ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, হাইওয়েতে আমার মতো অনেকেই স্লো ড্রাইভ করছেন এক্সিডেন্ট এভোয়েড করার জন্য। আধো আলো, আধো অন্ধকারে এই সময় ড্রাইভ করতে কেমন জানি ভয়ংকর ভালো লাগে আমার। এই সময়টা আমি চিন্তার ডালা খুলে বসি, স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই।
এক বন্ধুর কথা মনে পড়লো। আমার বন্ধুর আমার মতোই ইংলিশ নলেজ অনেক কম ছিল। আমাদের দুজনের Tense এর কথা শুনলে জ্বর আসত। ওর এক চাচা ছিলেন, ইংলিশে অনেক ভালো। যখনি দেখা হতো এক গাদা ইংরেজী প্রশ্ন নিয়ে আক্রমণ, আর আমাদের দফারফা করে ছাড়তেন। আমাদের উত্তর গুলো থাকতো ভুল বানানে, ভুল উচ্চারণে ভরা। তখন থেকে ইংরেজী বিষয়টা আমার কাছে আতংকের। কোনো রকমে টেনেটুনে স্কুল পার করলাম। ঝামেলা আরো বাড়লো যখন কলেজে The ancient mariner পড়তে হলো। একটা শব্দও বুঝিনা, লজ্জায় না পারি কাউকে জিজ্ঞেস করতে, না পারি ঠিক মতো উচ্চারণ করতে, না পারি কোনো অর্থ বুঝতে। লজ্জা পাওয়ার একটা প্রধান কারণ ছিল, যখনি কেউ ইংজিতে কিছু বলতো, সবাই বসে থাকতো তার ভুল ধরার আর হাসাহাসি করার। এই অপমানের ভয়ে চেষ্টা করাই ছেড়ে দিলাম, ভাব নিয়ে বসে থাকাটাই বুদ্ধিমানের মনে হতো তখন ।
যাইহোক, কোনো রকমে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকলাম। সেই একই জ্বালা, এই ইংরেজী আতঙ্ক আমার পিছু ছাড়লনা। এবার বসের আতঙ্ক, ইমেইলে ভুল করা চলবেনা। ইমেইল লিখি আর ঝাড়ি খাই, ইমেইল লেখা যেন আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্ন। বসের ঝাড়ি খাওয়ার চাইতে, যত পারি কপি পেস্ট করে চালাই আর ইগনোর করি ইমেইল লেখা। বছর ঘুরতে ঘুরতে ১৫টা বছর চাকুরী জীবন পার করলাম বাংলাদেশে, কিন্তু সেই যে চাচা আর বস আতঙ্ক মনে গেঁথে গেলো, আমার আর ইংরেজী শেখা হলোনা।
এই আতঙ্কের মাঝেও আমার কিছু অবাস্তব স্বপ্ন ছিল। তেমন একটা স্বপ্ন ছিল, কোনো একটা টেক জায়ান্টের সাথে কাজ করার। সেই স্বপনের অনেক বড়ো সমর্থকও ছিল আমার চাকুরী জীবনের দুই বস, যাদের অবদান আমি কোনোদিন ভুলবনা। ২০১৪ তে আমার নতুন জীবন শুরু। পাড়ি জমালাম অস্ট্রেলিয়ায়। কি জ্বালা এই ইংরেজী আতঙ্ক কি আমার পিছু ছাড়বেনা !! এখনতো নিশ্বাসও ইংরেজীতে ফেলতে হবে।
শুরুর দিকে, আমাজনে জয়েন করার পর অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। এখানে নানান ভাষার লোক কাজ করে, আর আমার কাতারের লোকও অনেক, যাদের ইংলিশ হলো সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি যখন আমার কলিগদের সাথে কথা বলার জন্য শব্দ হাতড়িয়ে বেড়াতাম, আমার কলিগরা অধীর আগ্রহে বসে থাকতো কখন আমি সেন্টেন্সটা শেষ করবো, অথবা তারাই হেল্প করতো শব্দ যোগানের। কি আজব ব্যাপার, এরা দেখি আমার ভিন্ন উচ্চারণে হাসেনা, বলেনা “তোমার উচ্চারণ তো দাদাদের মতো, পাশের দেশীয় !!” ওরা বরং আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
