পর্ব – ১
✾ তৈয়ারী ›
শুরুটা কিভাবে হলো জানতেই পারলো না সে। হঠাৎ একদিন বাড়ি ঠাসা মানুষ। আর চতুর্দিকে আলোক সজ্জায় ভরপুর। উঠোনের এক কোণা থেকে ঘ্রাণ ভেসে আসছে। দেশী মুরগীর রোস্ট চুলায় চওড়ানো। প্রায় দেড় হাজার মানুষের আয়োজন। বিস্তর দায়িত্ব। পাকা হাতের রাধুনী মোস্তফা বাবুর্চি ছাড়া কাজটা অসম্ভব। ঐ ভোর বেলা থেকেই রান্নার কাজ শুরু। কাঁচা মালের ধুয়া মুছা থেকে শুরু করে কাটাকাটি সব কিছুতেই পারফেকশন খুঁজেন মোস্তফা বাবুর্চি। ভুঁড়ির একটু উপরেই গামছাটা বেঁধে মুরগীর রোস্টের ডেকে থাকা মাংসগুলো উলটপালট করে দিচ্ছে। যাতে মাংস ঠিক ঠাক সিদ্ধ হয়। ঠিক তার পাশের ডেকেই গরুর গোশত রান্না হচ্ছে। ঢাকনা দেয়া থাকায় ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
আর সেদিকে সে অদ্ভূত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের কোনো ঘোষণা ছাড়াই এতো আয়োজন দেখতে পেয়ে। কাল মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে সে। সন্ধ্যার পর পরই ফুফুর সাথে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছোয়। মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় ফুফুর কাছে চলে গিয়েছিলো। সেখানে থেকেই তার উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশুনো। ঠিক দু’টো বছর সে ঢাকার জীবনের রেশ কাটিয়ে গ্রামীণ পরিবেশে ফিরেছে। এরইমধ্যে এরকম চমক। ভীষণ ব্যস্ততা বাড়ির কর্তাদের মধ্যে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসা করার মতো সময়টুকু তাকে কেউ দিচ্ছে না। তাই বাড়ির উঠোনের দক্ষিণ দিকের বড়ই গাছে নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। সেখান থেকে ঘটনার কূলকিনারা মিলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
◉
হঠাৎ বাড়ির প্রবেশ পথে একটি মসৃণ ধূসর রঙের মাইক্রো এসে থামলো। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মাইক্রোর ভেতর থেকে এক এক করে হাফ ডোজন শহুরে মেয়ে নামতে দেখা যাচ্ছে। তার চোখে শহুরে মেয়ে মানেই খানিকটা পাশ্চাত্য দেশের চিত্র ভেসে আসে। মিনি স্কার্ট পড়নে আর নানান ভঙ্গিমায় শরীর বাঁকা করে দাঁড়ানো। চিত্রটার সাথে তার ভালোই চেনা জানা আছে। ঢাকায় থাকা কালীন তার বেশকিছু সহপাঠীর নিত্যদিনের পাশ্চাত্য ভঙ্গিতা দেখে বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে সে। মেয়ে মানুষ বলেই শরীর এদিক সেদিক বাঁকিয়ে দাঁড়াতে হবে, এইটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। আর ছেলে মানুষ সামনে পড়লেই ভঙ্গিতা আরো বেশি প্রখর হয়ে যায়। যেনো মনে হয় সব কাজ ফেলে শহরের সবগুলো ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে বিশ্ব সুন্দরী ভাবা ভালো কিন্তু অন্যের দূর্বলতায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখাটা ভুল। মানুষ হিসেবে সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সুন্দর। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষের রুচিবোধ বলেই একটি শব্দ আছে।
মেয়েগুলোর পরিচয় উদঘাটন করতে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে এই গ্রামে পূর্বে কখনো পাশ্চাত্য ভঙ্গিতার মেয়ে আসেনি। কৌতূহল প্রবণ মনে মাইক্রোটি থেকে দুই এক ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। একি! এতো দেখি ঢাকার পার্লারের লোকজন। সাঁঝ গোঁজের জিনিস নিয়ে এখানে কি করতে এসেছে। সে পার্লারের লোকগুলোকে চিনতে পারার বিশেষ কারণ রয়েছে। ঢাকায় তার এক বান্ধবীর থেকে প্রথম পার্লার সংক্রান্ত বিষয় বস্তু জানতে পারলেও, পরবর্তীতে ফুফুর সাথে বেশ কবার যাওয়া হয়েছিলো তার। বিশাল কারসাজি। মিনিটেই মানুষের লুক পালটে দিতে পারে সেখানে। শুধু তাই নয়, নিয়ম করে মাসে কয়েকবার ঢু মেরে এলে গ্ল্যামার বেড়ে যাবে। সে অবশ্য গিয়েছিলো তার চুলের গোঁড়া ফাটার ট্রিটমেন্ট নিতে। আর তার ফুফু নিয়ম করে যেতো কিসব পেডিকিউর-মেনিকিউর করাতে। তবে কি তার ফুফু ডেকেছে পেডিকিউর-মেনিকিউর করতে? ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল সে।
◉
এরই মধ্যে তার নাকে একটি অসাধারণ ঘ্রাণ ধরা দিলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ঘ্রাণটির উৎস ধরে একটু বাঁকা চোখে দেখে নিলো। মোস্তফা বাবুর্চি গরুর গোশতের ঢাকনাটা এইবার খুলেছেন। কিছুক্ষণের জন্য সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আসলে গরুর গোশত তার খুবই পছন্দের। বাড়িতে যখন গরুর গোশত রান্না হতো দূর থেকে দাঁড়িয়ে মুগ্ধতার সাথে এইভাবেই ঘ্রাণ নিতে থাকতো সে।
সে এখন আবারো দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক বড়ই গাছের নিচে। অন্যদিকে বাড়ির সবাই ব্যস্ত। দুপুরের আযান পড়লেই নামায শেষে মেহমান আসা শুরু করবে। রান্নাও প্রায় শেষের দিকে। গ্রামের গণ্যমান্য বাড়ি হিসেবে খুব পরিচিতি রয়েছে তাদের। তার বাবা আর দাদার বেশ নাম ডাক রয়েছে। গুটি ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে বুড়া লোকজন সকলেই এক নামে চিনে। সরদার বাড়ি। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় শিলাইদহ অঞ্চলের হাট বাজার থেকে পাঁচ মিনিটের পথ।
◉
হঠাৎ প্রত্যাশার খোঁজে সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রত্যাশা সরদার বাড়ির, সরদার আবির ইসলামের একমাত্র মেয়ে। খুব মিষ্টি একটি মেয়ে প্রত্যাশা। টানা টানা চোখ। আর উজ্জ্বল গায়ের রং। ঠিক ধবধবে দুধের মতো। চালচলনেও রয়েছে স্নিগ্ধতা। আজ এতসব আয়োজন তাকে ঘিরেই। শুনে খানিক হোঁচট খেতে হবে। ঠিক প্রত্যাশাকেও এমন করেই হোঁচট খেতে হয়েছিলো। আজ তার বিয়ে। আশ্চর্যান্বিত ব্যাপার হলো খবরটি প্রত্যাশা মিনিট পাঁচেক আগে জানতে পেরেছে। যখন শহর থেকে সাঁঝ গোঁজের লোকজন এলো।
খানিক সময়ের জন্য প্রত্যাশার পায়ের নিচের মাটি আর মাথার উপরের আকাশ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বাড়ি ফিরেছে। সামনে এগিয়ে যাবার বহু স্বপ্ন রয়েছে তার। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করবে। অনেক বড় হবে। দেশ বিদেশে ঘুরে দেখবে।
নিমেষেই কেমন জানি সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যেতে শুরু করলো তার কাছে। মনে হচ্ছে এইটা কোনো এক দুঃস্বপ্নের গল্প। তবে যদি সত্যি এইটা কোনো দুঃস্বপ্নের গল্প হতো প্রত্যাশা বেশ খুশি হতো। দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করতো। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস। এইটা কোনো দুঃস্বপ্নের চিত্র নয়। যা হচ্ছে সবই বাস্তবিক এবং চলমান চিত্র। প্রত্যাশার মানসিক চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে! কিংবা তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিবে। তার বোধ শক্তি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা ছুটে কলঘরে চলে গেলো। মুখ চেপে চিৎকার করছে। যাতে সেই চিৎকার কেউ শুনতে না পায়। বুক ভরা চাপা কষ্ট তার। চোখ থেকে অঝোর পানি ঝরছে। শত চেষ্টা করেও প্রত্যাশা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। ভাগ্যের কাছে আজ তাকে হেরে যেতে হবে। ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে সে…
◉
প্রত্যাশাকে সাজানো হচ্ছে। এমনিতে রূপের মাধুর্যতায় প্রশংসনীয়। তবুও বিয়ের রীতি কিংবা সংস্কৃতি অনুযায়ী তাকে বউ সাঁঝে সজ্জিত হতে হবে। তাইতো ঢাকা থেকে তলব করে অভিজ্ঞ লোক ভাড়া করে আনা হয়েছে। প্রত্যাশাকে একটি চমৎকার জামদানি শাড়ি পড়ানো হয়েছে। খুবই সুন্দর লাগছে তাকে। কিন্তু প্রত্যাশার এই বিয়েতে মত নেই। তাই মনমরা হয়ে আয়নার সামনে বসে আসে। চোখ গুলো ভীষণ ক্লান্ত তার। এখনও সে ট্রমা কাটিয়ে বের হতে পারে নি। বর যাত্রার লোকজন চলে এসেছে। খবরটি দৌড়ে এসে দিয়ে গেলো মার্জিয়া। মার্জিয়া প্রত্যাশার মামাতো বোন।
বর এসে স্টেজে বসেছে। বাকি সবাই ব্যস্ত আপ্যায়নে। কোনো কমতি রাখছে না এই ব্যাপারে। ছোটো থেকে মধ্য বয়সের সকলের নজর এখন বিবাহের পাত্রের উপর। আড়াল থেকে উকি দিয়ে পাত্রের মুখমণ্ডল প্রদর্শনের প্রয়াস লেগে গেছে। সেকেলের মতো একখানা রুমাল মুখের সামনে দিয়ে স্ট্যাচুর মতো বসে আসে সে। মাথায় গর্জিয়াস পাগড়ি আর জমকালো রঙের শেরওয়ানি পড়নে। দেখে বেশ উচ্চ বংশের ছেলে মনে হচ্ছে। ছেলেকে আগে থেকে কেউ কোনো দিন দেখেনি। সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন ঘটক তোফাজল দেওয়ান। কথাবার্তা কিংবা দেখাশোনায় প্রত্যাশার বাবাই একলা সব সামলিয়ে ছিলেন। মাত্র এক সপ্তাহেই সব ফাইনাল করে ফিরেছিলেন সে।
◉
প্রত্যাশা এখন রুমে একা। সাঁঝ গোঁজের সবাই চলে গিয়েছে। আর বাকিরা বিবাহের পাত্রের মুখমণ্ডল প্রদর্শনে ব্যস্ত। প্রত্যাশা বুঝে উঠতে পারছে কি করবে সে! ইচ্ছে হচ্ছিলো পালিয়ে যেতে এইসব কিছু ছেড়ে। কিন্তু যাবে কোথায়? চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে। হাজারো চিৎকারের কান্নায় এখন আর পানি ঝরবে না চোখ থেকে। কথায় আছে না, শোকে পাথর হয়ে যাওয়া। প্রত্যাশাও আজ পাথর হয়ে গেছে। তার প্রফুল্ল জীবনে হঠাৎই কালবৈশাখী ঝড় এসে সব তছনছ করে দিয়েছে। সব স্বপ্নগুলো ভেঙে দিয়েছে।
সূর্য হেলে পড়েছে। খানিক বাদেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসবে। বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বর যাত্রার অর্ধেক লোক চলে গিয়েছে। বাকি লোকজন এখনো অবস্থান করছেন বর আর বউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্যে। সেই ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকার খিলগাঁওয়ে প্রত্যাশার শ্বশুরবাড়ি। প্রত্যাশার বাবা তাড়া দিচ্ছে, জলদি মেয়েকে নিয়ে বেড়েই পড়ার জন্য। অন্ধকার নেমে এলে যেতে অসুবিধা হতে পারে তাই।
প্রত্যাশার রুমে এখন সবার অবস্থান। ছবি তোলার আয়োজনে ব্যস্ত। প্রত্যাশার মধ্যে কোনো সাড় নেই। পুতুলের মত বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এখানে পুতুল খেলা হচ্ছে।
হলদি গুটি গুটি
চিরা কুটি কুটি
আজ প্রত্যাশার বিয়া
প্রত্যাশারে নিয়া যাবে
ঢাকে বাড়ি দিয়া
ফেসী কান্দে ওসী কান্দে
কান্দে মাইয়ার মা
হোলা বিড়াল কাইন্দা মরে
ঢোক মেলায় না।
-(ফরিদপুর)
সময় বরাবরের মতোই বেইমানি করে যাচ্ছে প্রত্যাশার সাথে। গতকাল অব্দি জীবনটা ছিলো তার খোলা আকাশে পাখির মতো। বাড়ি ফিরে আসার পথের অপেক্ষায় ছিলো সে। কতশত পরিকল্পনা নিয়ে বহু দিন পর গ্রামে ফিরেছিলো। প্রত্যাশার মনে হচ্ছে সে এখন জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে। খানিক বাদেই খাটিয়াতে তুলে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে দাফনের জন্য সেই বিষাক্ত নগরীর কংক্রিটের মাটিতে। আর শেষ বিদায় দিতে সে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
অসাধারণ
Best
Wow?