কমবেশী ৪৮টি বছর ধরেই আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার প্রসঙ্গে নানাবিধ দু:খজনক প্রচারণা অব্যাহত আছে আজ প্রায় ৪৮টি বছর ধরেই। এ এক দু:খজনক ঘটনা। তবুও আছে এমন বিতর্ক বা প্রচারণা সঙ্গত কারণেই। সেই কারণটি হলো সমাজে আজও চিহ্নিত রাজাকারেরা জীবিত আছে, তারা দিব্যি বিচরণ করছে চাকুরি বাকুরি ব্যবসায় রাজনীতি সবই করছে করে চলেছে অব্যাহতভাবে। আর আমরা তাই দেখে তাদের বিরুদ্ধে কখনও সরব হচ্ছি কখনও বা নীরব থাকছি কিন্তু যখন যাই থাকি তখন তা থাকি কোন একটা বিশেষ স্বার্থেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। থাকে কোন না উদ্দেশ্য নিহিত।
সর্বাধিক বেশী নিষ্ময়কর ঘটনাটি হলো এমন বিতর্ক, এমন প্রচার প্রচারণার পেছনে যখন কোন দলীয় স্বার্থকে সংযুক্ত থাকতো দেখি। এই প্রচারণা চালানো হয় দল বিশেষের স্বার্থে-তাদের অনুকূলে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্যোগে বা উৎসাহে। যেন ঐ বিশেষ দলটি মানেই মুক্তিযোদ্ধবাদ বাকী সবাই রাজাকার। যেন নির্বাচন এলে ঐ দলের মার্কাতে ভোট দিলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভোট দেওয়া হলো-অন্য কোন দল বা মার্কাকে ভোট দিলেই সে ভোটটি চলে যাবে রাজাকারের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের, আংশিক হলেও, এ এক করুণ বিকৃতি মাত্র।
বিকৃতি বলছি না শুধু বলছি অর্ধ-সত্য ভাষণ এবং তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটানো হচ্ছে। কারণ এ প্রশ্নে সম্মতি জানাতে কারও মনে দ্বিধা বা সংশয় নেই যে আওয়ামীলীগই (এবং বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ) ছিল মুক্তিযুদ্ধের অংশ গ্রহণকারী বৃহত্তম দল। একমাত্র দল নয়।
ইতিহাস ভুলে না গেলে বা তার কোন বিকৃতি সাধন না করতে চাইলে এ কথা আরও স্বীকার করতে হবে অকুষ্ঠত চিত্তে যে ওয়ালী মোজাফ্ফরের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সি.পি.বি) যার নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড মনি সিংহ-মোহাম্মদ ফরহাদ। কিন্তু নানা আভ্যন্তরীন কারণে দল দুটি ভেঙ্গে যায় এবং বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দলে পরিণত হয়েছে। আবার জাসদ (মূলধারার ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে) মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সক্রিয়ভাবে। পরে জাসদ ও ভেঙ্গে বাসদ এর জন্ম হয় এবং রাজনীতির অঙ্গনে তাঁরাও সাধ্যমত ভূমিকা রাখছেন। অপরদিকে ন্যাপ মোজাফ্ফর) ভেঙ্গে এক অংশ ন্যাপ, অপর অংশ ঐক্যন্যাপ ও আর একটি অংশ গণতন্ত্রী পার্টি হিসাবে। এদের সবাইরই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছিল অত্যুজ্জল। এছাড়াও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আরও কতিপয় ছোট ছোট অনুরূপ ভূমিকা রেখেছিল। তাদের দলীয় মার্কা ভিন্ন ভিন্ন।
কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণায় বড় দলের পক্ষ থেকে কদাপি এই সত্য প্রতিফলিত হচ্ছে ? আদৌ না। বরং যেভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তাতে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে নৌকা প্রতীকে এবং একমাত্র নৌকা প্রতীকে ভোট দিলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ভোট পাবে সুতরাং সবাই নৌকা প্রতীকে ভোট দিন বলে সর্বত্র প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
যদিও রাজাকারদের পরাজিত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই নির্বাচনটি পরিচালিত হতো তবে বড় দলটির অবশ্যই করণীয় ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দলকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিটি দলকেই মর্য্যাদা দিয়ে সেইভাবে আসন বন্টন করে যার যার দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন দলের (বা নির্দলীয়) প্রার্থীর বিপক্ষেই বড় দলটির কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া। অন্য দলগুলি বিজয়ী হয়ে যাতে সম্মিলিত বিরোধী দল হিসেবে সংসদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষীয় বৃহৎ বিরোধী দল গঠন করতে পারে এবং আগামীতে কোন সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাও দখল করতে পারে।
এবারের নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার বিতর্ক বা প্রচারণা নানা মহল থেকেই উচ্চ মাত্রা পেয়েছে। ঠিক যেদিন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলো এবং তাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ও কিছুতেই নির্বাচনী ময়দান পরিত্যাগ না করার প্রত্যয় ঘোষণা করলেন তখন থেকে।
দেশ বিদেশ থেকে দল বাজেরা দিব্যি কোরাস গাইতে শুরু করলেন ড. কামাল হোসেন জামায়াত-বিএনপিকে নতুন প্রাণ দিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে পরাজিত করার ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। সত্যিই কি তাঁরা মনে করেন যে গণফোরাম সভাপতি বঙ্গবন্ধুর সহচর, বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন জামায়াতে ইসলামীকে পুনরুজ্জীবনের খেলায় মেতেছেন? সত্যই কি তাই? সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টি দিলে আমরা কি তেমন কোন আলামত দেখতে পাব?
