MIP- Division – 3) কর্মরত ছিলেন। তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে উক্ত প্রকল্পে Regulator স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট স্থাপনা বিনির্মাণে তিনি কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মতিঝিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৯ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৮ বৎসর। উল্লেখ্য যে, উনার স্ত্রী সম্প্রতি প্রয়াত আয়েশা বেগমকে “আমরা মেঘনাবাসী ফেইসবুক গ্রুপ ২০১৫” “রত্নগর্ভা মা” সম্মাননা সনদে ভূষিত করেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম। প্রতি মুহূর্তে বাবার অভাব অনুভব করতাম। ভাইজান মারা যাওয়ার পরও জীবনটাকে ধূসর মরুভূমি মনে হতো। বেঁচে থাকার আকর্ষণই যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। মৃত্যুজনিত স্বজনবিচ্ছেদ এতটা কষ্টের, এতটা বেদনার তবুও বেঁচে আছি। এত কষ্টের মধ্যেও মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন! কী অদ্ভুত-ই-না আমাদের জীবন! ভাবছি, মানুষের জীবনটা এত ক্ষণস্থায়ী কেন? ঠিক যেন শিউলি ফুলের মতো। শিউলি গভীর রাতে ফোটে আবার ভোর হবার আগেই ঝরে যায়!
বড় ভাইজান সব সময় অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। ব্যক্তি জীবনে তাঁর সম্পদের মধ্যে ছিল পাঁচটি সন্তান। ওরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। আর ভাইজানের হাতেগড়া আমরা চার ভাইবোন। তাই তো ভাইজানের সাজানো বাগানে আমরা আজো ফুটে আছি তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। বাবা আর ভাইজানের আদর্শই আমাদের জীবনের অনুস্মরণীয় পথ ও পাথেয়। তাই তো আমাদের কর্মের মাঝে ভাইজান চিরকাল বেঁচে থাকবেন শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে। আমি আমার কলিজার টুকরো বড় ভাইজানের আত্মার চিরশান্তি কামনায় তাঁর বেহেস্ত নসীব প্রার্থনা করছি। আমিন!
পিয়ারা বেগম
কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ।