আশা জাগানিয়া ভাষা । এইচ. এ ববি

  
    

ভোরের নামাজ শেষে মা একটু সময় নিয়ে লম্বা ঘোমটা টানা মাথা দুলিয়ে জিকির করতেন রোজ। বিশেষ কোন কারণে ব্যত্যয় না ঘটলে, এটি ছিল তাঁর নৈমিত্তিক আরাধনার অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। এ সময় মায়ের আশপাশে থাকলে, কানে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগতো তাঁর উচ্চারিত শব্দ গুলো। নির্দিষ্ট একটা মাঝারি গতির লয়ে সামনে দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মা মুখে উচ্চারণ করতেন..এল্লা ফু.. এল্লা ফু.. এল্লা ফু..জিকির শেষে, মায়ের ধার ঘেঁষে গিয়ে একটু আহলাদ ও পন্ডিতি ঢংয়ে জিজ্ঞ্যেস করি, মা কার নাম ডাকছো, জিকিরে? তাঁর নিরবতার সুযোগে ভুল উচ্চারণ শুধরে দেবার অভিপ্রায়ে বলি, শব্দটা তো “এল্লা ফু” না, মা। ওটা আল্লাহু। খানিক বিরক্ত হয়ে ধমকের স্বরে মা বললেন, ‘যাহ তো..! এতো পন্ডিতি করিস না। যার নাম ডাকছি হেয় (সে) বুঝলেই অইলো।’ ভেবে, আমিও অবাক থ! তাই তো.. যার নাম ডাকা, সে বুঝলে আর অকারণ উচ্চারণ বিভ্রান্তি নিয়ে এতো বিচলিত হবার কি আছে? পিতাকে বাবা, বাজান, বাপ্পি, পাপা, ড্যাডি যে শব্দেই ডাকিনা কেন, তিনি যদি ডাকের ভেতরে মমত্ববোধ, ভালোবাসা খুঁজে পান, তাহলেই তো আবেগ ছুঁয়ে শীতল হয় পিতার অন্তর। জঙ্গলের অগুনতি পশু পাখি, পোঁকা মাকড় কতই না বিচিত্র শব্দে তাদের নিজেদের ভাষায় শব্দ ব্যবহার করে। তা আমরা না বুঝলেও তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়ার কিন্তু কোন ঘাটতি হয়না।

ভাষায় ব্যবহৃত শব্দাবলী বা উচ্চারণের ধ্বনি যেমনই হোক, ভাবের আদান প্রদান সচল সক্রিয় রাখার স্বার্থেই ভাষার উৎপত্তি ও ব্যবহারিক উপযোগিতা। আফ্রিকার জঙ্গলের বানর এবং সুন্দরবনের বানরের ভাষা আলাদা কিনা আমরা সুস্পষ্ট জানিনা। কিন্তু আফ্রিকার মানুষ এবং বাংলাদেশের মানুষের ভাষা যে এক নয় সেটা জানি। মানুষ সভ্যতার গোড়ালগ্নেই তাঁদের ভৌগোলিক সীমা, আবহাওয়া, পরিবেশ ও তৎসংশ্লিষ্ট জীবন যাপনের মান পদ্ধতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার, রীতি, বিধি, প্রথা ইত্যাদি চালু করে আসছে। স্থান কাল পাত্র ভেদে তাই মানব সমাজে বহুজাতিক ভাষার উৎপত্তি, ব্যবহারের প্রচলন আদি কাল থেকেই।

জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষাটাই মায়ের ভাষা। তবে মায়ের ভাষা কিন্তু মাতৃভাষা নয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই বাস্তবতা। মাতৃভাষা নির্ধারিত হয় জন্মের স্থানের ভিত্তিতে। যে ভাষায় ভাবের আদান প্রদানে মানুষ সব চেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে,সেটাই তার মাতৃভাষা। অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া বাঙালি পরিবারের শিশুদের মাতৃভাষা ইংরেজি। তারা মায়ের মুখের ভাষায় পারদর্শী নয়। একই ভাবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্থানীয়ভাবে জন্ম নেয়া শিশুদের মাতৃভাষাও আরাকান বা রাখাইন নয়, বরং বাংলা তাদের মাতৃভাষা। এতে উচ্চারণের তারতম্য বা শুদ্ধ অশুদ্ধতা বিবেচিত হবে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার প্রেক্ষাপটে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষার সুবিধার্থে একাডেমিক ব্যকরণিক মান নির্ধারণ করা আছে পৃথিবীর সব শিক্ষিত জাতির ভাষাতেই। বিশ্বময় মাতৃভাষার স্বীকৃতি, স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তা সর্বত্র প্রচলনের বিষয়টি নিয়ে একটু পিছনে ফিরে তাকালে, গর্বিত ইতিহাসের অহংটা কেন একচ্ছত্রভাবে বাংলাদেশের বাঙালিদেরই প্রাপ্য, সেটা পরিষ্কার করতে গেলে, একটু পিছনে যেতে হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশ কতৃক প্রায় দু’শো বছরের ভারত অপশাসনের তল্পি গোছানোর প্রাক্কালে,ত্যাজ্য এই উপমহাদেশে দ্বি-জাতি তত্ত্বের বীজ বপন করে যায় তাঁরা। বহু ভাষাভাষী অবিভক্ত তখনকার ভারতে ভাষার চাইতেও প্রাধান্য পায় ধর্ম। ধর্মীয় পরিচয়ের সংখ্যাধিক্য বিচারে বিভক্ত হয় সীমানা। কিন্তু অনতি সময় পরেই, ধর্মের বাইরে, নিজস্ব স্বাতন্ত্রিক ভাষা, সাংস্কৃতিক সামাজিক জীবন যাপনের ভিন্নতা ও জাতিগত বৈষম্যের কারনেই শুরু হয় আন্দোলন।তথাকথিত ধর্মের বেড়াজাল আর আটকাতে পারেনি স্বাধীকারের বিচ্ছিন্নতাবাদী অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের সেই গতিপথ। মায়ের ভাষায় কথা বলবার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এবং উর্দুর বিপক্ষে বাংলা ভাষাকে নিজেদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার জন্য তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন দিয়েই সুত্রপাত হয় স্বাধীকারের মহা প্রলয়।

ভাষার দাবীতে ঢাকার রাজপথে মিছিলে প্রাণ আত্মোৎসর্গ কারীদের মাধ্যমে যে দিনটি অর্জিত হয়েছিল৷ সেই অধিকার আদায়ের দিনটিকেই পরে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কতৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাঁর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে “শহীদ দিবস” হিসেবে পালন করা হতো। এই ইতিহাস বাংলাদেশের প্রায় অনেকেরই জানা। কিন্তু এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরও অনেক বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস।১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষা শুধু বাচনিক বা লৈখিক মাধ্যমই নয়, এটি একটি স্বতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ এক সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন ধারাও।ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, “প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ”।তাঁদের মতে, “ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়।…….এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতিয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।

“পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিল। সেসময়কার গুরুত্বপূর্ন ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।” ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।কমিশনের বাঙালী কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি। থেমে থাকেনি ভাষার অধিকার, স্বজাত্য বোধ ও স্বাধীনতার প্রারম্ভিক বীজ বপনের ছক আঁকবার পরিকল্পনাও।তারই ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আলাদা পতাকা, স্বতন্ত্র সীমানার অধিকার, ভাষার গরব নিয়ে সমুন্নত।ভাষার সম্ভ্রম রক্ষায়, স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা রক্ষায়, সার্বজনীন মানবতার স্বার্থে,সারা বিশ্বের সব মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আমার ভাষা শহীদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদান কারী সব বীরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে আজ বাংলায় সমস্বরে গাইতে চাই “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”।

এইচ. এ ববি
সংস্কৃতিজন, সমালোচক
অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Al Jaim Pappu
Al Jaim Pappu
2 years ago

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা

Oyon
Oyon
2 years ago

শব্দের বুনন, ভাবের গভীরতা, উপলব্ধের সুতীক্ষ্ণতা কেমন বিভোর করে দিলো মন। অনন্য আপনার লেখার ভাষাশৈলী।
কোথাও গতিরোধ হয়নি। স্বচ্ছ সাবলীল চিন্তাপ্রবাহ চেতনার দুয়ারে রোদ ফেলে গেলো!