ড. কামাল হোসেন যে ঐক্যফ্রন্টের সেই ঐক্যফ্রন্ট, তার নেতৃত্ব, তাঁর বক্তব্য ভাষণ তাঁদের কার্য্যকলাপ নিয়ে কদাপি কোন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে আলোচনা-সমালোচনা কোন পত্র-পত্রিকায় এ যাবত চোখে পড়ে নি। শুধুই দেখি নানা রং চড়িয়ে তাঁর কথা ও কাজগুলির অত্যন্ত নোংরা ভাষার সমালোচনা। সবার চোখে তাঁকে হেয় বানানোর এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা যেন।
অভিযোগে বলা হয়, জীবনে তিনি কোনদিন নির্বাচিত হতে পারেননি। সত্য কথা বটে। কিন্তু ঢাকার এক কেন্দ্রে একবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। এর জন্য দায়ী করবো কাকে ? আমার বিবেচনায় তাঁর সংগঠনের শক্তি, দলীয় কর্মী সংখ্রা কম থাকা এবং অক্ষরে অক্ষরে আইন ও বিধি-বিধান মেনে নির্বাচন করার জন্যই তিনি সেবার জিততে পারিন নি। নিয়ম ভেঙ্গে নির্বাচনে বাড়তি টাকা খরচ করতে রাজী হন নি। কিন্তু তা নয় হলো। ভোটাররা কি সেদিন তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন? ড. কামালের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন বা যিনি জিতেছিলেন তাঁরা কি মানুষ হিসেবে, প্রার্থী হিসেবে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন? বস্তুত: সংসদ তাঁকে ছাড়া (যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন) আদৌ মানান সই হয় কি? স্মরণে রাখা দরকার সংসদ সদস্যদের একমাত্র কর্তব্য ও দায়িত্ব হলো সংসদে ভাল আইন প্রণয়ন করা-খারাপ আইনের কঠোর সমালোচনা করা। হয় কি এগুলো এ যুগের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে? সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধকারী ডিজিটাল অপরাধ আইন সংসদে পেশ হলো। কিন্তু কোন সংসদের হিম্মৎ কি তার বিরোধিতা করার। কেন হলো না? সমগ্র সাংবাদিক সমাজ-সম্পাদক পরিষদ সবাই একযোগে দাবী তোলা সত্বেও এবং তিন তিন জন মাননীয় মন্ত্রী বিষয়টি সংসদের উত্থাপনের সুষ্পষ্ট প্রতিশ্রুতি প্রকাশ্যে দেওয়া সত্বেও তাঁরা কি তা করেছিলেন?