৬ টা বছর কেটে গেলো, এখন আমি আর ভয় পাইনা, কারণ ভাষাটা আসলে যোগাযোগ এর মাধ্যম, স্টেটাস প্রকাশের জন্য না, আপনি কি বলছেন তা আর একজন বুঝতে পারাটাই হলো মোদ্দা কথা। এখন আমি মনে মনে হাসি, যখন দেখি হাজারো মানুষ আমার ভিন্ন উচ্চারণের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছে, আমাকে ওদের মেন্টর ভাবছে, আমি জানি কেন – কারণ ওদের আমার সাথে কমিউনিকেশনের উদ্দেশ্য আমার ভুল ধরা না, বরং মূল বিষয়টা বুঝতে পারা, কোনো একটা স্পেসিফিক টপিকে।
এতো গেলো শুধু আমার ইংরেজী আতঙ্ক। আমার ধারণা, আমাদের বাংলাদেশীদের (আমি সহ) সবার কোনো কিছু চেষ্টা করাটা ভয় দিয়ে শুরু হয়। কারণ এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা। “লোকে কি বলবে”, “ভুল যেন না হয়”, “সাবধানে আগাও”, “সব জেনে শুনেই আগাও” – আমরা এই সাবধান বাণীগুলো নিয়ে বড়ো হয়েছি। ভুল করলে সারা জীবন ওই ভুলের অপবাদ আর হাসি ঠাট্টার পাত্র মানুষ আমার সমাজে গুণে শেষ করা যাবেনা। গত ৬ বছর আমার সবচেয়ে বড়ো লার্নিং হলো, ভুলের ভয়ে বসে না থাকা, কে কি বলবে এই ভেবে হাত পা গুটিয়ে না রাখা। একটা নতুন আইডিয়া, নতুন কিছুতে সবসময় অনেক অজানা থাকে। আমরা যদি চেষ্টা না করি, কখনোই আমাদের এই অজানা, জানা হবেনা। এতে অবশ্যই ভুলের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু এই ভুল করাটা যদি আমরা Lessons learned হিসেবে চিন্তা করি, পরের বার একই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। আর আমাদের মাথাটা আসলে একটা জাদুর বাক্স – যত বেশি আমরা নতুন কিছু চেষ্টা করবো, তত বেশি এই জাদুর বাক্সটা বুদ্ধিমান হবে আর আমাদেরকে নিজের অজান্তেই ভুল গুলো শুধরে দিবে। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নতুনত্ব এসেছে সব কিছুর মূলেই ছিল অজানাকে জানার সাহস, এবং ভয়ে বসে না থেকে চেষ্টা করার প্রচন্ড ইচ্ছা ।
তাই আজ থেকে আসুন আমার সবাই ভুলের ভয়ে বসে না থেকে চেষ্টা করি, লোকে কি বলবে – এই মানসিকতা বাদ দি, একটা পরিবেশ তৈরী করি যাতে সবাই সরল মনে ভুল স্বীকার করে। আর অন্যের কাজে উৎসাহ নাহয় নাই দিলাম, কিন্তু তামাশা না করি।
আমার লেখাটাতে অনেক সমালোচনা ছিল, নিজেকে নিয়ে, নিজের দেশকে নিয়ে, নিজের মানুষকে নিয়ে। কিন্তু কোনোভাবেই এটা আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে নিয়ে বড়াই করার জন্য না। আমি নিজেও এখনো শিখছি, কিভাবে এই পরিবর্তনটা নিজের পরিবার দিয়ে শুরু করতে পারি, নিজের মেয়েকে চেষ্টা করি সেই সাহস যোগাবার, কিন্তু মনযে আমার উড়ু উড়ু, ফিরে যায় ছোট বেলার শিক্ষায়, আর বলে – “ওরে মা সাবধান!! ভুল যেন না হয়!!”
১৬ মার্চ, ২০২১।
মাসুদুর রহমান সায়েম
সিডনি , অস্ট্রেলিয়া।
আমি পেশায় শিক্ষক। এক সময় ভালো ছিলাম। আপনার লেখা পড়ে না হচ্ছে ‘আবার শুরু করা উচিত আমার’। ধন্যবাদ।