আমরা প্রকাশ্যে স্বীকার করি আর না করি, যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সন্তানেরাই শুধু ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, হাজারে হাজারে কারাবরণ করেছিলেন, সারাটি প্রদেশে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, প্রভৃতি শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করেছিলেন। এখানকার বাঙালিরা ছাড়া অন্য কোথাও বাঙালিরা বাংলা বাষার মর্যাদা আদায় করেছেন, লড়াই করেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আমরা তা স্বীকারই করি না। সব চাইতে বিস্ময়কর, আমাদের দেশের গণমাধ্যমসমূহও কদাপি তাদের কোন প্রতিবেদনে বা মন্তব্যে দেশের বাঙালিরাও তাদের মাতৃভাষাকে সেই দেশে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তা কদাচিৎ উল্লেখ করা হয়। কোন কোন পত্রিকায় যদি হঠাৎ সে কাহিনী প্রকাশ করা হয় তা এমনভাবেই প্রকাশ করা হয় যে অনেক খুঁজে তাকে বের করতে হয়। ফলে, কারও নজরে পড়ে না খবরটি।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে সকালে ঢাকা ও পাবনার সংবাদপত্র হকার দিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত “দৈনিক সময়ের আলো” পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে “বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত খবরটির প্রতি আমার দৃস্টি আকৃষ্ট হলো। ঐ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছেঃ
“কমলা ভট্টাচার্য্য বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ। মাতৃভাষা বাংলার মর্য্যাদা রক্ষায় ১৯৬১ সালে আসামে যে ১১ জন প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন কমলা ভট্টাচার্য্য। তিনি ১৯৬৫ সালে সিলেটের শ্রীহট্টে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। রাম রমন ভট্টাচার্য্য সুরবাসিন দেবীর সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন।চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই তাঁর বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর স্বভাবতই আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলাদের পরিবারের। ১৯৪৭ সালের দেশত্যাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে শ্রীহট্টা জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে তার রেশ শ্রীহট্টেও এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে যেতে বাধ্য হন। তাঁরা সিলেটের পাশ্ববর্তী আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন।
শিলচরে কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়ীতে। কমলার বড় দিদি বেলু নার্সের চাকুরী পেয়ে শিলিগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজদিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার তাঁর মেজদির আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনষ্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের পাঠ্যপুস্তক কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার। তিনি একবার তাঁর বড়দিদিকে তাঁর জন্য একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেন নি। কমলা তাঁর সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে এনে বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন।
১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল পরিবারিক আর্থিক অনটন সত্বেও তিনি স্নাতকত্তোর পর্য্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিকের পর তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলেও স্থির করেন। এমন একটি প্রতিকূল পরিবারিক ও আর্থিক পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালে কমলা ভট্টাচার্য্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দানের দাবীতে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া “কাছাড়ী গণ সংগ্রাম পরিষদ এর আহ্বানে সেই বছর ১৯ মে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন সকালে কমলা তার মেজদিদি প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি ও ব্লাউজ পরেই এগার বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়ে শিলচর রেলষ্টেশনের নিকটে প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন। তাঁদের ঘরে কোন খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই আন্দোলনে বেরিয়ে পড়েন কমলা পুলিশের কাঁদানে গ্যাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে একটুকরা কাপড় চেয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন দুপুর পর্য্যন্ত প্রায় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের রেলপথ অবরোধ কর্মসূচী চলছিল। কিন্তু দুপুরের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা শিলচর রেলওয়ে ষ্টেশনে অবস্থানরত শান্তিপূর্ণ অবরোধকারীদের উপর উপুর্যপুরী লাঠিচার্জ এবং আটক করতে শুরু করে। তদুপরি পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক ছুটতে আরম্ভ করেন।
পুলিশ সদস্যদের লাঠিচার্জে কমলা ভট্টাচার্য্যরে ছোটবোন মঙ্গলা গুরুতরভাবে আহন হন। তৎক্ষণাৎ কমলা ছুটে গিয়ে মঙ্গলাকে সাহার্য্যরে চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে পুলিশ সদস্যরা মিছিলকারীদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। একটি গুলি কমলার চোখ ভেদ করে বেরিয়ে যায়।সেই সময় আরও অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। অন্যান্য আহতদের সঙ্গে কমলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে কমলা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।
প্রতিবেদনটিতে অপরাপর শহীদের নাম নেই। তা খুঁজতে পুলিশের সাহায্য নিলাম। নামগুলি পেয়েও গেলাম।
কানাইলাল নিয়োগী চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্রনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রদের, কুমুদ রঞ্জন দাশ, সুনীল শংকর, তরনী দেবনাথ, শচীন্দ্র নাথ কাজল ও সুকোমল পুরকায়স্থ।
কমলার ছোটবোন মঙ্গলাকেও একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। মঙ্গলার জ্ঞান যদিও এক মাস পরে ফিরেছিল মঙ্গলা চিরজীবনের মত মস্তিষ্ক বিকৃতিতে ভুগছেন।
এই আন্দোলনের কাছে আসামি সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। ঐ সরকার প্রদত্ত এক সার্কুলারে সকল জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছিল সমগ্র আসামবাসীই সকল আসামবাসীর রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র অহমিয়া।
১৯৫২’র তীব্র আন্দোলনের এবং শত নির্য্যাতন, লাঠিচার্য, কারাগারে আটক ও পুলিশের গুলিতে যেমন আমাদের বরকত, সালম, রফিক, জব্বার ও শফিকুর কে (পাঁচজন) বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ১৯৫৬ তে এসে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী আদায়ের মাধ্যমে তেমনই অমন সরকারের অহমিকাপূর্ণ এ সার্কুলারকে আসামের বীর বাঙালি সন্তানেরা আন্দোলন, নির্য্যাতন, গ্রেফতার, লাঠিচার্য এবং শেষ পর্য্যন্ত এগার জনের বুকের রক্তে শিলচরের রাস্তা রাঙ্গিয়ে ঐ সার্কুলার প্রত্যাহার করে নতুন সার্কুলার ইস্যু করার মাধ্যমে আসামের বাঙালি অধ্যূষিত তিনটি জেলা-যথা শিলচর, করিমগঞ্জ ও বাইলাকান্দি তে বাংলাকে অহমিয়া ভাষার সাথে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করা হয়।
পরবর্তীতে আসাম সরকার শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য সহ সকল ভাষা শহীদের নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে আসামবাসীর শ্রদ্ধা জানানো ব্যবস্থাও করে দিতে হয়েছে।
বিদেশের মাটিতে বাঙালি জাতির এ এক অসামান্য বিজয়। কারণ সমগ্র আসাম জুড়ে ‘বাঙাল খোদা’ নামে পরিচিতি বাঙালি বিরোধী আন্দোলন দীর্ঘকাল যাবত চলা সত্বেও আমাদের বাঙালিরা তাঁদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় স্কীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে সুদীর্ঘ আন্দোলন করেন এবং বিজয় অর্জন করেন অসামান্য ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে।
তাই বাংলাদেশের বাঙালিদের আসামের বাঙালিদেরকে বিপ্লবী অভিবাদন জানানো প্রয়োজন-সংহতি প্রকাশ করা প্রয়োজন তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল আত্মদান ও বিজয়ের সাফল্য অর্জন করার জন্য।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আমাদের আসামের আন্দোলনের চাইতে পুরাতন। হতে পারে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন ও তার বিজয় থেকে আসামের বাঙালিরা উৎসাহিগত হয়েছিলেন। স্যালিউট আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি তাঁদের ঐ আন্দোলনের সকল নেতা ও কর্মীদের প্রতি।
পুরাতন হলেও বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আজও অসমাপ্ত। আজও এখানে ভাষা সংগ্রামীদের কোন তালিকা সরকারি উগ্যোগে প্রণয়ন ও প্রচার করা হয় নি-প্রকাশ করা হয় নি তাঁদের নামের তালিকাও গেজেট আকারে। দেশব্যাপী ভাষা সংগ্রামীরা ভাষা যোদ্ধারা কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তিনি বেলা অন্নসংস্থান করতে পারছেন কি পারছেন না সে হিসাব কেই বা রাখে।
হ্যাঁ, রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই প্রথমত প্রয়াত চিত্ত রঞ্জন বাবু (বই প্রেমী এবং প্রখ্যাত প্রকাশক) স্ব উগ্যোগে ছালা পেতে দু’চার খানা বই নিয়ে যে মেলা বসিয়েছিলেন কালের পথ পরিক্রমায় তা আজ বাঙলা একাডেমির উদ্যোগ ও পরিচালনায় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এক বিশাল বইমেলার আয়োজন হয়ে থাকে। আরও বহু ধরণের কর্মসূচীও আমরা পালন করে থাকি।
কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে মূল সুর ছিল তা এখন বিস্মৃত প্রায়। দাবী ছিলো বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে অপরাপর বাষা ভাষীর ভাষা সমূহেও যেমন পাঞ্জাবী সিন্ধু, বালুচ ও পুশতু ভাষাকেও একই মর্য্যাদা দিতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর যে অসংখ্য অপ্রকাশিত ভাষা আছে-যেমন আদিবাসীদের ভাষা, সেগুলিকেও যথাযথ মর্য্যাদা দেওয়া। নইলে সকল জাতি গোষ্ঠী তাঁদের সার্বিক উন্নয়নের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে আদিবাসীরা চরমভাবে উপেক্ষিত তাদের ভাষাসমূহও। তাই বহু ঐতিহ্য এবং বিস্তার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তাঁদের উন্নয়ন কার্য্যত: অস্বীকৃত হচ্ছে।
বাংলার মাধ্যমে এক কেন্দ্রিক শিক্ষাঙ্গন, কুদরত এ খুদার শিক্ষা কমিশন বিরোধির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন যখন দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য্য তখন ইংলিশ স্কুল কলেজ মক্ত মাদ্রাসাগুলি ইংরেজী ও আরবীতে শিক্ষাদান চালু করে ভাষা আন্দোলনেরমৌল চেতনা থেকেও আমরা সরে এসেছি।
একুশের (২০২১ এর) একুশে ফেব্রুয়ারি এই বৈপরীতা দূর করে জাতিকে ঠিকপথে চলার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমেই কেবল আমরা বরকত-সালাম-কমলা ভট্টাচার্য্যদের প্রতি যথাথ মর্য্যাদা প্রদর্শন করতে পারি।
রণেশ মৈত্র
কলামিস্ট, রাজনীতিবীদ
একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।