কেন হয় না প্রতিবাদ? কেন প্রতিশ্রুতি দিয়েও মন্ত্রীরা তা সংসদে উত্থাপন পর্য্যন্ত করেন না ? সত্য কথা হলো তাঁরা ও সাংসদেরা কেউই সাহস পান না প্রধানমন্ত্রীর রোষানলে পড়তে কারণ তাঁরই সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে ও পরবর্তীতে বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে (?) অনুমোদিত হয়েছিল। তাই বছরের পর বছর আমরা পার্লামেন্টটাকে দেখছি “জো হুজুর” এর ভূমিকা পালন করতে। এই অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। কারণ সংসদ হওয়া উচিত জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান-সংসদকে সরকারী ও বিরোধীদলের যুক্তিভিত্তিক তর্ক বিতর্কের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত একটি প্লাটফর্ম।
এ কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে থাকায় সংসদীয় দায়িত্ব পালনে সাংসদদের প্রচন্ড অসুবিধা হচ্ছে। ঐ অনুচ্ছেদ থাকায় সরকার কোন বিল উত্থাপন করলে তা যতই সমালোচনার উপযুক্ত হোক না কেন-সরকার দলীয় কোন সদস্যই তার দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত কোন বিলের সামান্যতম সুযোগ বা সাহস পান না। ঐক্যফ্রন্ট এই ধারাটি তুলে দেবে বলেছে। তারা আরও বলেছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। বস্তুত: এখন সংবিধানে রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ রাষ্টের প্রধান কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও তিনি প্রধানমন্ত্রী যাই পাঠান-তাকে হুবহু অনুমোদন দিতে বাধ্য হন। এমন কি বিচারপতি/প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও। পৃথিবীর বিভিন্ন সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশেও রাষ্ট্রপতিকে এমন করুণভাবে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয় নি। আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন কালে উভয় নেত্রী মিলিতভাবে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এমন একটি সংশোধণী পাশ করেছিলেন । যা এখন ক্ষতিকর এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ঐক্যফ্রন্ট আরও বলেছে, তারা যদি ক্ষমতায় আসে তবে প্রতিহিংসার রাজনীতি চালাবেন না। সে স্থলে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হবে। হরওয়াক্ত গুম, খুন, হামলা, মামলা অধ্যুষিত এই দেশে বিশেষ করে বিএনপি রাজনীতির এই পরিবর্তন প্রকৃতই যদি সাধিত হয় তবে আইনের শামনের প্রবক্তা ড. কামাল হোসেন সেই পরিবর্তন আনতে তাবৎ কৃতিত্বের দাবীদার অবশ্যই হতে পারবেন।
ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচীতে বলা হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখা হবে। যেহেতু বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জামায়াতে ইসলামীকে আজও অন্তর্ভূক্ত রেখেছে এবং কতিপয় জামায়াত নেতাকে ধানের শীষ প্রতীকও দিয়েছে তাই স্বভাবত:ই অনেকেই সন্ধিগ্ধ। আবার সংস্করাচ্ছন্ন ও বটে এই ভেবে যে তবে কি ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে আবারও জামায়াত থেকে মন্ত্রী করা হবে বা জামায়াতী নন এমন কাউকে কাউকে ঐ অভিযোগে বিচারের আওতায় আনা হবে।
সে যাই হোক, বিএনপির পক্ষে কখনোই জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটবদ্ধ থাকা উচিত হয়নি এবং জামায়াতীদেরকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ করাও ঠিক হয় নি। তা সে যে কোন অজুহাতেই হোক না কেন।
অনুরূপ ভাবে প্রশ্ন কেন জোরে সোরে তোলা যাবে না যে জামায়াতের মূল নেতাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমানিত হওয়ায় প্রদত্ত রায় অনুযায়ী অভিযুক্তদেরকে ফাঁসি দেওয়ার গৌরব নিশ্চিয়ই আওয়ামীলীগ সরকার দাবী করতে পারে-তেমনি এও কি সত্য নয় যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বে-আইনী ঘোষণা করা সত্বেও জিয়া প্রবর্তিত “বিসমিল্লাহ” “জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামীসহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলকে এই সরকারই তো কুখ্যাত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দিয়েছে এবং স্বৈরাচারী এরশাদ প্রবর্তিত “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সংবিধানে পুনরায় অন্তর্ভূক্ত করে বাহাত্তরের মূল সংবিধান ও তার ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তান মুখী সংবিধানে পরিণত করা হয়েছে। পৃথিবীর কোন মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধানে ও ‘বিসমিল্লাহ’ “রাষ্ট্রধর্ম” খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান করেছে “ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান” এটা পাকিস্তানের পক্ষে মানালেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় কারণ দশকের পর দশক ধরে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে করতে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি নবীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রচেষ্টার বিনিময়ে অজশ্র মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের বিনিময়ে ও কয়েক লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এই অর্জন গুলিকে বিসর্জিত হতে দেওয়া যায় না।